শ্যামলাল গোসাঁই
গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে যেভাবে লাভ রাশিয়ার, লোকসান আমেরিকার
হামাস কতৃক গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলিদের উপর হামলার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ মোড় পরিবর্তন করে এখন নয়া আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। একইসাথে ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলা এবং আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে ফিলিস্তিন নামক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি আরব বিশ্বের তা অনেকটাই আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে। একইসঙ্গে গাজার সঙ্গে আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েলিদের যুদ্ধের পর কিছুটা লাভের মুখ দেখেছে রাশিয়া। বিপরীতে লোকসানের আশঙ্কা ঘনীভূত করেছে ইউক্রেন ও দেশটির সরকারকে। আর এতে করে অনেকটা লোকসানের শিকার হতে পারে খোদ আমেরিকাকেও।
গাজা-ইসরায়েল সংঘাতের আগ পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। কেননা, বাইশ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে মোটা দাগে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করে আসছে আমেরিকা। বাইডেন প্রশাসন সর্বাত্মকভাবে কিয়েভের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছেন। এই প্রেক্ষিতে ইউক্রেনে ড্রোনসহ সামরিক অস্ত্র সরবরাহও করে আসছিলো আমেরিকা। যা দিয়ে রাশিয়ার মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারছিল ইউক্রেন।
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া এ সংঘাতে আমেরিকার মুখোশ অনেকটা খুলে দিয়েছে। মানুষ এখন সরাসরি বুঝতে পারছেন আমেরিকা রাশিয়ার ইউক্রেন হামলাকে মানবতাবিরোধী, হত্যাকাণ্ড বললেও ইসরায়েলি বাহিনী কতৃক ফিলিস্তিনের গাজায় ২৪ ঘণ্টায় সাতশো নারী শিশু মারা গেলেও তারা চুপ থাকে। আমেরিকার এই যে দ্বিচারি সভাব তা এখন অনেকটাই বিশ্বের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আর তাই বলা যায়, এই গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের পর রাশিয়া আসলে লাভের গুড়ই খাচ্ছে।
কিন্তু, এই বছরের অক্টোবরে হামাস-ইসরায়েল সংঘাত শুরুর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্লট অনেকটাই বদলে গেছে বলতে হয়। কেননা, এই যুদ্ধেও এক পক্ষের প্রধান সহযোগি বাইডেনের নেতৃত্বাধীন আমেরিকা। তারা গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার শুরু থেকেই হামাসের নিন্দা ও ইসরায়েলের পক্ষে সোচ্চার। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করতে এরিমধ্যে সেনা ও সমরাস্ত্র পাঠানোও শুরু করেছে আমেরিকা। পাঠিয়েছে যুদ্ধ জাহাজও। তবে, এর বিপরীতে লোকসানটা গুনতে হচ্ছে আমেরিকার আরেক যুদ্ধরত মিত্র ইউক্রেনকে। কেননা, একই সময়ে এই দুটি যুদ্ধ চলছে। একদিকে রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনীয় বাহিনীয় লড়াই করছে। যাদের বেশিরভাগ সামরিক সহায়তাই আসছে আমেরিকা থেকে। অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনীকেও সহযোগিতা কাছে আমেরিকা। ফলে একইসঙ্গে দুইটি যুদ্ধরত দেশকে আমেরিকা যুদ্ধ সহায়তা দিতে হিমসিম পরিস্থিতি বোধ করছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সূত্র বলছে, এরিমধ্যে বাইডেন প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একইসঙ্গে দুইটি দেশকে যুদ্ধ সহায়তা দেওয়া আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে, ইউক্রেনে আমেরিকার সহায়তার পরিমাণ কিছুটা যে কমে যাবে বা গেছে তা সহজেই বোঝা যায়। আর এর কারণটাও স্পষ্ট, আমেরিকা এখন ফিলিস্তিনের গাজার বিরুদ্ধে লড়াই করা দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীকে সহায়তা করতে উন্মুখ এবং বাস্তবে, এই অঞ্চলের রাজনীতি নিয়েই এখন আমেরিকা বেশি মনোযোগী। এতে করে যুদ্ধরত ইউক্রেন অনেকটা হতাশায় পড়েছে। কেননা, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেণ্ট জেলেনস্কি বারবার বলে আসছেন, ইউরোপের (কার্যত আমেরিক) সহায়তা ছাড়া তারা যুদ্ধের ময়দানে একদিনও টিকতে পারবেন না। তাই তারা ইউরোপীয়দের পাশে চান।
বাস্তবতা হচ্ছে, আমেরিকা এখন কার পাশে দাঁড়াবে? বাইডেন প্রশাসনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাম্প্রতিক সফরের ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, তারা এখন ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়েই ব্যস্ত। এরিমধ্যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টলি ব্লিংকেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক নেতারা তেল আবিব সফর করেছেন। তাঁদের লক্ষ্য যতোটা সম্ভব ইসরায়েলের পাশে থেকে এই সংঘাতের একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা। যদিও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা খুব শীঘ্র হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধের আলামত দেখছেন। এতে করে স্পষ্ট যে, আমেরিকা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নিয়ে আরো ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এবং এতে করে ইউক্রেনীয় বাহিনী যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হবে। যা বিশ্ব রাজনীতিতে 'আমেরিকাকে বিশ্বাস করা ঝুঁকিপূর্ণ' এই ধারণাকে মজবুত করতে কাজ করবে। এটি আমেরিকার জন্যও খারাপ বিষয়। কেননা, যখন লোকে দেখবে প্রথমে আমেরিকা ইউক্রেনকে উশকে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে এখন আবার আরেক যুদ্ধে নিজেদের মিত্রকে সহায়তা করতে গিয়ে ইউক্রেনকে অবহেলা করছে তখন অন্য দেশগুলো আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কে যেতে দশবার ভাববে।
বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমের খবরেও দেখা যাচ্ছে, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের তীব্রতা বেড়েছে। রাশিয়া আগের চেয়ে বেশি ড্রোন নিক্ষেপ করছে এখন ইউক্রেনের দিকে। অন্যদিকে চীনের আরোপিত ড্রোন নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী ড্রোন পাচ্ছেন না ইউক্রেনীয় সেনারা। ফলে তারা সমরাঙ্গনে পিছিয়ে পড়ছেন। রাশিয়ার হামলার তোপের মুখে এখন অনেকটাই হতাশার ছায়া দেখছেন ইউক্রেনীয়রা। এর দায় যদি তারা কারো উপর দিতে চান তাহলে সহজেই সে আঙ্গুল উঠবে আমেরিকার দিকে।
এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে শুরু হওয়া এ সংঘাতে আমেরিকার মুখোশ অনেকটা খুলে দিয়েছে। মানুষ এখন সরাসরি বুঝতে পারছেন আমেরিকা রাশিয়ার ইউক্রেন হামলাকে মানবতাবিরোধী, হত্যাকাণ্ড বললেও ইসরায়েলি বাহিনী কতৃক ফিলিস্তিনের গাজায় ২৪ ঘণ্টায় সাতশো নারী শিশু মারা গেলেও তারা চুপ থাকে। আমেরিকার এই যে দ্বিচারি সভাব তা এখন অনেকটাই বিশ্বের মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আর তাই বলা যায়, এই গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের পর রাশিয়া আসলে লাভের গুড়ই খাচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকার সাথে বন্ধুত্ব করার মাসুল গুনতে চলেছে ইউক্রেন। যা হয়তো দেশটির রাজনৈতিক অবস্থাকে আরো ভঙ্গুর করে তোলবে এবং রাশিয়া তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে আরো এক ধাপ সহজে এগিয়ে যাবে।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী, ইমেইল- [email protected]
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ