প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ১৬ জুন ২০১৯
আপডেট: ০৬:১২, ১৯ জুন ২০১৯
আপডেট: ০৬:১২, ১৯ জুন ২০১৯
বাংলাদেশে চে‘র গোপন সফর
আইনিউজ ডেস্ক : শোষিত মানুষের মুক্তির আজন্ম স্বপ্নদ্রষ্টা বিপ্লবের ফিনিক্স চে গুয়েভারা। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন! শুনতে যত বিস্ময়করই লাগুক, ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল। অবশ্য সে সময় বাংলাদেশ পরিচিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে। আর এটা সহজেই অনুমেয় যে, পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকায় চে গুয়েভারা পা রেখেছিলেন, এ সংবাদ আমাদের অনেককেই বিহ্বল করে দেবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সন্দেহ প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই: ঢাকার আদমজী জুট মিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কে আর হাসান ও ভারতীয় সাংবাদিক ওম থানভি এবং চে গুয়েভারার বেশ কয়েকটি জীবনী গ্রন্থ থেকে চের বাংলাদেশ সফর বিষয়ে নিশ্চিত তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে কে আর হাসান আদমজী পাটকলের ৩ নম্বর মিলে কর্মরত ছিলেন। তখন আদমজীর ৩ নম্বর মিলে কাজ করতেন ছায়েদুল হক ছাদু, আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। জাঁদরেল শ্রমিক নেতা হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি আছে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
ঘটনাচক্রে এ শ্রমিক নেতা ৩ নম্বর মিলের কর্মকর্তা কেআর হাসানের কাছে রক্ষিত একটি বইয়ে চে গুয়েভারার ছবি দেখে সোল্লাসে জানান: ছবির লোকটিকে তিনি চেনেন এবং ১৯৫৯ সালের জুলাইয়ে এ আদমজী জুট মিলেরই ৩ নম্বর মিলে তার সঙ্গে ছবির মানুষটির সাক্ষাৎ হয়েছে।
কে আর হাসানের কাছে শ্রমিক নেতা ছাদুর বর্ণনানুসারে : ১৯৫৯ সালের জুলাইয়ে চে গুয়েভারা একটি প্রাইভেট কারে, ছদ্মবেশে আদমজী জুট মিলের শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। আদমজী শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিক নেতারা ছাড়াও ৩ নম্বর মিলের তত্কালীন জেনারেল ম্যানেজারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন চে গুয়েভারা। ৩০ মিনিটের মতো চের সঙ্গে আলাপ হয় শ্রমিকদের। সাধারণ একজন শ্রমিক হিসেবে সে সভায় ছাদুও উপস্থিত ছিলেন। ছদ্মবেশে ও পরিচয়ে আসা চে কোত্থেকে এসেছিলেন বা সাক্ষাৎ শেষে কোথায় ফিরে যান, সে বিষয়ে ছায়েদুল হক ছাদু আর কিছু জানতে পারেননি এবং এই অচেনা বিদেশীদের নিয়ে তার মধ্যে বিস্ময় ছিল। তরুণ ছাদুর পক্ষে তখন চে গুয়েভারাকে শনাক্ত করতে পারার কথা নয়। কারণ সদ্য ‘কিউবা বিপ্লব’ সফল করে তিন মাসের সফরে বেরোনো চে সম্বন্ধে এ বঙ্গের অনেক লোকেরই তেমন পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না। বিপ্লবী চের খ্যাতি তখনো দুনিয়াজুড়ে ততটা বিস্তৃতি পায়নি।
প্রয়াত শ্রমিক নেতা ছায়েদুল হক ছাদুরও চের সঙ্গে দেখা হওয়ার বক্তব্য অমূলক নয়। তার বর্ণিত চে গুয়েভারা যে আদমজী জুট মিলে সংক্ষিপ্ত এক সফরে এসেছিলেন, তার প্রমাণ রয়েছে চে গুয়েভারা-সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনায়, বইপত্রে। এখন স্বতন্ত্রভাবে চের ঢাকা সফরের পুরো প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য আমাদের প্রথম নজর দিতে হবে চের কিউবা বিপ্লব-পরবর্তী বিদেশ সফরের দিকে।
কিউবার সামরিক একনায়ক বাতিস্তাকে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে উত্খাতের মাধ্যমে কিউবা বিপ্লব সম্পন্ন হয়। ১৯৫৯ সালে সংঘটিত এ বিপ্লবের নেতা ছিলেন কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। আর তার সঙ্গী আর্জেন্টিনার ডাক্তার চে গুয়েভারা— এ কাহিনী এখন কমবেশি অনেকেরই জানা।
২ জুন ১৯৫৯ সালে চে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী হিলদার সঙ্গে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার পর আর্নেস্তো চে গুয়েভারার দ্বিতীয় বিয়ের সব বাধা দূর হয়ে যায় তখনকার প্রেমিকা অ্যালেইদা মার্চকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার পর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অ্যাক্টিভিস্ট হিলদা গাদিয়া বিশ্বাস করতেন, অ্যালেইদা তার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছেন: ‘কোনো পুরুষ যখন অন্য কোনো নারীর প্রেমে পড়ে, তখন একজন স্ত্রীর আর কিছু করার থাকে না।’ হিলদার কথায় অ্যালেইদার প্রতি যে ক্ষোভ ছিল, তার রেশ বর্তেছিল কন্যা হিলদিতা গুয়েভারা পর্যন্ত। অ্যালেইদার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন কখনই স্বাভাবিক হয়নি। চের দেহরক্ষীদের একজন আলবর্ত কাসতেইয়ানোসের বাড়িতেই অ্যালেইদার সঙ্গে চের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়, বিয়েতে বিপ্লবের সহযোদ্ধা রাউল কাস্ত্রো সাক্ষী হন। বিয়ের পর পরই হাভানা থেকে চে নবপরিণীতাকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় আসেন তারারায় : হাভানা থেকে বেশি দূরে নয়, খুব আলাদাও নয়, আর বেশি দিনের জন্যও নয়। কারণ এর পর পরই চে গুয়েভারাকে বেরিয়ে পড়তে হয় ভারতবর্ষ সফরে।
ওপরের বর্ণনা চে গুয়েভারার জীবনীকার হোর্হে কাস্তেনাদা রচিত কম্পানেরো: দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়: আওয়ার ম্যান ইন হাভানা থেকে উদ্ধৃত। এখানে তিনি চে গুয়েভারার ভারত সফর নিয়ে আরো উল্লেখ করেছেন:
৫ জুন ফিদেল কাস্ত্রো চেকে তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিশ্চিত করেন যে, দীর্ঘ এক সফরে মধ্যপ্রাচ্য, ভারতবর্ষ আর জাপান সফরে যেতে হচ্ছে তাকে। এক সপ্তাহ পর কয়েকজন প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে নিয়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক দুনিয়াকে আবিষ্কার করতে চে কিউবা ছাড়লেন। এর পর তিন মাস তিনি কিউবা থেকে দূরে ছিলেন। দূর দেশে তার এ সফর ছিল নানা দ্বন্দ্ব আর অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। দুনিয়াজুড়ে চের ধারাবাহিক সফরের এটা ছিল প্রথম যাত্রা। এসব সফর ছিল কিউবা বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় এবং চের জন্য চিত্তাকর্ষক। তবে সফরগুলো যত প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ বা সংক্ষিপ্তই হোক না কেন, চের মনে সবসময়ই নির্বাসিত হওয়ার একটা ভাবনা পীড়া দিয়েছে। এসব সফরে অনেক রহস্যময়তা আছে। তার শেষ যাত্রা ছিল বলিভিয়া, যেখানে তিনি নিহত হন।
১৯৫৯ সালের ১২ জুন দীর্ঘ বিদেশ সফরে চে হাভানা ছাড়েন। ফিদেল মূলত গুরুত্ব দিয়েছিলেন বান্দুং প্যাক্টে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোয় চের সফর নিশ্চিত করায়। কারণ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এ দেশগুলোর সমর্থন কিউবার দরকার ছিল। ১৪ জুন নিজের ৩১তম জন্মদিন পালন করেন মাদ্রিদে। চের সঙ্গে ছিলেন তার দেহরক্ষী হোসে আরগুদিন, দুজন সরকারি কর্মকর্তা ওমর ফার্নান্দেজ ও ফ্রান্সিসকো গার্সিয়া বালস। কায়রোয় দলটির সঙ্গে যোগ দেন গণিতবিদ সালবাদর বিলাসেকা ও ভারতে যুক্ত হন সাংবাদিক জোসে পার্দো য়াদা।
চে গুয়েভারার মাত্র কয়েক দিন আগেই প্রথম স্ত্রী হিলদার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। বিপ্লবে লড়াইয়ের সাথি ও প্রেমিকা অ্যালেইদাকে বিয়ে করেন ২ জুন। বিয়ে হতে না হতেই দীর্ঘ সফরে চে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। চের মতো শক্ত সামরিক নেতার জন্য বিষয়টা অতটা সমস্যাজনক না হলেও অ্যালেইদার জন্য ছিল কঠিন পরিস্থিতি। সেই কঠিন সময়ের বয়ান শোনা যাক অ্যালেইদার স্মৃতিচারণ থেকে—
‘চের এ বিদেশ সফরটা এল এক কঠিন সময়ে। আমাদের বিয়ের মাত্র ১০ দিনের মাথায় ১২ জুন চে কিউবা ছাড়ল। সেপ্টেম্বরের আগে তার আর ফেরা হয়নি। সফরের এত লম্বা সময়ের বিষয়টি বিবেচনা করে আমি চের সচিব হিসেবে তার সঙ্গে যেতে চাইলাম। কিন্তু চে শক্তভাবে আমার এ প্রস্তাব নাকচ করে দিল। ঘটনাটি আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। চে যুক্তি দিল যে, আমি তার সচিব হলেও একই সঙ্গে এখন তার স্ত্রী। তাই আমি গেলে মনে হবে যে, স্ত্রী হিসেবে আমি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি। কারণ চের সফরসঙ্গীদের কারোর প্রেমিকা বা স্ত্রীরা কেউ তাদের সঙ্গে যাচ্ছেন না। চের হাভানা ত্যাগের আগে আমরা একসঙ্গে ফিদেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ফিদেলও চেকে অনুরোধ করল আমাকে সঙ্গে নিতে। কিন্তু চে অনড়।
আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম এবং এটা চেকে রাগিয়ে দিল। চের জন্যও সময়টা কঠিন ছিল আর আমি পরিস্থিতি আরো খারাপ করে দিচ্ছিলাম। চে সফরে যাওয়ার পর ফিদেল আমাকে পরামর্শ দিল জাপান বা মরক্কোয় তার সঙ্গে যোগ দিতে। কিন্তু চে তখনো তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে রাজি হলো না। বরং সে দূরের দেশ থেকে তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে পোস্টকার্ড পাঠাল। প্রথম কার্ডটি এসেছিল জাপান থেকে।’ চে গুয়েভারার এ বিদেশ সফরের সময়টা ছিল ১৯৫৯ সালের ১২ জুন থেকে ৬ সেপ্টেম্বর। এ সফরে চে গিয়েছিলেন মিসর, সিরিয়া, ভারত, বার্মা (মিয়ানমার), শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, বাংলাদেশ (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান), পাকিস্তান (তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান), যুগোস্লাভিয়া, থাইল্যান্ড, গ্রিস, সিঙ্গাপুর, সুদান ও মরক্কো।
দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক ওম থানভি হিন্দি দৈনিক জনসত্তায় ২০০৭ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে (‘হিমাল সাউথএশিয়ান’-এ প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে প্রকাশ হয় সে বছরের ডিসেম্বরে) জানিয়েছেন, ভারত সফর শেষে চে গুয়েভারা বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে চে বার্মা (মিয়ানমার) হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও জাপান যান। চে পাকিস্তানও (তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান) সফর করেছিলেন।
চের এ দক্ষিণ এশিয়া সফরের একটি অংশ (তত্কালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এবং বার্মা), একমাত্র ভারত ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশ, বার্মা ও শ্রীলংকা সফর সংঘটিত হয় খুবই গোপনে, বেনামে ব্যক্তিগত সফর হিসেবে; যার ইঙ্গিত মেলে কাস্তেনাদা রচিত কম্পানেরো: দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা জীবনী গ্রন্থে। চের দীর্ঘ সফরের বর্ণনায় তিনি এক জায়গায় বলেন: এসব সফরে অনেক রহস্যময়তা আছে। এ কারণে সরকারি দলিল কিংবা ঐতিহাসিক বিবরণী এমনকি সমসাময়িক পত্রপত্রিকায়ও তার পুরো সফরের বর্ণনা অনুপস্থিত। তবে শেষ অবধি চের এসব সফর পুরোপুরি গোপন থাকেনি। তার বড় প্রমাণ চের ভারত-পাকিস্তান সফর। শুরুতে দেখা যাক, চের ভারত সফরও কেমন গোপনীয়তায় মোড়া ছিল।
২০০৭ সালের আগস্টে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের হিন্দি দৈনিক জনসত্তার সম্পাদক ওম থানভি তার পত্রিকায় চে গুয়েভারার ভারত সফর নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সঙ্গে ছিল বেশকিছু ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে উত্তর ভারতের কৃষকদের সঙ্গে চে কথা বলছেন। অশোক হোটেলে বসে অল ইন্ডিয়া রেডিওকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছেন। তিনি মূর্তি ভবনে জওহর লাল নেহরুর সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন করছেন। থানভির এ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ভারতের বামপন্থী মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। কারণ চের ভারত সফরের কথা তাদের কাছে পুরোই অজানা ছিল। এর আগে তারা এ ধরনের কথা শোনেনওনি, কেউ কোনো দালিলিক নিদর্শনও খুঁজে পাননি। ফলে অনেকে থানভির প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। সিপিআইয়ের (এমএল) একজন কর্মী এমনকি থানভির প্রকাশিত ছবিগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। এসব সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতে থানভি তার চে গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশ করেন। ২০০৭ সালের জুনে থানভি কিউবায় যান। জন লি অ্যান্ডারসন রচিত চে গুয়েভারার জীবনীতে তার ভারত সফরের একটি বিবরণী তিনি আগেই পেয়েছিলেন। থানভি কিউবায় গিয়ে চে গুয়েভারার ছেলে ক্যামিলো গুয়েভারা মার্চের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হাভানায় চের সাদামাটা বাড়িটি এখন সেন্ত্রো দে এস্তাদিয়োস চে গুয়েভারা বা সেন্টার ফর দ্য চে গুয়েভারা স্টাডিজ। এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি চালান চের ছেলে ক্যামিলো গুয়েভারা। ১৯৫৯ সালে চের ভারত সফর নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থানভি এ সেন্টারে হাজির হন। ক্যামিলো অবশ্য থানভিকে বেশি সময় দিতে পারেননি।
কারণ চের জন্মদিন উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি আর্জেন্টিনা যাচ্ছিলেন। তাই প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা ল্যাজারো বাক্কালাওকে নির্দেশ দিয়ে যান থানভিকে সহায়তা করতে। এখানেই থানভি চে গুয়েভারার লেখা সফরের প্রতিবেদন খুঁজে পান, যেখানে ভারত সম্পর্কেও মূল্যায়ন আছে। নেহরুর সঙ্গে চের ছবিটিও এখানে দেখতে পান। বাক্কালাও থানভিকে একটি কুকরি (নেপালি ছুরি) দেখান। নেহরু এ কুকরি চেকে উপহার দিয়েছিলেন। হাতির দাঁতে বাঁধানো কারুকাজ করা কুকরির ঢাকনায় আছে দেবী দুর্গার প্রতিকৃতি। এর পর দেশে ফিরে থানভি ভারতের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট অফিস, হিন্দুস্তান টাইমসের আর্কাইভ ও কলকাতায় অনুসন্ধান চালান। কথা বলেন কেপি ভানুমাথায়ের সঙ্গে। এই নারী অল ইন্ডিয়া রেডিওর হয়ে চের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। এর পর থানভি ভারতের মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন ও ব্রডকাস্টিংয়ে চের ভারত সফর-সম্পর্কিত দলিলের সন্ধান করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, চে কখনো ভারত সফর করেননি, আর তা করলে অবশ্যই তার ছবি কূটনৈতিক গ্যালারিতে থাকত। এর পর থানভি তার কাছে থাকা চের ভারত সফরের একটি ছবি দেখালে মন্ত্রণালয় খোঁজ শুরু করে এবং চের ভারত সফরের ১৪টি ছবি উদ্ধার করে। এত সব কষ্টসাধ্য অভিযানের পর থানভি চের ভারত সফরের একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণী তুলে ধরেন। ভারতের কমিউনিস্টরা কেন চের ভারত সফরকে উপেক্ষা করেছিল, তার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় থানভির কথায়— এটা সবারই জানা যে, কিউবা বিপ্লবের পর চে চীনে মাও সে তুংয়ের গণযুদ্ধের লাইনে আকৃষ্ট হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে নেতিবাচক হয়ে পড়েন। আর ভারতের বাম আন্দোলন তখন সোভিয়েতপন্থী। তাছাড়া তখন ভারতের কংগ্রেস সরকারের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল না। চের সফরের তিন বছর পরই ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল, যেখানে ভারতকে পরাজয় বরণ করতে হয়। ফলে চের স্মৃতি যে ভারতে একটু আড়াল হয়ে পড়বে, তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। থানভির হিন্দি ভাষায় লেখা আলোচিত প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে প্রকাশ নিয়েও নাটক কম হয়নি! শুরুতে ভারতের বিখ্যাত দৈনিক দ্য হিন্দু প্রতিবেদনটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের আগ্রহ দেখালে থানভি কয়েকটি ছবিসহ সেটি দ্য হিন্দুকে পাঠান। কিন্তু তার পরই তারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেটি আর প্রকাশ করেনি। তার পর প্রতিবেদনটি হিমাল সাউথএশিয়ানে প্রকাশ হয়।
কায়রো থেকে ৩০ জুন চে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নামেন। চে সফরে এসেছিলেন কিউবার জাতীয় নেতার পরিচয় নিয়ে। কিউবা সরকারে কোনো আনুষ্ঠানিক পদ না থাকায় সেদিন একটি স্বাগত কমিটি বিমানবন্দরে চেকে গ্রহণ করেছিল।
কলকাতায় চের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছিল একজন প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির। নিজের সফর প্রতিবেদনে চে সেই মানুষটিকে কৃষ্ণ বলে সম্বোধন করেছেন। চের বর্ণনায় কৃষ্ণ ছিলেন তখনকার দুনিয়ার একজন বিশিষ্ট পদার্থবিদ। কৃষ্ণর প্রাজ্ঞতা চেকে মুগ্ধ করেছিল। চের ওপর কৃষ্ণর চিন্তাধারা, বিশেষত পরমাণু অস্ত্র নিয়ে কৃষ্ণর ভাবনা চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চে লিখেছেন, ‘কৃষ্ণ নামে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তিনি আমাদের দুনিয়া থেকে চিন্তায় অনেক এগিয়ে। তিনি অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি দুনিয়ার সব সম্পদ ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন।’ চে গুয়েভারার জীবনীকার হোর্হে কাস্তেনাদা কম্পানেরো: দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারা গ্রন্থে জানিয়েছেন, চে ভারত সফরে তাজমহলও দেখতে গিয়েছিলেন। তবে বাণিজ্যিক বিবেচনায় চের ভারত সফর কোনো ফল বয়ে আনেনি। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারতের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কিউবার সফর দলটি এখানে তেমন কোনো সফলতা পায়নি।’
কিউবা বিপ্লবের জীবন্ত কিংবদন্তি ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বিমানবন্দরে ফিদেলকে একনজর দেখতে যারা ভিড় করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। তিনি তখন সবে ২০ পেরিয়েছেন। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছেন। কলকাতায় ফিদেলের সফরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গৌতম ঘোষ তার শহরে চের সফরেরও প্রসঙ্গ তুলেছেন: চে ও ফিদেল ছিলেন আমাদের প্রজন্মের আইকন। সেটা ছিল এক রোমান্টিক যুগ। পুরো দুনিয়া পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমরাও সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারিনি। মতাদর্শের চেয়ে রোম্যান্টিসিজমে বেশি আকৃষ্ট হয়ে আমার অনেক বন্ধু নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। গৌতম কীভাবে ১৯৫৯ সালে চের কলকাতা সফর সম্পর্কে জানতে পারলেন, সে সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে (আইএসআই) আমি কলকাতার আইএসআই ক্যাম্পাসে চে গুয়েভারার সফরের একটি ছবি খুঁজে পেয়েছিলাম। ছবিটি আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল। আমার মনে হয় না, খুব বেশি মানুষ চের এ কলকাতা সফর সম্পর্কে জানেন।’ গৌতম ঘোষের এ স্মৃতিচারণটি পাওয়া যায় ২০০৯ সালে প্রকাশিত সুহূদ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের ফিদেল কাস্ত্রো ইন কলকাতা শীর্ষক রচনায়।
চে গুয়েভারার দক্ষিণ এশিয়া সফর নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করা ওম থানভি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ভারত থেকে চে বাংলাদেশে (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান) এসেছিলেন এবং বাংলাদেশ থেকে তিনি তত্কালীন বার্মা (মিয়ানমার) হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও জাপান যান। একই সঙ্গে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন। তবে পশ্চিম পাকিস্তানে ঠিক কবে গিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। চের পুরো সফরের বিবরণ বিভিন্ন প্রকাশিত সংবাদ ও দলিলে উল্লেখ থাকলেও বাংলাদেশ, পশ্চিম পাকিস্তান ও বার্মা সফরের কোনো আনুষ্ঠানিক বিবরণ এখনো পাওয়া যায়নি। তবে চের বাংলাদেশ সফরের আগ্রহের বিষয়ে আমরা অনুমান করতে পারি। চে ভারতের কৃষিমন্ত্রী এপি জৈনের সঙ্গে বৈঠকে ভারত থেকে কয়েকটি পণ্য আমদানি করার আগ্রহ দেখান, যার মধ্যে ছিল পাটজাত সামগ্রী। তাই পাশের দেশ যখন পাটের মূল খনি, তখন সে দেশে যাওয়ার আগ্রহ তার হতেই পারে। তারই প্রমাণ হলেন ছায়েদুল হক ছাদু, আদমজী পাটকলের শ্রমিক নেতা।
উল্লেখ্য, চের এ সফরের কয়েক বছর পর তার এক বিশ্বস্ত অনুচর সিরো বাস্তোস চীন যাওয়ার পথে ঢাকা হয়ে গিয়েছিলেন। চের মতো বাস্তোসের জন্ম আর্জেন্টিনায়। কিউবা বিপ্লবের পর পুরো লাতিন আমেরিকায় বিপ্লব ঘটানোর যে পরিকল্পনা চে করেছিলেন, তার শেষ সহযোগী হিসেবে বাস্তোস এখনো জীবিত আছেন। কিউবা বিপ্লবে আকৃষ্ট হয়ে বাস্তোস ১৯৬১ সালে কিউবা যান। ১৯৬২ সালে আর্জেন্টিনায় বিপ্লব ঘটানোর জন্য চে তাকে বাছাই করেন। পরিকল্পনামতো বাস্তোস আর্জেন্টিনায় গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালের মার্চে সরকারি বাহিনীর আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। পরের বছর বাস্তোস চের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, কারণ চে তখন কঙ্গোয় যুদ্ধ করছেন। এমন এক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে ১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তোসকে চীন ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানায়। চীনে তাকে বলা হয়, তিনি যেন দেশে ফিরে কিউবা ও লাতিন আমেরিকাজুড়ে প্রচার করেন যে, ফিদেল সংশোধনবাদী এবং তিনি (ফিদেল) কিউবা বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তখন চীনের কমিউনিস্টদের কাছে তাদের অনুগতরা ছাড়া দুনিয়ার বাকি সব কমিউনিস্টই সংশোধনবাদী। ফিদেল যেহেতু সোভিয়েতঘেঁষা ছিলেন এবং লাতিন আমেরিকায় তিনি এক স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই তার প্রভাব খর্ব করতেই চীনের এ উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তোস জানান, তার নেতা চে ও ফিদেলের কিউবা তাদের কাছে বিপ্লবের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বাস্তোসের এ মতামতের পর খুব দ্রুতই চীন সরকারের চেহারা বদলে যায় এবং তারা সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফিরতি বিমানে তুলে দেন। বাস্তোস তার অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনী নিয়ে একটি বই লিখেছেন ‘চে ওয়ান্টস টু সি ইউ: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব চে গুয়েভারা’। এ গ্রন্থে চীন যাত্রার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমরা তখন এশিয়ায়। পাকিস্তানি এয়ারলাইনসের বিমান পশ্চিম পাকিস্তানের ঢাকায়ও অবতরণ করেছিল (১৯৭১ সালে এ পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেছে)। সবখানেই ছিল চরম দারিদ্র্যের চিহ্ন। এমনকি বিমানবন্দরের লাউঞ্জেও দারিদ্র্যের আক্রমণ দেখা যাচ্ছিল।’ (পৃ. ২২১)
পূর্ব বা পশ্চিম নির্দিষ্ট না করে চে গুয়েভারার জীবনীকার জন লি অ্যান্ডারসন ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার চে গুয়েভারা: আ রেভল্যুশনারি লাইফ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চে গাজা ও পাকিস্তান সফর করেছেন। এ সময় সাধারণ মানুষ বিপুল উল্লাসে তাকে বরণ করে নিয়েছেন।’
চে গুয়েভারার আরেক জীবনীকার হোর্হে কাস্তেনাদা তার গ্রন্থ কম্পানেরো: দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব চে গুয়েভারায় চের শ্রীলংকা ও পাকিস্তান সফরকে অপ্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটা বুঝতে পারাটা খুবই কঠিন যে, কেন কিউবার তৃতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ নেতা তিনটি দিন করাচি ও কলম্বোয় কাটিয়েছেন, যখন তার দেশের নতুন সরকার ভেতরে-বাইরে নানা সংকট মোকাবেলা করছিল।’
১৯৫৯ সালের আগস্টে চে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। অর্থাত্ ভারত ও বাংলাদেশ সফরের পরই তিনি করাচি গিয়েছিলেন। সাংবাদিকরা অনেক অনুসন্ধান চালিয়েও দেশটির সরকারি দফতরে চের সফরের কোনো দলিলাদি উদ্ধার করতে পারেননি। চের পাকিস্তান সফরের একমাত্র প্রমাণ হয়ে আছে করাচি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের অভ্যন্তরে সে সময়ের সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে তোলা তার একটি ছবি। ছবিটি ২০১০ সালে প্রকাশিত অকিল আব্বাস জাফরি সম্পাদিত ‘পাকিস্তান ক্রনিকল’ বইয়ে প্রকাশ হয়। করাচি বিমানবন্দরে চে ও তার সফরসঙ্গীদের দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদির স্বাগত জানিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। ১০ আগস্ট চে গুয়েভারার সঙ্গে আইয়ুব খান ও মন্ত্রী মঞ্জুর কাদিরের সাক্ষাত্ হয়েছিল। আইয়ুব খানের সঙ্গে চে গুয়েভারার এ সাক্ষাত্ কৌতূহলের জন্ম দেয়। কারণ আগের বছর (১৯৫৮) যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ক্যুদেতার মাধ্যমে আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেন এবং পাকিস্তানের বামপন্থীদের ওপর দমন চালান। চে গুয়েভারারা নিজেরাই কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক একনায়ক বাতিস্তাকে উত্খাত করে বিপ্লব করেছিলেন। হয়তো এ কারণেই চে পাকিস্তান সফরকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেননি। পরে চে গুয়েভারার পাকিস্তান (তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান) সফর নিয়ে অনুসন্ধান করেন দেশটির সাংবাদিক আদনান ফারুক। তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারি দফতরে অনুসন্ধান করেও চের করাচি সফরের কোনো দালিলিক নিদর্শন উদ্ধার করতে পারেননি। সংশ্লিষ্ট সময়কার জাতীয় দৈনিকগুলোর (পাকিস্তান টাইমস, ডন ও নাওয়া-ই-ওয়াক্ত) পাতা খুঁজেও চের সফর সম্পর্কে কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। দেশটির বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সে সময়কার নেতা ড. এহতেশামও জানান, তিনি বা তাদের সংগঠন চের করাচি সফর সম্পর্কে কোনো কিছুই জানতেন না। এর পর ফারুক কথা বলেন পাকিস্তানের (তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তান) একজন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা বিএম কুট্টির সঙ্গে। তিনি ১৯ বছর বয়সে ভারতের কেরালা ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যান। নিজেকে সবসময় কমিউনিস্ট মনে করা এ মানুষটি দেশটির বাম রাজনীতিতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে কিউবার কনসাল জেনারেলের সঙ্গে কুট্টির নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কুট্টি কনসাল জেনারেলকে কমরেড গুয়েরা বলে ডাকতেন। এ গুয়েরা তখন পশ্চিম পাকিস্তানের বামপন্থী তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। একদিন কুট্টি তার কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে কমরেড গুয়েরার অফিসে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে। গুয়েরা হঠাত্ই তাদের এক আশ্চর্য সংবাদ দিলেন। ‘কমরেডস, আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চে গুয়েভারা গতকাল করাচিতে ছিলেন। তিনি একটি আরব দেশের পাসপোর্টে আমার অতিথি হিসেবে এখানে এসেছিলেন। যে সোফায় আপনারা বসে আছেন, সেখানেই গতকাল তিনি বসেছিলেন। একটু ঘুরতে তিনি অল্প সময়ের জন্য ক্লিফটন বিচে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উটের পিঠে চড়েছেন।’ আরব পাসপোর্টে চের পাকিস্তানে প্রবেশের কারণটা সহজেই অনুমেয়, একজন বিপ্লবী নেতা সামরিক শাসিত একটি রাষ্ট্র সফর করছেন এবং একজন সামরিক শাসকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করছেন, এটা গোপন রাখাই ছিল চের মূল উদ্দেশ্য।
চার মাস হাভানা ও অ্যালেইদা থেকে বহু দূরে থেকে ১৯৫৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মাদ্রিদ হয়ে চে দেশে ফেরেন। এক মাস পর ১২ অক্টোবর চে ভারত সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভার্দে অলিভো (সবুজ জলপাই) ম্যাগাজিনে কান্ট্রি অব কনট্রাস্ট শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তা এ সংখ্যায় অনূদিত হয়ে প্রকাশ হচ্ছে।
চের ঢাকা সফর নিয়ে ভবিষ্যতে আরো তথ্য-প্রমাণাদি উদ্ঘাটন হবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। আদমজী জুট মিলের সেসব শ্রমিক, শ্রমিক নেতাদের অনেকেই বেঁচে নেই। ছায়েদুল হক ছাদু মারা গেছেন ১৯৮৭ সালের ২৯ মে। কিন্তু চের সফরের ঘটনা তার কাছ থেকে সংরক্ষিত হয়েছে আদমজী জুট মিলের সাবেক কর্মকর্তা কেআর হাসানের স্মৃতিতে। এ রকম আরো কারো স্মৃতিতে চের সফর সংরক্ষিত থাকাটা অসম্ভব নয়। আরো কোনো উদ্যোগী, গবেষক-তথ্যানুসন্ধানী এ বিষয়ে ভবিষ্যতে হয়তো আরো আলো ফেলবেন।
এসএ/ইএন
আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের
সর্বশেষ
জনপ্রিয়