ডেস্ক নিউজ
আপডেট: ২২:১২, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০
যেভাবে নাম হলো ‘এলিফ্যান্ট রোড’
সংগৃহীত ছবি
রাজধানী ঢাকার একটি ব্যস্ত সড়ক এলিফ্যান্ট রোড। এই রোডটি হাতিরপুল হয়ে চলে গেছে হাতির ঝিল পর্যন্ত। চলার পথে কিংবা নাম শুনে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে কেন সড়ক বা স্থানগুলোর নাম এমন হলো? এর ইতিহাস কি?
মোঘল শাসকদের হাতির লড়াই খুব পছন্দের খেলা ছিল। তাই সম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতি ধরে আনত তারা। ধরে আনা হাতি গুলোকে মাহুত দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজা মহারাজাদের সামনে খেলা দেখানোর উপযোগী করে গড়ে তুলতো।
মাহুত হচ্ছেন একজন হস্তী চালক, প্রশিক্ষক বা রক্ষক। সাধারণত একজন মাহুত যখন তার জীবনের প্রথম দিকে তার পরিবারের একটি হাতির দায়িত্ব পান তখন বালক হিসেবে এই পেশা শুরু করেন। তারা সারাজীবন একে অপরের সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন।
হাতি আকারে অনেক বড় হওয়ায় কোনো মানুষের পক্ষে জীবন্ত হাতি জঙ্গল থেকে ধরে আনা সম্ভব ছিল না। তাই হাতি ধরার জন্য তারা একটি কৌশল অবলম্বন করতো। তাদের এই কৌশলের প্রধান অস্ত্র ছিল কুনকি। কুনকি হল পোষা হস্তিনী। এই কুনকি দ্বারা বন্য হাতিকে খেদিয়ে নিয়ে আসা হতো। এ কারণেই মোঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার প্রশাসনে ‘খেদা’ নামে একটা বিশেষ বিভাগও চালু ছিল। এই ‘খেদা বিভাগ’ এর কাজ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান হতে কুনকি বা হস্তিনী দিয়ে বন্য হাতি খেদিয়ে এনে পোষ মানানো এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
পুরুষ হাতিগুলোকে খেদিয়ে এনে যে জায়গায় রাখা হতো তা পরিচিত ছিল পিলখানা নামে। ফারসি ভাষায়, ‘পিল’ মানে হাতি আর ‘খানা’ মানে জায়গা। দুইয়ে মিলে হয়েছে পিলখানা। এখন যেখানে বিজিবি হেড কোয়ার্টার। যা বর্তমানেও সেই নাম রয়ে গেছে।
পিলখানার এই হাতিগুলো যে শুধু খেলা দেখাতো তা কিন্তু নয়, হাতিগুলোর সামরিক ভূমিকাও ছিল অনন্য।
১৮৬০ এবং ১৮৭০ এর দশকে এই হাতিগুলোকে প্রায়ই পাহাড়ী উপজাতি দমন অভিযানে প্রেরিত হতো। তাছাড়া উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যাতায়াতের বাহন হিসেবে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আগমনে যেমন ভাইসরয় বা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পরিদর্শনের সময় এই হাতিদের দিয়ে প্যারেড ও নানা ধরনের খেলাধুলা ও প্রদর্শনী হতো।
ঢাকার আশেপাশের জমিদাররাও তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহের হাতিগুলোকে অর্থের বিনিময়ে পিলখানায় পোষ মানানো ও প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতেন। পিলখানার এই হাতিগুলোর দেখভালের জন্য ১৮৮১ সালে ঢাকার খেদা বিভাগে একজন সুপারিন্টেন্ডেন্ট, একজন হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট, দুজন ভেটেরিনারি সার্জন, তিনজন ক্লার্ক, একজন পশু হিসাবকারী এবং বেশ কয়েকজন মাহুত নিযুক্ত ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই হাতিগুলোকে রমনা অঞ্চলে চারনের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো।
পিলখানার নামকরণের ইতিহাস জানার সঙ্গে সঙ্গে আরো যে কয়টি জায়গার নাম জানা জরুরি। সেগুলো হলো- এলিফ্যান্ট রোডের হাতিরপুল ও হাতির ঝিল। কারণ এগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে সম্পর্কিত।
মোঘল আমলে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশে ছিল বিশাল ঘন জঙ্গল। পিলখানার হাতিগুলোকে খেতে নিয়ে যাওয়া হত সেই জঙ্গলে। জঙ্গলে যাওয়ার পথে ছিল বিশাল আকৃতির গাছ-গাছালিতে ভরা ছোটখাট বনাঞ্চল। হাতি চলাচলের কারণে রাস্তাঘাটের যে ক্ষয়ক্ষতি ও উপদ্রব সৃষ্টি হতো সেই সম্পর্কে জনগণ নিয়মিত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতো।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৪ সালে মিউনিসিপ্যালিটি প্রতিষ্ঠার পর কর্তৃপক্ষ ঢাকার উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক এলাকা দিয়ে গাছপালা কেটে রমনায় হাতি চলাচলের একটি আলাদা রাস্তা তৈরি করে। যার নামকরণ করা হয় ‘এলিফ্যান্ট রোড’।
নিউমার্কেট এলাকা থেকে রমনা পর্যন্ত এলিফ্যান্ট রোড আজও বিদ্যমান।
এখান থেকে হাতি গোসলের জন্য নেয়া হতো মগবাজারের হাতির ঝিলে। এই হাতির জন্যই এই ঝিলের নাম হাতিরঝিল। পিলখানা থেকে হাতিরঝিলে হাতির আসা যাওয়ার পথটাই আজও ওল্ড এলিফ্যান্ট রোড নামে পরিচিত। যদিও অধিকাংশ মানুষই ওল্ড এলিফ্যান্ট রোড বলতে গাউছিয়া থেকে পরিবাগ পর্যন্ত রাস্তাটিকেই বোঝেন। আসলে রাস্তাটি বর্তমান বিজিবি থেকে শুরু হয়ে গাউছিয়ার সামনে দিয়ে বাটা সিগন্যাল হয়ে মোতালেব প্লাজার পাশ দিয়ে পরিবাগ হয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় হয়ে টিএন্ডটি স্কুলের পাশ দিয়ে মধুবাগের উপর দিয়ে হাতিরঝিলে শেষ হয়েছে।
হাতি চলাচলের সময় জনগণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে মিউনিসিপ্যালিটি কর্তৃপক্ষ একটি পুল বানিয়ে দেন যা পরবর্তীতে হাতিরপুল নামে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে পুলটি না থাকলেও হাতিরপুল নামটি বিদ্যমান রয়েছে।