মো. রওশান উজ্জামান রনি
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ইতিহাস
রাজধানী ঢাকা । ছবি লিখক
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং একটি ম্যাগাসিটি। যেটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান শহর। মোগল সাম্রাজ্যের সময় ঢাকা একটি বিশ্বজনীন শহর হিসেবে আবির্ভূত হয়। বুড়িগঙ্গা সম্মুখীন নদী প্রবাহের কারণে এটি প্রাচ্যের ভেনিস নামেও অপরিচিত। দিল্লির পরে ঢাকা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে মুম্বাই এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর।
কেমন ছিল আমাদের প্রাচীন ঢাকা। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকার ইতিহাস আলোচনা করব আই নিউজের আজকের প্রতিবেদনে।
১৭ শতকের দিকে গোড়া পত্তন হয় ঢাকা নগরীর। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কিছু বসতি ছাড়া উত্তর দিকে মিরপুর, পল্টন, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা প্রভৃতি এলাকা ছিল বিশাল জঙ্গল। আর দক্ষিণের কামরাঙ্গীরচর ছিল বিশাল বাদাবন। এখন শুনলে হয়তো আমাদের অবিশ্বাস্য মনে হবে। এই এলাকাগুলোতে বাঘ, বিশাল অজগর সাপ, বন্য শুকর, বন্য বিড়াল, মেছো বিড়াল সহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগনা ছিল। ধারণা করা হয় কালের বিবর্তনে ঢাকা প্রথমে সমতট এবং পরবর্তীতে বঙ্গ এবং গৌর প্রভৃতি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে মুসলমানরা ঢাকা দখল করে নেয়। মুঘল যুগের পূর্বে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম শাসকেরা ঢাকার চারদিকে বিভিন্ন অবস্থানে তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব রাজধানী নগরীর কয়েকটি নিদর্শন এখনো বিক্রমপুর, ভাওয়াল ও সোনারগাঁওয়ে দেখা যায়।
ঢাকার নাম করণের ইতিহাস ; ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে যে সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণ কালে সন্নিহিত এক জঙ্গলে দেবী দুর্গার একটি মূর্তি খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ওই এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ বা মূর্তি গুপ্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তাই বল্লাল সেন সেই মন্দিরের নামকরণ করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকে কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।
আবার অন্য একদল ঐতিহাসিক এর মতে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে শোভা বাংলা রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করলেন তখন সুবেদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহরে ঢাক বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা থেকে এই শহরের নাম হয়ে যায় ঢাকা।
আবার অনেকে মনে করেন, এক সময়ে এই অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ ছিল। যার কারনে এর নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নাম হয় ঢাকা। এছাড়াও কেউ কেউ মনে করেন যে, এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকি হচ্ছে বর্তমানে ঢাকা। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান অনুযায়ী ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই ঢাকাকে শোভা বাংলা রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে সময়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে ঢাকার নাম হয় জাহাঙ্গীরনগর। সম্রাট জাহাঙ্গীর যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন ঢাকার এই নাম বজায় ছিল।
রাজধানী ঢাকার ইতিহাস ; পূর্বে সম্রাট আকবরের আমলে বাংলা বিহার উড়িষ্যার প্রাদেশিক রাজধানী ছিল বিহারের রাজমহল। শোভা বাংলায় তখন চলমান ছিল মোগল বিরোধী স্বাধীন বারো ভূঁইয়াদের রাজত্ব। বারো ভূঁইয়াদের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে ১৫৭৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বার বার চেষ্টা চালায় মোগলরা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসন আমলে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম খান চিশতিকে রাজমহলের সুবাদার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে রাজধানী বিহারের রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকা স্থাপন করেন। সুবাদার ইসলাম খানের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বারো ভূঁইয়াদের পতন ঘটে এবং বর্তমানে চট্টগ্রামের কিছু অংশ বাদে পুরো শোভা বাংলা মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা শোভা বাংলা রাজধানী হলেও বাংলার রাজধানী বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার সাহা সোজা রাজধানী আবার বিহারে স্থানান্তর করেছিলেন। সুবাদার সাহা সোজার পতন ঘটলে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার মীর জুমলা আবার ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর ঢাকার অধিনে রাজধানীর মর্যাদা থাকে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার মুর্শিদকুলি খাঁ আবার বাংলা রাজধানী মুর্শিদাবাদের স্থাপন করেন। তবে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার রাজধানী ছিল কলকাতা। বঙ্গভঙ্গের পর ১৯০৫ সালে ঢাকা কে আসাম ও বাংলা রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ঢাকায় শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাস ; সময়টা তখন ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের তত্ত্বাবধানে দুজন বিশিষ্ট শিক্ষক জেরিস ও পার্বতী চরণ চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় বিদ্যানোরাগীদের নিয়ে ৬০০০ টাকয় সরকারি সহায়তায় ঢাকার সদরঘাটের কাছে ইংলিশ ফ্যাক্টরি হাউজ এর পূর্ণ দোতলা বানিজ্য কুটির ভাড়া নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ঢাকা গভর্নমেন্ট স্কুল। এই স্কুলই ছিল গোটা উপমহাদেশের প্রথম কোন সরকারি ইংরেজি স্কুল। সে সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন জেরিস এবং পার্বতী চরম চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক। ১৮৪১ সালে এই স্কুল থেকে জন্ম হয় দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজের। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল পুরো ভারত উপমহাদেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে স্কুল শাখাটির নাম পাল্টে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল রাখা হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে জন্ম হয়েছিল বর্তমান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার মাটিতে শিক্ষা বিস্তারের এই বংশ পরম্পরা ছিল তখনকার বাংলায় শিক্ষা বিপ্লব।
হরেক নামের ঢাকার ইতিহাস ; ঢাকার বিভিন্ন অংশের নামকরণের পেছনে রয়েছে কিন্তু নানা ইতিহাস। তেমনি কয়েকটা নামের ইতিহাস আজ আমরা জানবো।
ইন্দিরা রোড ; এ এলাকায় এক কালে এক হিন্দু ভদ্রলোক নিজের একটি বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করেন। সঙ্গে নির্মাণ করেন অট্টালিকার গা ঘেসা এক সড়ক। তিনি তার মেয়ে ইন্দিরার নামে সড়কটির নামকরণ করেন। যা এখন ইন্দিরা রোড নামে পরিচিত।
পিলখানা ; বন্য হাতিদের পোষ মানানোর জায়গা কে মূলত পিলখানা বলা হয়। বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর অবস্থিত পিলখানার স্থানে ইংরেজ শাসনামলে ব্যবহৃত হাতিদের পোষ মানানো হতো। এই স্থানটি ছিল সেই সময় সর্ববৃহৎ পিলখানা।
এলিফ্যান্ট রোড ; পিলখানা থেকে হাতির বহরকে গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া হত বর্তমান হাতিরঝিল নামক স্থানে। যে রাস্তা দিয়ে হাতিগুলোকে নেওয়া হতো সেই রাস্তার নাম দেয়া হয়েছিল এলিফ্যান্ট রোড। হাতিরপুল;- পথের মাঝে ছোট একটি পুল ছিল। পুল শুনে বুঝতে পারছেন যে বর্তমান জায়গাটির নাম হাতিরপুল।
কাকরাইল ; ১৯ শতকের সেই দিকে ঢাকার কমিশনার ছিলেন মিস্টার ককরেল, শহরে নতুন এক এলাকা তৈরি করে কমিশনার ককরেল নামকরণ করলেন কাকরাইল।
রমনা পার্ক ; বিরাট ধনাত্মক ব্যক্তি ছিলেন রমনাথ বাবু। তিনি রমনা কালীমন্দির নামে বিশাল এক মন্দির তৈরি করেন। মন্দির সংলগ্ন ছিল বিশাল এক বাগান এবং সঙ্গে খেলাধুলার জায়গা। এভাবেই গড়ে ওঠে রোমানা পার্ক।
পল্টন ; ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক প্লাটুন সেনাবাহিনী ছিল এই স্থানে। প্লাটুন শব্দ থেকেই পরবর্তীতে পল্টন নামের আবির্ভাব। পরবর্তীতে এই পল্টনকে দুই ভাগে ভাগ করে নয়াপল্টন ও পুরানো পল্টন নাম দেওয়া হয়। নয়াপল্টন ছিল আবাসিক এলাকায় এবং পুরাতন পল্টন ছিল বাণিজ্যিক এলাকা।
ধানমন্ডি ; ধানমন্ডি এলাকায় একসময় হাট বসতো। যা বিখ্যাত ছিল ধান ও অন্যান্য শস্য বিক্রয়ের জন্য।
ফার্মগেট ; কৃষি উন্নয়ন, কৃষি ও পশু পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ঢাকা একটি ফার্ম বা খামার তৈরি করে। সেই ফার্মের প্রদান ফটোক বা গেট থেকে এ এলাকার নাম হয় ফার্মগেট।
ঢাকায় মসরিনের ইতিহাস ; ঢাকার নামের সাথে সাথে একটা সময় ভেসে আসতো মুসলিনের নাম। শোনা যায় ঢাকাইয়া মুসলিন এতটাই পাতলা ছিল এবং এর কারু কাজ এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে একটি মুসলিম শাড়ি ভাজ করে ছোট একটি ম্যাচের বাক্সে অনায়াসে ভরে রাখা যেত। ব্রিটিশরা ঢাকার মুসলিনকে তাদের দেশে নিয়ে যায় এবং তারা এখানকার মুসলিন কারিগরদের হাত কেটে দেয়। যেন তারা পুনরায় মুসলিন বানাতে না পারে।
ঢাক্কা থেকে ঢাকার ইতিহাস ; আজকে আমরা যেভাবে ঢাকা উচ্চারণ করি বা বই পত্রে লেখা দেখি তা কিন্তু এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি। ঢাকার জন্মের পর থেকে এর উচ্চারণ ঢাকা না হয়ে বরং ছিল ঢাক্কা। এমনকি ইংরেজি বানানেও লেখা ছিল (DACCA)। পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর। এরপর কেটে যায় ১১ বছর। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকার ঢাকার সরকারি নাম (DACCA) থেকে পরিবর্তন করে Dhaka ঢাকা রাখে। মাত্র ৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল বন জঙ্গল, জলা, তৃণভূমি সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী তখন বর্তমানে ঢাকার ব্যস্ত এলাকাগুলোতে আনাগোনা ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করেছে তার মৃত্যুর কফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে তার ভারসাম্য। চিকুনগুনিয়া,ডেঙ্গু তাই নিত্য ঘটনা। আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা নগরী আজ বাস অযোগ্য শহরের তালিকায় উপরে সারিতে স্থান নিয়েছে।
আই নিউজ/আর
- জার্মানিতে গাঁজা খাওয়ার চাকরি, বেতন ৮৮ লক্ষ টাকা!
- কিভাবে আসলো চায়ে দুধ মিশিয়ে ‘দুধ-চা’ বানানোর আইডিয়া?
- পাকিস্তান পুলিশের শীর্ষপদে প্রথম হিন্দু নারী মনীষা
- চিড়িয়াখানায় সিংহের থাবায় প্রাণ গেলো যুবকের
- সাপের দংশন ও চিকিৎসা
- বাস্তবে কি জলপরী আছে?
- বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ইতিহাস
- ওড়িশা (ODISHA)ভারতের অন্যতম রাজ্য
- বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি বঙ্গোপসাগরেই কেন?
- বিভিন্ন দেশের সূর্যগ্রহণ দেখুন ছবিতে