Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শুক্রবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ১২ ১৪৩২

ইমরান আল মামুন

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ৯ অক্টোবর ২০২৪

তিমি মাছের বমি কি কাজে লাগে

তিমির বমি বা অ্যাম্বারগ্রিস (Ambergris) হল এক ধরনের মূল্যবান এবং রহস্যময় উপাদান যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সুগন্ধি ও অন্যান্য বিলাসবহুল দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত তিমি মাছের অন্ত্র থেকে উৎপন্ন হয় এবং সাগরে ভাসতে ভাসতে এক সময় সৈকতে এসে জমা হয়। যদিও একে "বমি" বলা হয়, অ্যাম্বারগ্রিস প্রকৃতপক্ষে তিমির পাচনতন্ত্রের একটি ক্ষরণ যা পরবর্তীতে তিমির শরীর থেকে নির্গত হয়।

এই দুর্লভ এবং মূল্যবান উপাদানটি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রাজা-রাজড়াদের, ধনী মানুষদের এবং সুগন্ধি শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বিভিন্ন সভ্যতার লোকজন তিমির বমিকে বহুমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য করে আসছে এবং এটি নিয়ে নানা ধরনের কাহিনী, গবেষণা ও বিজ্ঞান রয়েছে।

অ্যাম্বারগ্রিস কীভাবে উৎপন্ন হয়?
অ্যাম্বারগ্রিস উৎপন্ন হয় স্পার্ম তিমি (Sperm Whale) থেকে, যা পৃথিবীর বৃহত্তম দাঁতবিশিষ্ট তিমি। এই তিমিরা গভীর সমুদ্রে বসবাস করে এবং প্রধানত স্কুইড বা বড় বড় সামুদ্রিক জীব আহার করে। স্কুইডের কিছু অংশ, যেমন তাদের বিট, তিমির হজম করতে পারে না। এ ধরনের অবশিষ্টাংশ তিমির অন্ত্রে জমা হয়, যা পরবর্তীতে একটি মোমজাতীয় পদার্থের আকার ধারণ করে এবং এটি তিমির শরীর থেকে নির্গত হয়।

একবার অ্যাম্বারগ্রিস সাগরে মুক্তি পেলে, এটি সাগরের পানিতে ভাসতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রের পানিতে থাকার ফলে অ্যাম্বারগ্রিস একটি শক্ত ও মসৃণ গঠনে রূপান্তরিত হয় এবং এর রং সাদা, ধূসর বা কালচে হতে পারে। অনেক সময় এটি বিভিন্ন ধরণের পাথরের মতো দেখায় এবং তীরে ভেসে আসে। সাগর তীরবর্তী লোকেরা অনেক সময় এগুলো সংগ্রহ করে এবং অত্যন্ত উচ্চমূল্যে বিক্রি করে থাকে।

অ্যাম্বারগ্রিসের ইতিহাস

অ্যাম্বারগ্রিসের ইতিহাস প্রায় হাজার বছর পুরনো। এটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে বিলাসবহুল সামগ্রী হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা এটিকে সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহার করত, এবং মধ্যযুগে ইউরোপের রাজদরবারে এটি ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক উপাদান।

অ্যাম্বারগ্রিসের ব্যবহার
অ্যাম্বারগ্রিস প্রধানত সুগন্ধি তৈরির শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি উচ্চমানের স্থায়িত্ব প্রদানকারী উপাদান হিসেবে সুগন্ধিকে দীর্ঘ সময় ধরে কার্যকর রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও, এর নিজস্ব একটি মিষ্টি, কাঠের মতো বা সামুদ্রিক গন্ধ রয়েছে যা সুগন্ধির গুণমান বৃদ্ধি করে। বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের সুগন্ধিতে অ্যাম্বারগ্রিস ব্যবহৃত হয়, যা তাদের সুগন্ধিকে অনন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।

এর পাশাপাশি, অতীতে এটি ওষুধে ব্যবহার করা হত। মধ্যযুগে অ্যাম্বারগ্রিসকে বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হত। অনেকে মনে করত এটি বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এছাড়াও, কিছু দেশে এটি খাদ্য প্রস্তুতিতেও ব্যবহার করা হতো, যেমন আরব দেশগুলোতে এটি বিভিন্ন মিষ্টি ও পানীয় তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

অ্যাম্বারগ্রিসের মূল্য
অ্যাম্বারগ্রিস একটি অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান, এবং এর মূল্য নির্ভর করে এর গুণমান, আকার এবং গন্ধের উপর। সাদা বা হালকা ধূসর অ্যাম্বারগ্রিসকে সবচেয়ে মূল্যবান ধরা হয়। উচ্চমানের অ্যাম্বারগ্রিস প্রতি কেজি লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হতে পারে। অনেক সময় সোনা বা রুপার থেকেও এর মূল্য বেশি হয়ে থাকে।

অ্যাম্বারগ্রিস এবং আইন
যদিও অ্যাম্বারগ্রিস প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয় এবং তিমির জন্য এটি ক্ষতিকর নয়, তবুও অনেক দেশে তিমি সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। কারণ স্পার্ম তিমি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত। কিছু দেশে অ্যাম্বারগ্রিস সংগ্রহ বা বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ, কারণ এতে তিমির প্রতি অন্যায় আচরণ বাড়তে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অ্যাম্বারগ্রিসের ব্যবসা এবং সংগ্রহের উপর কঠোর নিয়ম ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অন্যদিকে, ইউরোপের কিছু দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে এটি বৈধভাবে সংগ্রহ ও বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করা যায়।

অ্যাম্বারগ্রিসের বিকল্প
যেহেতু অ্যাম্বারগ্রিস সংগ্রহ করা এখন অনেক দেশে কঠিন হয়ে পড়েছে এবং এর মূল্য অত্যন্ত বেশি, তাই এর বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন কৃত্রিম উপাদান তৈরি করা হয়েছে। অনেক সুগন্ধি কোম্পানি কৃত্রিমভাবে অ্যাম্বারগ্রিসের গন্ধ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এই কৃত্রিম বিকল্পগুলো সস্তা, সহজলভ্য এবং তিমি সংরক্ষণের জন্যও নিরাপদ।

তবে, কৃত্রিম বিকল্পগুলো কখনও প্রকৃত অ্যাম্বারগ্রিসের মতো গুণমান এবং স্থায়িত্ব প্রদান করতে পারে না। তাই যারা প্রাকৃতিক এবং বিলাসবহুল সুগন্ধি পছন্দ করেন, তাদের জন্য অ্যাম্বারগ্রিস এখনও একটি আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে।

তিমির বমি বা অ্যাম্বারগ্রিস একটি অদ্ভুত, রহস্যময় এবং অমূল্য প্রাকৃতিক উপাদান যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানব সমাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি একটি প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হওয়া পদার্থ, যা তিমির অন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসে এবং সমুদ্রের পানিতে ভাসমান অবস্থায় থাকে। সারা বিশ্বে এর বিপুল চাহিদা থাকলেও এটি সংগ্রহ করা কঠিন এবং অনেক দেশে এর বিক্রি নিষিদ্ধ। তবুও সুগন্ধি শিল্পে এর গৌরব এখনও অক্ষুন্ন এবং বিলাসবহুল পণ্যের মধ্যে এটি একটি অন্যতম মূল্যবান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়