জসীম উদ্দীন মাসুদ
আপডেট: ১২:১৭, ১৮ নভেম্বর ২০২২
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : অপরূপ নৈসর্গিকতায় প্রাণের ছোঁয়া
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় | University of Chittagong | Eye News
বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে,
একটি শিশির বিন্দু।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর কীর্তিময় এই কবিতাটির মধ্যে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষকে আপন ভূখন্ডে অপূর্ব সৌন্দর্যে অবগাহনের জন্যে রয়েছে আকুল আবেদন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ভেতরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে গড়ে উঠা তেমনি এক পাহাড় ঘেরা মায়াবী ক্যাম্পাস, যা যে কোন মানুষের হৃদয় মনকে আন্দোলিত করবে নিমেষে। গাছের পর গাছ আর গাছ, সবুজের পর সবুজ আর সবুজ মানুষকে নিয়ে যাবে ভালোলাগা এক কাল্পনিক মোহমায়ায়।
মহান দার্শনিক রুশো বলেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় হবে শহর থেকে দূরে নির্জন কোনো এক জায়গায়, যেখানে থাকবে কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে প্রকৃতির কোলে আর প্রকৃতি হবে তাদের শিক্ষক।” চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে দূরে তেমনই এক পাহাড় ও সবুজেঘেরা মনমাতানো ক্যাম্পাস।
শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে দূরে প্রকৃতির কোলঘেষে নয়নাভিরাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এই ক্যাম্পাস এখন দেশের অঘোষিত অন্যতম এক পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। এখানে দিনে দিনে তাই বাড়ছে ভ্রমন পিপাসু মানুষের ঢল। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে মায়াঘেরা এই ক্যাম্পাসের অবস্থান।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি- এই চারটি বিভাগের ২০৪ জন শিক্ষার্থী, আটজন শিক্ষক ও ১৭৫৩ একর জায়গা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় তা আজ এক মহীরূহ আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট মতে, ২৩১২,৩২ একরের এ ক্যাম্পাসে রয়েছে ১০টি অনুষদ, ৫৪টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট ও ৬ টি গবেষণা কেন্দ্র। ৯ শত ৭ জন শিক্ষকের নিয়মিত পাঠদান ও তত্ত্বাবধানে ২৭ হাজার ৫ শত ৫০ জন শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়নরত। রয়েছেন ২০৪৬ জন নন্ একাডেমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এখানে রয়েছে ইনস্টিটিউট অব ফরেষ্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ও ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিশ, যা বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। এর রয়েছে একটি অধিভুক্ত অনুষদ- চিকিৎসা অনুষদ; দু’টি অধিভুক্ত ইনস্টিটিউট- ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অব থালমোলজি, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও ২১টি অধিভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আয়তনের দিক দিয়ে দেশের বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতির সব উপাদান যেন চিত্রশিল্পীর নিঁখুত তুলির আছড়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যে দিকে চোখ যায় তার রূপময় স্নিগ্ধতা যেন প্রকৃতির স্বর্গ হয়ে আবির্ভূত হয়। আজ থেকে ৫৬ বছর আগে ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে এটি দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেশ কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্য অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য সুউচ্চ এক স্বতন্ত্র স্থানে দাঁড় করিয়েছে।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
অপরূপ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ঘন পাহাড় আর সবুজের আচ্ছাদন যেন নীল আকাশ ছুঁয়ে যায়। পাহাড়, ঝরণা, লেক, আর স্বতন্ত্র জীববৈচিত্র্য এ ক্যাম্পাসকে করেছে অতুলনীয়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি জায়গা যেন এক একটি পর্যটন স্পট।
ফরেস্ট্রী ইনস্টিটিউটের সাজানো রাস্তা, রাস্তার দুপাশে গাছের সারি, পাশে লেক, অসাধারণ প্রশাসনিক ভবন হ্যালিপ্যাড সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে একরাশ মুগ্ধতা। ৬০ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বোটানিক্যাল গার্ডেন দর্শনার্থীদের জন্যে চমৎকার এক বাড়তি পাওনা। কলা অনুষদের পেছনে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রাকৃতিক ঝরনার শীতল পানি পর্যটন পিয়াসী মানুষকে বিমোহিত করে তুলে।
ষড়ঋতুর ক্যাম্পাস
ছয়টি ঋতুর এক আশ্চর্য লীলা নিকেতন এই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত — এ ছয়টি ঋতুর আবির্ভাবে নানা সাজে বিভিন্ন রঙে বিচিত্ররূপ ধারণ করে এখানকার চারপাশের প্রকৃতি। বাংলার ষড়ঋতুকে সত্যিকারভাবে উপভোগ করতে হলে দ্বিধাহীনভাবে ছুটে যেতে হবে এই ক্যাম্পাসে। প্রত্যেকটি ঋতুর যে অপূর্ব মেলবন্ধন তা লিখে বোঝানো যাবে না শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় এখানে।
অপরূপ নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রীষ্মের প্রখর তাপদাহের মাঝেও সুশীতল বাতাস, নানান ফলের সম্ভার, বর্ষায় আষাঢ়ের জলধারার চিরচেনা সবুজাভ প্রকৃতি, শরতের শেষ বেলায় সাদা মেঘের ভেলা আর শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা, শিশিরে ভেজা মাতাল হেমন্ত, শীতে সাদা কুয়াশার চাদর, নবপল্লবে সুশোভিত বসন্ত-ষড়ঋতুর এমন ছয় রঙে চবি ক্যাম্পাসে রঙিন হয়ে উঠার জন্যে বছরজুড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেন
কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন-
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
-কেউ যদি একবার শাটল ট্রেন চড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তবে তাকে বলতেই হবে- ‘ট্রেনের বাড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’। শাটল ট্রেন হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ ভোমরা। শাটল ট্রেন আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই আত্মা হয়ে আজন্মকাল ধরে মিশে একাকার হয়ে আছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে এই শাটল ট্রেন। শিক্ষার্থীদের জীবনের এ যেন এক অপরিহার্য অংশ।
চলন্ত শাটল ট্রেনের জানালায় চোখ রেখে দেখা যায়, মানুষের যাপিত জীবন, অনুভব করা যায় বাংলার অপরূপ প্রকৃতি। রেললাইনের পাশে থাকা শুভ্র কাশফুল এক মায়ার জাল তৈরি করে দেহমনে। শাটল ট্রেনকে ঘিরেই রচিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যতসব আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার কথকতা। চলন্ত এই ট্রেনেই তৈরি হয় জীবনের কত সোনালি স্মৃতি।
সংগীতের সাথে এই শাটল ট্রেনের আছে এক নিবিড় সম্পর্ক। গানের যেমন সুর-ছন্দ আছে তেমনি ট্রেনের গতিতে ছন্দ আছে, সুরও আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের এই ছন্দ আর সুর মুর্ত হয়ে উঠে শিক্ষার্থী যাত্রীদের হৃদয়ে, অন্তরে ও কন্ঠে। এ এক অন্যরকম আবেগের জায়গা।
শাটল ট্রেনকে ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠে প্রাত্যহিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। পুরো শাটল ট্রেন যেন একটি মঞ্চ আর সকল শিক্ষার্থী হয়ে উঠেন এ মঞ্চের শিল্পী। কারো মাঝে কোন রাখডাক নেই। কত যে নতুন নতুন গান রচিত হয় এই চলন্ত ট্রেনে তার ইয়ত্তা নেই। সেই গানে গলা ছেড়ে সুর ধরে তাবৎ চলন্ত শিল্পী। যন্ত্র শিল্পীদেরও অভাব নেই। শাটলের বগির দেয়াল হয়ে উঠে এক একটি ‘ড্রাম’। এ যেন অন্য এক পরিবেশ। শেষ স্টেশন না আসা পর্যন্ত এসব বগি-শিল্পীদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এসব বগি-শিল্পীদের অবহেলা করারও কোন জো নেই। কারণ এখান থেকেই তো নকীব খান, পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলসহ অনেক বগি-শিল্পী দেশের তারকা শিল্পীর জায়গা করে নিয়েছেন।
১৯৮১ সালের ১ মার্চ যে শাটল ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়েছিল, দ্বিগুণতর শক্তি ও মাধুর্য নিয়ে আজও তা ছুটেই চলেছে। চট্টগ্রামের বটতলী স্টেশন থেকে ক্যাম্পাস স্টেশন পর্যন্ত দিনে ১৮ বার যাতায়াত করে এটি। যাত্রাবিরতি করে ছয়টি স্টেশনে। ২২কিলোমিটার দূরত্বের ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে শাটলে সময় নেয় প্রায় এক ঘন্টা।
বিশ্বে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এমন শাটল ট্রেনের ব্যবহার করেছে, যার একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো ইউনিভার্সিটি আর দ্বিতীয়টি হলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কিছুদিন আগে সানফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শাটল ট্রেন সার্ভিস বন্ধ করে দেয়। তাই বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এককভাবে এর দাবিদার।
স্মৃতিময় এই ট্রেনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে নির্মাতা প্রদীপ ঘোষের পরিচালনায় ২০১৯ সালে নির্মিত হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শাটল ট্রেন’। এর অভিনয় শিল্পী ও পরিচালক সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কাটা পাহাড় সড়ক
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মূল গেইট দিয়ে ঢুকে গোল চত্বর পেরিয়ে দু'পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সোজা যে মসৃণ পিচঢালা পথটি চলে গেছে সেটাই কাটা পাহাড়ের গিরিপথ নামে পরিচিত। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সৌন্দর্যে ভরা এ যেন এক হিমেল ঠিকানা।
পাহাড়ের ভেতর মসৃণ পিচঢালা রাস্তা। এই সড়কের চোখজুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়ন ভরিয়ে দেবে। পাহাড়ের ঢালে অসাধারণ রূপ লাবণ্য অবলোকন করে মুহূর্তের মধ্যে আপনি হারিয়ে যাবেন সুন্দরের এক মায়াভরা রূপরাজ্যে। কাটা পাহাড় সড়ক একেক সময় সাজে একেক রূপে। বৃষ্টি ভেজা এই পথ অথবা রাতের নিয়ন আলোর কাটা পাহাড় সড়ক পথিকের কাছে আলাদা এক সৌন্দর্যে ধরা পড়ে। সাঝের বেলায় পাহাড়ের ঢালে সবুজের সমারোহ হাতছানি দিয়ে ডাকে।
কাটা পাহাড় জুড়ে বানরের রাজত্ব । রাস্তার দু’পাশের ড্রেনে ২৫০ প্রজাতির ব্যাঙের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। মাঝে মাঝে রঙ-বেরঙের সাপের দেখা মেলে। খুব ভোরে মায়া হরিণের পদচারণায় কাটা পাহাড় ঘুম থেকে জেগে উঠে। সন্ধ্যা হতেই এতে বিচরণ করতে শুরু করে বিভিন্ন বণ্যপ্রাণী। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। দ্বিধাহীনভাবে রাস্তা পেরিয়ে চলে যায় বুনো শুয়োরের দল। সকালে দেখা মিলে মায়া হরিণের ঘাস খাওয়া কিংবা ছুটে চলার বিরল দৃশ্য। একটু ধের্য ধরলে পাহাড়ের চূড়ায় হরিণ আর কাঠ বিড়ালীর দৌড়াদৌড়ি দেখে আপনাকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হবে।
প্রেম-বিরহ, বন্ধুত্ব, আন্দোলন-সংগ্রাম, হাসি-কান্না, একাকিত্ব সময় কিংবা প্রেমিকযুগলের হাতের উষ্ণ ছোঁয়া, কয়েক যুগ ধরে এমন বিচিত্র সব ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে সড়কটি। কখনও মিছিলের স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে এর মসৃণ বুক, কখনওবা অপরিসীম ভালোবাসার স্পর্শে শীতল হয়েছে।
দিনের আলো ফোটতেই শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হতে থাকে সড়কটি। শিক্ষার্থীরা ট্রেন বা বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে বা সিএনজি-রিকশাযোগে ছুটে যায় ক্লাসে। শিক্ষার্থীরা যখন পায়ে হেঁটে চলা শুরু করে তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ যেন শিক্ষার্থীদের প্রাণের সড়ক। বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা, গান, শ্যুটিং, জম্মদিন পালনসহ সবকিছুর জন্য এ যেন এক আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে। গভীর রাতেও তাই কাটা পাহাড় থেকে ভেসে আসে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত কণ্ঠে গানের সুর।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যকর্মে বাঙালির বিজয়গাঁথা ইতিহাস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর নজরকাড়া সব স্থাপত্যকর্ম। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এসব শিল্পকর্ম সবাইকে বিমোহিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের গৌরবমাখা ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ভাস্কর্যে বাঙালির বিজয়গাথা ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রচেষ্টায় স্থাপন করা হয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য। একই বছর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর নকশায় নির্মিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ২০০৯ সালে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ 'স্মরণ' এর স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধানিবেদনের জন্য কলাভবনের সামনে নির্মাণ করা হয় স্বাধীনতা স্মারক ভাস্কর্য। দেশের একমাত্র স্টীলের তৈরি এ ভাস্কর্যটির স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালযয়ের সাবেক অধ্যাপক প্রখ্যাত শিল্পী মর্তুজা বশীর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরের মধ্যবর্তী চৌরাস্তার মধ্যখানে ‘জয় বাংলা’ ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। লাইভ কাস্টিং মেথডে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি, যা বাংলাদেশে প্রথম। ধূসর রঙের আস্তরণে মার্বেল ডাস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে রোদ বৃষ্টিতেও ভাস্কর্য মলিন হবে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে ২০১৮ সালে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহান। তাঁর সহযোগী ছিলেন মুজাহিদুর রহমান মুসা, জয়াশীষ আচার্য ও তপন ঘোষ। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ ও সমান অংশগ্রহণের বিষয়টি যেমন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের ভূমিকা ও উপজাতি এক নারীর অবয়ব উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথেই সাত মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবিদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ ভবন সম্মুখস্ত এ স্মৃতিস্তম্ভের ডিজাইনার চবি চারুকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও একুশে পদক বিজয়ী প্রখ্যাত তাপিশ্রী শিল্পী রশীদ চৌধুরী।
ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চবি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। কাটা পাহাড় রাস্তার মাথায় নির্মিত চবির প্রথম শহীদ মিনারটি ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হলে একইস্থানে বর্তমান শহীদ মিনারটি ১৯৯৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরী এ শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের নকশা করেন ‘অপরাজেয় বাংলা’র স্থপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। প্রায় দশ শতক জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গৌরবের অন্যতম নিদর্শনটি।
মুক্তিযুদ্ধে চবির সূর্যসন্তানেরা
মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রায় দুইশতাধিক ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে যখন উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তখনও চবি ক্যাম্পাসের শক্ত ঘাঁটিতে বহাল তবিয়তে ছিল পাকিস্তানিরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হানাদার মুক্ত করতে বিজয়ের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেদের।
মুক্তিযদ্ধে শহীদ হন ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সহ সর্বমোট ১৫ জন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী শহীদ মোহাম্মদ হোসেনকে দেওয়া হয় বীরপ্রতীক খেতাব। চাকসুর প্রথম জিএস এবং ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আব্দুর রব, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, উপ সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ-উদ-দৌলা, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আলাওল হলের প্রহরী সৈয়দ আহমদ, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, বাংলা বিভাগের ছাত্র মুহাম্মদ হোসেন, মোস্তফা কামাল ও মনিরুল ইসলাম খোকা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় এ স্বাধীনতার জন্য।
সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য
জীববৈচিত্র্যের অপার সম্ভাবনাময় এক প্রাকৃতিক আধার হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য মতে, এখানে বসবাস করছে ৩০৮ প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। এর মধ্যে পাখি রয়েছে ২১৫ প্রজাতির। ব্যাঙ রয়েছে ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ রয়েছে ৫৬ প্রজাতির ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির।
ক্যাম্পাসের অসংখ্য গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপঝাড় যেন বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম। এই অপরূপ জীববৈচিত্র্যের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণীরা যেভাবে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায় সেটা বিশ্বের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। বন্যশূকর, সজারু, বনরুই, মায়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর দেখা মেলে। ক্যাম্পাসে হাঁটলে বিরল প্রজাতির গিরগিটি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী চোখে পড়ে।
ক্যাম্পাস যেন পাখির রাজ্য। বন মোরগ, মথুরা, সবুজ তাউরা, কাঠ শালিক, রেড হেডেড, ভীমরাজ, হাঁড়িচাচা, কানাকোয়া, কাবাসি, চন্দনা টিয়া, মদন টিয়া, কানাকুয়া, শিষধামা, হলদে বক, মালকোহা, পাকড়া মাছরাঙা, বসন্ত বাউরি, রুপাস নেকড, বেনেবউ এবং মৌটুসীসহ ২১৫ প্রজাতির পাখি রাজত্ব করে এই ক্যাম্পাসে। ২১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০৮টি গায়ক ও ১০৭টি অগায়ক পাখি। এগুলোর মধ্যে আবার ১৬০টি প্রজাতির পাখির স্থায়ী নিবাস ক্যাম্পাসেই। ৫১টি অতিথি পাখি হিসেবে বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসে আসে, আবার চলে যায়। চার প্রজাতির পাখি মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে প্রাণীর আরেক অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ২০ প্রজাতির বেশি প্রাণী এই ক্যাম্পাসের বাসিন্দা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য বিরল প্রজাতির গাছ-গাছালি আর জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজের হাতছানি। পাহাড়ের ওপর ফুল, ফল আর কাঠ জাতীয় গাছের শোভা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে পাহাড় ও পাহাড়ি বন আছে ২৫০ একর জায়গায়। ৬০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সৃজিত বন। ১৫০ একর ভূমির মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ উদ্যান। লেক রয়েছে ২৫টি। বড় পুকুর রয়েছে ৫টি। সবুজ পাহাড়ের বুকে আছে ঝরনা ও ছড়া।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার
বৃহত্তর চট্টগ্রামে অন্যতম সেরা লাইব্রেরী হিসেবে স্বীকৃত চবি সেন্ট্রাল লাইব্রেরী। দেশী-বিদেশী দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ বই, সাময়িকী, পত্র-পত্রিকা, রেফারেন্স ও পান্ডুলিপির অনন্য সংগ্রহ রয়েছে এ লাইব্রেরীতে। মাত্র ৩০০ বই দিয়ে শুরু হয়েছিল যে লাইব্রেরির আজ সেই লাইব্রেরী প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার দেশী-বিদেশী বই ও ৪০ হাজার ই-বুকস দিয়ে এ অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এ গ্রন্থাগারের সংগৃহীত পাঠ-সামগ্রীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আছে, প্রধান সংগ্রহ, জার্নাল সংগ্রহ, রেফারেন্স সংগ্রহ, চবি প্রশাসন থিসিস, দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ। জার্নাল শাখায় দেশি-বিদেশি প্রকাশিত সাময়িকী। পুরনো সংখ্যাগুলো বাঁধাই করে ডিডিপি পদ্ধতি অনুসরণ করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রেফারেন্স শাখায় রয়েছে গবেষণা রিপোর্ট, বিশ্বকোষ অভিধান, হ্যান্ডবুক, ম্যানুয়েল, পঞ্জিকা, এনজিও প্রকাশনা, আইএলও ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, ইউনিসেফ বিবিএস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা।
গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য ও পাণ্ডুলিপি শাখায় এমন কতগুলো সংগ্রহ আছে যেগুলো প্রাচীন ভুজপত্র, তানপত্র, তুনট কাগজে লেখা। এই শাখায় রয়েছে গবেষকদের গবেষণাকর্মের উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, দুর্লভ বই, দলিল। দুষ্প্রাপ্য শাখায় এমন কিছু সংগ্রহ আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো গ্রন্থাগারে নেই। এখানে ১৮৭২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রকাশিত পুরনো সাময়িকী আছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অঞ্জলি, অনুসন্ধান পূর্ব পাকিস্তান, অগ্রগতি, সীমান্ত, পূরবী, পাঞ্জজন সাধনা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, প্রবাসী ভাণ্ডার প্রতিভা, প্রকৃতি, ঢাকা রিভিউ, পূর্ণিমা ছায়াবীথি, বার্তাবহ, সাপ্তাহিক এডুকেশন গেজেট, আলো ইসলাম প্রচারক, আল-ইসলাম, ভারতী মার্যাব্রু ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ জাদুঘর আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পশ্চিম পার্শ্বে দুইতলা বিশিষ্ট জাদুঘরটির ওপরের তলায় রয়েছে প্রদর্শনীর জন্য পাঁচটি গ্যালারি। আর নিচতলায় আছে অফিস, জাদুঘর গ্রন্থাগার এবং গবেষণাগার। গ্যালারিগুলো পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভাগ করা হয়েছে, এগুলো হলো- প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাগৈতাসিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি, সমকালীন চিত্রকলা গ্যালারি।
প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাগৈতাসিক গ্যালারিতে রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো টেরাকোটা (পোড়ামাটির ফলক), পোড়ামাটির মুদ্রা, মাটির মূর্তি, ষষ্ঠ শতকের মাটির মূর্তি। এছাড়া রয়েছে বাঙলার প্রাগৈতাহাসিক কালের জীবনযাত্রার ছবিসহ আরও কিছু দুর্লভ নিদর্শন। ভাস্কর্য গ্যালারিতে রয়েছে কষ্ঠিপাথরের মূর্তি (প্রায় ৩০টি), রয়েছে বিষ্ণু, সুরিয়া, শিবলিঙ্গ, হিন্দু-বৌদ্ধদেবীদের মূর্তি ইত্যাদি। ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারি সাজানো হয়েছে মোঘল আমলের কামান, প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো হস্ত লিখিত কোরআন শরিফ, মধ্যযুগের যুদ্ধাস্ত্র, পুঁথি, মোঘল আমলের মুদ্রা, ক্যালিগ্রাফি (আরবীয় লিপিকলা), বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদের ছবি, মসজিদে ব্যবহৃত পোড়ামাটির ইট প্রভৃতি দিয়ে। লোকশিল্প গ্যালারিতে রয়েছে ১৯ শতকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন- পালকি, তাঁতযন্ত্র, চরকা, পাটি, পাখা, বদনা, হুক্কা, মেলাতে পাওয়া যেত এমন মুখোশ, তীর ধনুক, কলের গান প্রভৃতি।
সমকালীন চিত্রকলা গ্যালারি রাঙানো হয়েছে দেশের বরেণ্য চিত্র শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়ে সৃষ্ট সমকালীন তৈলচিত্র দিয়ে। বরেণ্য এ শিল্পীদের মধে আছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, পটুয়া কামরুল হাসান, মুর্তজা বশীর, একুশে পদক প্রাপ্ত অধ্যাপক মনসুরুল করিম, নিতুন কুন্ডু, শাহ মো. আনসার আলী, অধ্যাপক সাইফুল কবীর, নাসিম বানু, জাহীদ আলী চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া আব্দুলাহ খালিদের একটি মাটির ভাস্কর্য রয়েছে এ গ্যালারিতে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রালগ্নে প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান প্রফেসর ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এই মানুষটি পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা সচিব, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত, দেশের প্রথম টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কথাসাহিত্যিক, কবি ও কলামিস্ট এবং প্রথম নারী উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার। ১৯৬৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে যে জনসভা হয়েছিল, তাতে শিরীণ আখতার বক্তব্য রেখেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। সমাজ ও নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য সরকার তাকে ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত করে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
জ্ঞানসৃজন ও উদ্ভাবনের বহুমাত্রিক ক্ষেত্র হিসেবে উচ্চ শিক্ষাদানের বিস্তৃত এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা মেধাবীদের স্পর্শে আলোকিত হয়েছে এবং হচ্ছে দেশ-বিদেশের অজস্র প্রাঙ্গণ। অর্জনেও পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ ৫6 বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করেছে অনেক রথী-মহারথীর।
বিশ্বখ্যাত ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ইমিরেটাস জামাল নজরুল ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসহ অনেকের সান্নিধ্যে ছিলেন। জামাল নজরুলের অনেক গ্রন্থ আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিশ্বের খ্যাতনামা বেশকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেও তাঁর গ্রন্থগুলো পাঠ্যক্রম হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। দেশের একমাত্র নোবেল জয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর হাতে গড়া গ্রামীণ ব্যাংক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রাম থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল।
জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলি আহসান, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, নাট্যকার, গবেষক আলাউদ্দিন আল আজাদ, শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল, কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আযাদ, একুশে পদক বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম, একুশে পদকজয়ী পদার্থবিদ অধ্যাপক বিকিরণ প্রাসাদ বড়ুয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। উপমহাদেশের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল করিম যার নামে কলা অনুষদের নামকরণ করা হয়েছে তিনিও এখানকার শিক্ষক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষক বিভিন্ন সময়ে একুশে পদক পেয়েছেন।
গবেষক ও বিজ্ঞানী হিসেবে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের কয়েকজন হলেন- ড. মো. শাহাদাত হোসেন ( দুটি নতুন মাছের প্রজাতি শনাক্ত করেন), মানজুর কিবরিয়া (প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী রক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য দেশি বিদেশি সম্মাননা পান), সাজীব আলি হাওলাদার, সবচেয়ে কম বয়সে ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বিশ্বস্বীকৃতি পান বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক শিক্ষার্থী, এমএ আজিজ খান, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী সত্যজিৎ কুমার ভদ্র ও মোস্তফা কামাল পাশা , প্রাণী বিজ্ঞানী প্রফেসর ড.মোহাম্মদ আলী আজাদী, ড. শেখ আফতাব উদ্দিন (কম খরচে সমুদ্র পানি সুপেয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার), ড. আল আমিন (যার লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বুক হিসেবে নির্বাচিত), অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী (বঙ্গোপসাগর নিয়ে মানচিত্র তৈরি) প্রমুখ।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা সরকার ও প্রশাসনে যারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ফজলে কবির, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা , বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ এবং ২১-তম প্রধান বিচারপতি আজিজ আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান, জেনারেল আবুল হোসেন, বিজিবি প্রধান, আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, ফণিভূষণ চৌধুরী, সাবেক সচিব, পুলিশ সমন্বয়ক, পিএসসি সদস্য, চৌধুরী মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন, মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।, বিচারপতি ঈমান আলী- আপিল বিভাগ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী- আপিল বিভাগ, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, হাইকোর্ট বিভাগ, বিচারপতি বোরহানউদ্দিন, হাইকোর্ট বিভাগ, আনিসুল হক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, নির্বাচন কমিশনার, মোহাম্মদ মুনির চৌধুরী, আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, শফিউল আলম , মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আহমদ কায়কাউস, মুখ্য সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক, রাজিয়া বেগম, বাংলাদেশের প্রথম নারী জেলা প্রশাসক প্রমুখ।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের কয়েকজন হলেন- সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ, ভাস্কর, অপরাজেয় বাংলার নির্মাতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মোমেন, কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা, কবি, গবেষক, অধ্যাপক ময়ুখ চৌধুরী শিক্ষাবিদ, কবি এবং লেখক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর উত্তম সেন, একুশে পদক প্রাপ্ত চিত্রশিল্পী মুনসুর উল করীম, সমাজবিজ্ঞানী, লেখক এবং দার্শনিক অনুপম সেন, সংগীত শিল্পী ও নজরুল গবেষক সুজিত মোস্তফা, সংগীত শিল্পী পার্থ বড়ুয়া, নকীব খান, বাপ্পা মজুমদার, এস. আই টুটুল, সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, অভিনয় শিল্পী মাসুদ আজিজ, চিত্রলেখা গুহ, ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর, হাসান মাসুদ, জিয়াউল হাসান কিসলু প্রমুখ। প্রয়াত শিল্পী রশিদ হোসেন চৌধুরী (রশিদ চৌধুরী), প্রয়াত নাট্যকার জিয়া হায়দার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান
এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোবেলজয়ী তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামকে ১৯৮১ সালে সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স, একুশে পদক বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামকে ২০০৮ সালে ডক্টর অব সায়েন্স এবং ২০১৮ সালে ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ডক্টর অব লেটার্স উপাধি দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৬ টি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে- জামাল নজরুল ইসলাম গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, নজরুল গবেষণা কেন্দ্র, ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চ, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিস। দেশের একমাত্র প্রস্তাবিত হাইটেক পার্ক স্থাপিত হতে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়াও ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ২১১টি এবং ১৯৭৩ সাল থেকে থেকে অদ্যাবধি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত মোট প্রকাশনায় গবেষণাপত্রের সংখ্যা ২ হাজার ১৭৮টি। চবি গবেষকরা সম্প্রতি করোনার জিন বিন্যাস উন্মোচন করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কোভিড-১৯ এর জিনের বিন্যাস উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রহস্যঘেরা চালন্দা গিরিপথ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক রহস্যময় সৌন্দর্য চালন্দা গিরিপথ। প্রাকৃতিক ঝরনা, পাহাড়ের প্রাণজুড়ানো রূপে বহুদিন ঢাকা পড়েছিল চালন্দা গিরিপথের সৌন্দর্য। কলা অনুষদের ঝুপড়ির ছড়ার পানি দিয়ে অর্ধঘন্টা পশ্চিমে হাঁটার পর ছড়ার বামে বা দক্ষিণে এই রহস্যময় মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সেখানে হাঁটু পরিমাণ পানি আছে কিছু কিছু জায়গায়। পাহাড়ের বিশুদ্ধ পানি সমৃদ্ধ এ গিরিপথ ধরে এগুতে থাকলে দেখা যাবে সেখানে পাহাড়ের আদা-সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে চালন্দা গিরিপথ হয়ে উঠেছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আকর্ষণীয় ঝুপড়ি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ এর ছোট ছোট খাবারের দোকানগুলো। এগুলো ঝুপড়ি নামে পরিচিত। বিভিন্ন অনুষদকে কেন্দ্র করে ঝুপড়িগুলো গড়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে খ্যাতি পেয়েছে কলা অনুষদের ঝুপড়ি। কী নেই সেখানে? চায়ের কাপে রাজনীতির ঝড়, টেবিল চাপড়িয়ে বেসুরো গলায় কোরাস গান, পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নোট আদান-প্রদান। এরই মধ্যে চলে প্রেমিক জুটির মন দেওয়া-নেওয়া, অপলক চেয়ে থাকা। আরও কত কী?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুলন্ত সেতু
চবির বিভিন্ন আকর্ষণীয় জায়গার মধ্যে ঝুলন্ত সেতু অন্যতম। বাংলাদেশে একমাত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুলন্ত সেতুর মতো কোন স্থাপনা আছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও বুদ্ধিজীবী চত্ত্বর থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে ড. ইউনূস ভবনের পাশে। ড. ইউনূস ভবনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট খাল। আর এই খালের উপর দিয়েই নির্মিত হয়েছে ঝুলন্ত সেতুটি। মূল সেতুটি ১০টি বড় স্প্যানের সাথে টাঙ্গানো এবং উপর দিকে টানা তারে ঝুলানো। এটির দৈর্ঘে প্রায় ২৫ মিটার এবং প্রস্থে প্রায় তিন মিটার। এখানে দাঁড়ালে মনে হবে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক কিংবা নিউইয়র্কের সেই ঝুলন্ত সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ চাকসু ভবনের তিনতলায় সাংবাদিক সমিতির অবস্থান। ১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর এর যাত্রা শুরু হয়। নিয়মানুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ পদাধিকারবলে সংগঠনটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। চবি সাংবাদিক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অনুমোদিত একটি সংগঠন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের কাছেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার অবস্থিত। এটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের এবং প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা গ্রহণের জন্য কাজ করে থাকে। পাশাপাশি এখানে শিক্ষক ও কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। এই মেডিকেল সেন্টারে সপ্তাহের প্রতিদিন সার্বক্ষণিক সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে চিকিৎসকগণ পালা করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন। এই সেন্টারে ১১ জন চিকিৎসক ও ৪টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এছাড়াও মেডিকেল সেন্টার প্রাঙ্গণে ৬টি অস্থায়ী বিছানার ব্যবস্থা রয়েছে।
চাকসু নির্বাচন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৬ বছরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন হয়েছে মাত্র ছয় বার। প্রথম চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭০ সালে। প্রথম ভিপি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও জিএস আবদুর রব। সর্বশেষ চাকসু নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তখন ভিপি নির্বাচিত হন নাজিম উদ্দিন, জিএস নির্বাচিত হন আজিম উদ্দিন ও এজিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর রহমান শামিম। ওই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২৭ জন। বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাকসুর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার পর ২৮ বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত হয়নি চাকসু নির্বাচন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন
৫৬ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পর ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম সমাবর্তন হয় চবিতে। পরে ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় এবং ২০০৮ সালে তৃতীয় সমাবর্তন হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ সমাবর্তন। অবশ্য ১৯৮১ সালে একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে অর্ধশতাধিক বাস এবং মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১০ বগি বিশিষ্ট দুইটি শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে যাতায়াত করে থাকে। বর্তমানে ট্রেন দুইটি দৈনিক সাতবার বটতলি রেলওয়ে স্টেশন ও ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে পুনরায় বটতলি ও ষোলশহর স্টেশন পর্যন্ত নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী যাতায়াত করে। শাটল ট্রেনের পাশাপাশি রয়েছে ডেমু ট্রেনের ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাফেটেরিয়া
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। একটি চাকসু ভবনের নিচ তলায় আরেকটা আইটি ফ্যাকাল্টিতে। সারাদিন ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলে ব্যস্ত থাকে ক্যাফেটেরিয়াগুলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হল জীবনের স্বপ্নসুখ
শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল। ৯টি ছাত্রদের ও ৫টি ছাত্রীদের। আর সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ২টি ছাত্রাবাস। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের বাদশা মিয়া সড়কস্থ চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী এসব হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিভিন্ন বাসা ও কটেজে থাকছে প্রায় ৬ হাজার শিক্ষার্থী। বাকি সিংহ ভাগ শিক্ষার্থী শহরের বিভিন্ন বাসা ও মেসে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে হল জীবনের মজাই আলাদা।
সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা জায়গা থেকে এসে হলজীবনে সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নিত্যদিনের আড্ডা, মজার অনুভুতিগুলো বন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করা, রাত জেগে পড়াশোনা, নানাবিধ প্রাপ্তি ও সংকট, রুমমেট অসুস্থ হয়ে পড়লে নির্ঘুম রাত জেগে সেবা করা সবই উপভোগ্য হয়ে উঠে হলগুলোতে। সুখ-দুঃখের হাজারো আবেগ ও অনুভুতি নিয়ে কাটে প্রাত্যহিক জীবন। হল জীবন শেষে তাই সবারই মনে হয়- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি যায়-যায় হারিয়ে যায়, উজ্জ্বল ও বর্ণালী দিনগুলি হায় মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই। সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য, আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাবো, তারপর শুধু রুক্ষ কঠিন পাহাড়। একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুল পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা।- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাঁকে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যেতে বলতাম। একই অঙ্গে আস্বাদিত হয়ে পাহাড় কেনার কথা ভুলে গিয়ে তিনি শুধু বিমোহিত হয়ে অপরূপ নৈসর্গিতার প্রিয় ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য অবগাহন করতেন।
ভালো থাকুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ‘উচ্চ শিক্ষায় বিশ্বমানে পৌঁছানোর জন্যে সৃজনশীল প্রচেষ্টা’- এই ভিশনকে সামনে রেখে এগিয়ে যাক আরও বহুদূর।
জসীম উদ্দীন মাসুদ, লেখক ও গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
- মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল ২০২৩
- এসএসসি বোর্ড চ্যালেঞ্জ এর রেজাল্ট ২০২৩
- এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩ | এসএসসি ফলাফল
- অনার্স ১ম বর্ষ পরীক্ষা রুটিন ২০২৩
- এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩ কবে হবে
- চবি ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩
- ‘বাঁচতে চাইলে পরীক্ষায় এ্যাটেন্ড কর’, ছাত্রীকে শাবি শিক্ষক
- ওসমানী মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আন্দোলনে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা
- স্বপ্ন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হওয়া
টিউশনী করে পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেল সরকারি কলেজের সুমাইয়া - গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩