সুফি হৃদয়
আপডেট: ২০:৩৫, ১১ মে ২০২৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | Dhaka University | Eye News
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (Dhaka University) হচ্ছে এই পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাকার্য আরম্ভ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে পূর্ববঙ্গে একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ সৃষ্টি করা। পরবর্তীতে এই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজ পূর্ববঙ্গের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয়। বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের সময়কাল থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ শুরু হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তারই ফসল।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
পূর্ব বঙ্গের তৎকালীন মুসলিম সমাজের অবস্থাঃ আহমদ ছফা "বাঙালি মুসলমানের মন" বইটিতে খুব সুন্দর ভাবে এই বাঙালি জনগোষ্ঠীর অতীত, বর্তমান নিয়ে আলোচনা করেছেন। উনার আলোচনার সারমর্ম হলো, আর্যরা অর্থাৎ ব্রাহ্মণগণ হিন্দুস্তানে বর্ণাশ্রম প্রথা সাথে নিয়ে এসেছিল। বাংলাতে আর্যদের আগমনের পর এখানকার আদিবাসীদের নিচু জাতে পরিণত করে ফেলে। মানুষ মাত্রই শক্তির পূজারী। তাই এই অঞ্চলের আদিবাসীরা ব্রাহ্মণ রাজাদের ধর্ম গ্রহণ করা শুরু করে। একসময় তারা নিজেদেরকে হিন্দু বলে দাবি করে। বঙ্কিমচন্দ্রও এটাই বলেছেন। কিন্তু হিন্দু হওয়ার পরও সমাজে প্রতিটি পদে পদে তারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হতো।
এই বর্ণ প্রথার বিরোধিতা করে নাস্তিক উপাধি নিয়ে বাংলার লোকজন একসময় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে আবার যেন হিন্দু বর্ণপ্রথা নবজীবন পেল। বৌদ্ধরা প্রাণভয় দেশ ত্যাগ করলো। মুসলিম শাসকরা এসে আগুনে একটু জল ঢাললো। তবে কয়লা যে এখনো জ্বলছে। মুসলিম শাসকদের দরবারেও ওই ব্রাহ্মণ হিন্দুরাই চাকরি পেলো। আর যত নিচু বর্ণের হিন্দু ছিল তারা শাসকের ধর্মে ধর্মান্তরিত হলো মানে মুসলিম হলো। তারা শুধু এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিল যে, তারাও মুসলিম। দেশের শাসকেরাও মুসলিম। কিন্তু তাদের আর ভাগ্য পরিবর্তন হলো না। মোটকথা এই বাংলার জনগণ প্রাচীন থেকে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, শোষিত। কখনো আর্য শোষণ, কখনো ব্রিটিশ শোষণ।
বাংলা যখন ব্রিটিশদের অধিকারে আসে, তখন হিন্দুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার করে। বঙ্কিমচন্দ্রের "আনন্দমঠ" উপন্যাসের একটি লাইন এখানে উল্লেখ্য করেছি যা পড়লে বোঝা যাবে হিন্দুরা কতটা ব্রিটিশদের অনুগ্রাহী ছিল।
"ইংরেজ যে ভারতবর্ষের উদ্ধার সাধনের জন্য আসিয়াছিল, সন্তানেরা তাহা বুঝে নাই। কি প্রকারে বুঝবে? কাপ্তেন টমাসের সমসাময়িক ইংরেজরাও তাহা জানিতেন না। কেবল বিধাতার মনে মনেই এ কথা ছিল।"
ইংরেজরা বাংলা দখলের পর এখানে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। এটাই বাংলার প্রথম কলেজ। এখানে শুধু ইংরেজদের শিক্ষাদান চলত। তারা দেশীয় ভাষা ও ইতিহাস গ্রহণ করত।
১৮১৭ সালে এখানকার ধনী হিন্দুগণ একটি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে শুধুমাত্র হিন্দুদের ভর্তি চলত। শুধু হিন্দু হলেই চলবে না। হিন্দুদের মধ্যে উঁচু জাতের হতে হবে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এখানে ভর্তি হতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে এখানে আর ভর্তি হতে পারেনি। পরবর্তীতে ইংরেজদের চাপে খ্রিস্টান ছাত্র ভর্তি শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে এটার নাম প্রেসিডেন্সি কলেজ রাখা হয় এবং তখন থেকে মুসলিম ছাত্ররা ভর্তি হতে শুরু করে। তৎকালে বছরে মাত্র চার-পাঁচ জন মুসলিম ছাত্র ইন্টার পাশ করত। কেননা মুসলিমদের মাঝে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা নিয়ে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। মুসলিমরা মনে করত তাদের স্বাধীনতা হরণ করেছে ব্রিটিশরা। তাই ব্রিটিশদের শিক্ষাও গ্রহণ করা ঠিক না। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং মাদ্রাসা ছাত্রদের লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরাটাও ছিল ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। কেননা যারা ব্রিটিশদের শিক্ষা গ্রহণ করত তারা ব্রিটিশদের সংস্কৃতিও গ্রহণ করতো। যেমন শার্ট-প্যান্ট, কোট-টাই পরিধান করা।
খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ সাহেবের জীবনী পর্যালোচনা করলে অনেক বিষয়ে আমাদের সামনে আসে। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করেছেন। পূর্ববঙ্গে অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা তৈরি করেছেন। পারবি না কার্যক্রমের মধ্যে কয়েকটি কার্যক্রম এখানে উল্লেখ্য করছি।
• তৎকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লিখতে হতো। অনেকের ধারণা বিদ্যমান সাম্প্রদায়িকতার ফলে হিন্দু ও মুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব হত। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা- এর চেষ্টায় প্রথমে অনার্স ও এম.এ পরীক্ষার খাতায় নামের পরিবর্তে ক্রমিক নং লেখার রীতি প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে এই.এ এবং বি.এ পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি রহিত হয়।
• সেই সময় হাই স্কুল ও Intermediate মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছাত্ররা কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেত না। উক্ত মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়ন করেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা। ফলে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা ছাত্রদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
• সেই আমলে সব স্কুল, কলেজগুলোত তিনি মৌলবির পদ সৃষ্টি করেন এবং পণ্ডিত ও মৌলবির বেতনের বৈষম্য রহিত করেন।
উপরে বর্ণিত তথ্যগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় তৎকালে মুসলিম সমাজ কতটা পিছিয়ে ছিল। কতটা বঞ্চিত ছিল।
বঙ্গভঙ্গঃ এরপর ১৯০৫ সালের অক্টোবর ১৬ বঙ্গভঙ্গ হয়। তখন ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন ‘পূর্ব বাংলা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার সবচেয়ে উন্নতি ঘটে। অনেক কর্মসংস্থান হয়। পূর্ববঙ্গের সাধারণ মুসলিমদের মনে আশার আলো জাগতে শুরু করে। এটা যে শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই উপকার বয়ে এনেছিল তা কিন্তু নয়। পূর্ববঙ্গের অবহেলিত হিন্দুদেরও মঙ্গল বয়ে আনে। কিন্তু এই সুখ কলকাতার দাদাদের চক্ষুশূল হয়। তারা বঙ্গভঙ্গ মেনে নিতে পারেনি। তখন অনেক জাতীয়তাবাদী সাহিত্য রচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেন "আমার সোনার বাংলা"। তৎকাল স্বদেশী আন্দোলন অনেক তীব্র হয়। ভণ্ড স্বদেশীদের কার্যকলাপ নিয়ে রবি ঠাকুরের "ঘরে-বাইরে" উপন্যাসটি রচিত। সেখানে দেখা যায় কীভাবে স্বদেশী আন্দোলনকারীরা নিরীহ গরিব মুসলিমদের উপর অত্যাচার করে। মুসলিমদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
অতঃপর ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর দিল্লির দরবারে একটি ঘোষণার মাধ্যমে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। তবে বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষার মে প্রবল চাহিদা উৎপন্ন হয়েছিল, তাতে ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তীব্র প্রয়োজনীতা অনুভব হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসলে পরে ঘোষণা দেন যে, তিনি সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করবেন।
১৯১২ সনের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ইংরেজ সরকার প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রুপরেখা স্থির করে। ভারত সচিব ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেন। কিন্তু ওই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেমে যায়।
১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অতিসত্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্ববান জানায়। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমস্ফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিশনের উপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কমিশনের প্রধান হলো মাইকেল স্যাডলার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন (স্যাডলার কমিশন) ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে।
কিন্তু এই কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করার নাথান কমিটির প্রস্তাব সমর্থন করেনি। কিন্তু ঢাকা কলেজের আইন বিভাগের সহঅধ্যক্ষ ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিরূপে অভিহিত করেন। সেই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অধ্যাপক টি সি উইলিয়ামস অর্থনৈতিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ন স্বাধীনতা দাবি করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা শহরের কলেজ গুলোর পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরুপে গন্য করার সুপারিশ করে। এ
ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অওতাভুক্ত এলাকায় গন্য করার কথা বলা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্টার ব্যাপারে তেরটি সুপারিশ করেছিল, এবং কিছু রদবদল সহ তা ১৯২০ সালের ভারতীয় আইন সভায় গৃহীত হয়। ভারতের তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ এতে সম্মতি প্রকাশ করেন। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি. জে. হার্টগ। তিনি ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক ভাবের কার্যক্রম শুরু করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন ?
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হোক এটা কলকাতার বাবুরা কখনোই চাইতেন না। সেখানকার বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, জমিদার, শিক্ষিত সমাজপতিরা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, আনন্দচন্দ্র রায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ। উনাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের ভালো সম্পর্ক ছিল। এইজন্য অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী। এছাড়া ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনকে ১৯১৮ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় করার কার্যক্রম শুরু হয়। এইজন্য অনেকে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধী মনে করে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে (Dhaka University) প্রথম থেকেই সুপরিকল্পিতভাবে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সবুজ গাছালিতে ভরা মনোরম পরিবেশ রমনা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তার পূর্ব পাশে অবস্থিত ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), লিটন হল, কার্জন হল, বিজ্ঞান ভবন সমূহ, ঢাকা হল এর পূর্ব পাশে বিরাট পুকুর, অপর পাশে ফজলুল হক মুসলিম হল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রধান প্রবেশ পথ ছিলো ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল)- এর দিক থেকে, মাঠে ঢুকতেই ডানে জিমনেসিয়াম এবং বামে পাশে আছে একটি পুকুর। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠটি ত্রিকোণাকৃতির এবং তাতে দুটি ফুটবল গ্রাউন্ড ছিলো। মাঠের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব তিনদিক দিয়েই বৃক্ষশোভিত রাজপথ। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণদিকের রাস্তাটি ইউকেলিপটাস বৃক্ষে ছেয়ে আছে। যে রাস্তাটি মুসলিম হল পর্যন্ত সম্প্রসারিত এবং মুসলিম হলের সামনে শিরিষ বা রেইনট্রি জাতীয় বৃক্ষ শোভিত।
পুরাতন রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সাবেক পূর্ববাংলা ও আসাম সরকারের সেক্রেটারিয়েট ভবন, সামনে ইউকেলিপটাস শোভিত প্রশস্ত রাজপথ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দান। ওই সেক্রেটারিয়েট ভবনের দোতলায় প্রথমে মুসলিম হল এবং একতলায় বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিভাগ যেমন কলা অনুষদের বিভাগ এবং ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এ বিশাল ভবনটির পূর্বাংশ ব্যাতীত সবটুকুই সামরিক হাসপাতাল এবং দেশবিভাগের পূর্বে মেডিকেল কলেজে রূপান্তরিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের উত্তর দিকে প্রবাহিত রাজপথের পাশে ছিলো দুটি বা তিনটি বিরাট লাল ইটের দোতলা বাংলো। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাস করতো। এই বাংলোগুলোর পেছনে রমনা রেসকোর্সের দিকে মুখ করে বর্ধমান হাউস ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক নিবাস। দেশবিভাগের পরে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী প্রথমে খাজা নাজিমউদ্দিন এবং পরে নূরুল আমীনের বাসভবন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভের পর ১৯৫৭ সালে একুশ দফার এক দফা অনুযায়ী বর্ধমান হাউসটিকে বাংলা একডেমীতে রূপান্তরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের ভেতরে সে কালে একটি পুকুর (উত্তর পূর্বকোণে) ছাড়াও একটি জঙ্গলাকীর্ণ পুরাতন কবরস্থান ছিলো, কিন্তু এখন সেটা নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আবাসিক পরিবেশ
১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত হয়েছিল ঢাকা হল (পরে শহীদুল্লাহ হল), জগন্নাথ হল এবং মুসলিম হল (পরে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) নিয়ে। হলগুলো শুধু ছাত্রাবাস রূপেই নয়, সেই সাথে ছাত্রদের শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবন উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও অনুশীলন কেন্দ্ররূপেও পরিকল্পিত হয়েছিল। পরিকল্পনায় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক কোনো না কোনো হলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন, ছাত্রদের উপদেষ্টারূপে এবং অনুশীলনী ক্লাস নিবেন। প্রত্যেকটি হলকে চারটি হাউসে বিভক্ত করা হয়েছিল চারশত ছাত্রের জন্য আর প্রতি পঁচাত্তরজন ছাত্রের তত্ত্ববধানের জন্য একজন করে আবাসিক শিক্ষক বা হাউস টিউটরের ব্যবস্থা ছিল। হিন্দু ছাত্রদের জন্য জগন্নাথ হল, মুসলমান ছাত্রদের জন্য সলিমুল্লাহ মুসলিম হল আর সবধর্মের ছাত্রদের জন্য ঢাকা হল স্থাপিত হয়েছিল।
ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০ দশকঃ ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Dhaka University) আমন্ত্রনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা আগমন করেন এবং কার্জন হলে ১০ ফেব্রুয়ারি দি মিনিং অফ আর্ট এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি দি বিগ এ্যান্ড দি কমপ্লেক্স বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিনটি হল থেকে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধণা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু কবি গুরু অসুস্থতার কারণে কেবল মুসলিম হলের সংবর্ধণা সভায় যোগদান করতে পেরেছিলেন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠিত হয়।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা ছিলেন অধ্যাপক আবুল হোসেন, তার সঙ্গে ছিলেন আবদুল কাদির, আনোয়ারুল কাদির, শামসুল হুদা, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী , কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখ শিক্ষক ও ছাত্র। এই প্রতিষ্ঠানের মূল মন্ত্র ছিল '"বুদ্ধির মুক্তি”। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র ছিল 'শিখা' নামক বার্ষিকী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ১৯২৭ সালে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দশম ও শেষ অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন।
৩০ দশকঃ শ্রীমতী করুণাকণা গুপ্তা ইতিহাস বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত হন ১৯৩৫-৩৬ সালে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর। ১৯৩৭ সালে প্রথম ছাত্রী সংসদ গঠিত হয় এবং শ্রীমতী চারুপমা বসু তার সভাপতি, সরমা দত্ত মজুমদার এবং অনুভা সেন যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই ছাত্রী সংসদ “সূপর্ণা” নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এই দশকে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩৬ সালের সমাবর্তনে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার যদুনাথ সরকার, স্যার মোহাম্মদ ইকবাল, স্যার আবদুর রহিম, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালে ‘সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ’ ভেঙ্গে দুটো আলাদা ‘সংস্কৃত’ ও ‘বাংলা’ বিভাগ খোলা হয়।
৪০ দশক ও দেশ ভাগঃ ১৯৪০ এর মার্চে লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলমান সমাজের ছাত্রদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলন সাড়া জাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রগণ এই প্রথম দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সক্রিয় ভাবে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্যাম্পাসের অধিকাংশ ভবন সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়। যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের কারণে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অনেক কমে যায়।
ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা: জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহ্ পাল্টা বাংলা ভাষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ‘তমুদ্দুন মজলিস’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে প্রচারাভিযান শুরু করেন। পাকিস্তানের গনপরিষদে বাংলা ভাষার স্থান না হওয়াতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ প্রতিবাদ সভা, সাধারণ ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঐ দিন পুলিশ ছাত্রদের বাধা দেয় এবং বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। বন্দী নেতাদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান,অলি আহাদ, শওকত আলি, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ।
তবুও ছাত্র আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ অবধি ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের সাথে একটি চুক্তি পত্র সাক্ষর করেন। এর চার দিন পর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন এবং ২১ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে একটি বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্পষ্ট ঘোষণা দেন। মার্চ ২৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ ভাষণ দেন। এখানে তিনি বলেন,রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যোগাযোগের ভাষা হিসেবে একটি ভাষা থাকবে এবং সে ভাষা হবে উর্দু অন্য কোন ভাষা নয়। এরপর রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহের সাথে সাক্ষাৎ করে ও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এই প্রতিনিধিদলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমেদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। ১৯৪৮ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে একটি সভায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সরকার বিরোধী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ’ গঠন হয়। ১৯৪৮ এর ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে এক ছাত্র সভায় ভাষণ প্রদান করে। ওই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়। তবে লিয়াকত আলি খান কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন ঢাকায় ছাত্রসমাজ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। প্রতিবাদস্বরুপ ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট পালিত হয় এবং আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ, খিলাফতে রব্বানী পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’ গঠিত হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি আবার ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় এবং স্থির হয় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবসরুপে পালিত হবে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধায় নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১১৪ ধারা জারি করে। নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে ১১৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১১৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সংগ্রাম পরিষদের সভায় আবদুল মতিন, অলি আহাদ ও গোলাম মওলা ১১৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ভোট দেন। ছাত্ররা ১০ জনে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে শৃঙ্খলার সঙ্গে ১১৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১১৪ ধারা ভাঙ্গা শুরু করলে ছাত্রদের সাথে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ওদিকে বিকাল তিনটার দিকে আইন পরিষদে বাজেট অধিবেশন শুরু হবার কথা ছিল। ছাত্ররা ভাষার দাবিতে পরিষদ ভবনের দিকে যেতে শুরু করে, কিন্তু পুলিশ বাধা দেয় ও একপর্যায়ে গুলি করতে শুরু করে। প্রথম দফা গুলিতে রফিকউদ্দিন ও জব্বার নিহত হয়। দ্বিতীয় দফা গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত আহত হয় ও রাতে নিহত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং ছাত্ররা এক বিরাট শোক শোভাযাত্রা বের করে। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের মাঝামাঝি রাস্তায় পুলিশ ছাত্রদের বাধা দেয় এবং গুলি চালায়। এ সময় শফিউর রহমান ও রিকশাচালক আউয়াল নিহত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা একটি শহীদ মিনার নির্মান করে।
২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে অনানুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ শফিউর রহমানে পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক ভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেছিলেন। ইতিমধ্যে পুলিশ নিরাপত্তা আইনে আবুল হাশিম, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ, পুলিন দে, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী, অলি আহাদ প্রমুখকে গ্রেফতার করে। নুরুল আমিন সরকার ভাষা আন্দোলনকারীদের ‘ভারতের চর’, ‘হিন্দু’, ‘কমিউনিস্ট’ ইত্যাদি আখ্যা দেয়।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
১৯৬৭ সালে আইয়ুব সরকার পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে লেফেটেন্যান্ট কর্ণেল মোয়াজ্জেম হোসেনকে আসামী রুপে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ করে। কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করা হয়। এই মামলার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র পূর্ব বাংলা ফেটে পরে এবং এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ দফার ভিত্তিতে গঠিত ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ ।
মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একাত্তরে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী বাঙালি সৈনিক, বৈমানিক ও ছাত্র-ছাত্রীগনকে সামরিক পর্যায়ভুক্ত করে আক্রমণ চালিয়েছিল। এই অপারেশনের নাম ছিল “অপারেশন সার্চ লাইট”। সময় নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাত ১ টা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে, রাস্তার পাশের এলাকা পুরানো গাড়ি আর স্টিম রোলার দিয়ে বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্ররা হলের সামনে একটি বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে রেখে সেনাবাহিনীকে বাধাঁ দেয়। সকাল ৪টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভবন গুলো দখল করে নেয় তারা। ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ন নিয়ে গঠিত বিশেষ মোবাইল বাহিনী লেফটেনেন্ট কর্ণেল তাজের নেতৃত্বে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট লাঞ্চার, মর্টার, ট্যাংক বিধ্বংসী বিকয়েললেস রাইফেল, ভারি ও হাল্কা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘেরাও করে আক্রমন, পাইকারি হত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। ওই রাতে দৈবক্রমে পাকিস্তানী আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া অধ্যাপক ড. মফিজুল্লাহ্ কবির তার ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে লেখেন, ওই রাতে ছাত্র সহ প্রায় ৩০০ ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শহীদ হয়। সেই সাথে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক ও ২৬ জন অন্যান্য কর্মচারী। নিহত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, ড. ফজলুর রহমান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ), অধ্যাপক এ. আর. খান খাদিম (গণিত বিভাগ), অধ্যাপক শরাফত আলী, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (প্রাক্তন প্রোভস্ট জগন্নাথ হল), অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (প্রোভস্ট জগন্নাথ হল), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুহম্মদ মুকতাদির (ভূতত্ত্ব) প্রমুখ।
সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে জগন্নাথ হলে, সেই রাতে ৩৪ জন ছাত্র শুধু সেই হলেই নিহত হয়। ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও আক্রান্ত হয়। সে স্থলে নিহত হয় জগন্নাথ হলের ৫/৬ জন ছাত্র। হানাদার বাহিনী হত্যা করে মধুর ক্যান্টিন খ্যাত মধুসূদন দে’কেও (মধুদা) মুক্তিযুদ্ধ কালীন পাকিস্তানী সৈন্যরা মুধুর ক্যান্টিন ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে শুরু করলে উর্দু বিভাগের শিক্ষক আফতাব আহমদ সিদ্দিকী খবর পেয়ে তাদের বাধাঁ দেন এবং জানান যে এই ভবনেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১০ নভেম্বর সশস্ত্র সৈন্যরা রোকেয়া হলে প্রবেশ করে এবং ত্রিশজন ছাত্রীর উপর নির্যাতন করে। তারা প্রোভোস্ট বাংলোও অবরোধ করে রাখে। একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু সংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, “আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুই চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম”।
ফলে মার্চের সেই কালরাত্রীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন। পরে মুজিবনগর সরকার বিচারপতি সাঈদকে “প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি” হিসেবে নিয়োগ দেয়। পাকিস্তান বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে তাদের কনভয়ে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসান। তাকে সহায়তা করেন ড. হাসান জামান, ড. মেহের আলি। স্বাধীনতার পর তিনজনই গ্রেফতার হন এবং মুক্তির পর দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এদের অনেকেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর যান এবং প্রবাসী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অম্ল-মধুর সম্পর্কের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন বঙ্গবন্ধু, এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতা পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সত্তরের দশক)
স্বাধীনতার পর এই বিশ্ববিদ্যালয় তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কয়েক ঘণ্টা আগে ১৯৭৫ সালের মধ্য-আগস্টে সপরিবারে শহীদ হন বঙ্গবন্ধু। জিয়াউর রহমান তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন।
৮০ দশক
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনা অভ্যুত্থানের ফলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে। সামরিক সরকার ছাত্র আন্দোলনে বাধা দেয় ও অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ‘শিক্ষা দিবসে’ সামরিক সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শহীদ মিনারে ফুল দিতে বাধা দেয় এবং একজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ৮ নভেম্বর ‘সিপাহী বিপ্লব দিবস’ পালন উপলক্ষে কলা ভবন প্রাঙ্গণে জাসদ ছাত্রলীগের শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ হামলা চালায় ফলে ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ বেধে যায়। সেই বছর ৮ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা দেশে হরতাল পালিত হয়। ছাত্রনেতা রাউফুল বাসুনিয়া অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে স্যার এ এফ রাহমান হলের নিকটে নিহত হন। ওই বছর ১ ডিসেম্বর এরশাদ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। মূলত সম্পূর্ণ আশির দশক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল ছিল।
৯০ দশক
এসময়ে স্বৈরাশাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ। ১০ অক্টোবর গনতন্ত্রের মুক্তির দাবীতে মিছিলে যোগদান করে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় অনেক ছাত্র-জনতা। পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেহাদ নামের এক ছাত্র। পুলিশ এসে তাঁর লাশ সরিয়ে ফেলার পূর্বেই কয়েকজন ছাত্র জেহাদের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। অপরাজেয় বাংলার সামনে সেই লাশ এনে রাখা হয়। শত শত ছাত্র-ছাত্রী সমাবেত হয় লাশ দেখার জন্য। এবং সেই মূহুর্তে উপস্থিত সকল ছাত্র গনতন্ত্রের মুক্তির পক্ষে একাত্মতা ঘোষণা করে। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করে সর্বদলীয় ছাত্র জোট। সর্বদলীয় ছাত্র জোটের প্রধান ছিলো ১১ জন ছাত্র। ২৬ নভেম্বর শহীদ মিনারে আয়োজিত একটি সভায় এই ১১ জন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র একতাবদ্ধ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পরে নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।
বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (Dhaka University) বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও নেই। তবে এখানে ১০ টাকায় সিঙ্গারা, সমচা ও চা পাওয়া যায়। যা আর কোথাও পাওয়া যায় না এবং এটা নিয়েও গর্বিত আমরা।
আইনিউজ/ইউএ
- মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফল ২০২৩
- এসএসসি বোর্ড চ্যালেঞ্জ এর রেজাল্ট ২০২৩
- এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩ | এসএসসি ফলাফল
- অনার্স ১ম বর্ষ পরীক্ষা রুটিন ২০২৩
- এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩ কবে হবে
- চবি ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩
- ‘বাঁচতে চাইলে পরীক্ষায় এ্যাটেন্ড কর’, ছাত্রীকে শাবি শিক্ষক
- ওসমানী মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, আন্দোলনে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা
- স্বপ্ন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হওয়া
টিউশনী করে পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন এ প্লাস পেল সরকারি কলেজের সুমাইয়া - গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ২০২৩