আইনিউজ ডেস্ক
আপডেট: ২১:৩৪, ২৪ জুলাই ২০২১
তিনি ফকির, তিনিই বাদশা
গণ সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফকির আলমগীর। এ দেশে গণসংগীতকে আলাদা করে পরিচিত করে তুলেছিলেন তিনি। তার কণ্ঠে গণ সংগীত পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। কিন্তু তিনি শুধু গণ সংগীত শিল্পীই ছিলেন না। ছিলেন পপ গায়কও।
সর্বমহলে সমান জনপ্রিয় এক সঙ্গীতশিল্পী তিনি। বিশ্বজুড়ে বাঙালিদের কাছে সমাদৃত তিনি। নিজেকে বারবার উত্তরণ করে এখন তিনি দেশ সেরা গণসঙ্গীত শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সকল গণআন্দোলনের পুরোটা তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য গান বেঁধেছেন। মুকুন্দরায়, কানাইলাল শীল, আলতাফ মাহমুদ, অজিত রায়ের পথ বেয়ে তিনি এককভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন। উদাত্ত কণ্ঠে লোকায়ত স্টাইলে গলা ছেড়ে তিনি গান মানুষের জন্য গেয়ে থাকেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গান তৈরি করতে পারেন। তিনি দেশের আনাচে কানাচে ছুটে ছুটে গান করেন। তিনি প্রবাসী বাঙালীদের সামনে স্বদেশ চেতনার বাণী তুলে ধরেন। ওপার বাংলাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পর তার অবস্থান।
ফকির আলমগীর। তিনি ফকির। তিনিই আবার বাদশা। ফরিদপুরে তার আদি বাড়ি। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারাজীবন তিনি সহজ মানুষ। সাধারণ পোশাক পরেন। এক মাথা ঝাঁকড়া ঢুল। সবসময় তিনি মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করেন। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই তার বন্ধু। ছোট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত, ধনী-গবির কোনো প্রভেদ নেই।
সবাই সমান ফকির আলমগীরের কাছে। ফকির আলমগীর সকল খানে সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য। সবার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলে যাচ্ছেন। তাই অনেক সময় তার প্রকৃত মূল্য আমরা দিতে কৃপণতা করি।
বরেণ্য এই গণসংগীতশিল্পী করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার রাতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে একাত্তরের এই কণ্ঠযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৭১।
ফকির আলমগীরের অমর শিল্প
শিল্পী বেঁচে থাকেন সৃষ্টিতে, ফকির আলমগীরও বেঁচে থাকবেন তার গানের মাঝে। সুদীর্ঘ ৫৫ বছরের সংগীত ক্যারিয়ারে এক হাজারেরো বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। মোট অ্যালবাম সংখ্যা ৩০। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে ‘ও সখিনা’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ঘর করলাম না রে’ প্রভৃতি গানগুলো উল্লেখযোগ্য।
ফকির আলমগীরের কণ্ঠে আরেকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো ‘নাম ছিল তার জন হেনরি’। এই গানটি সর্বপ্রথম গেয়েছিলেন গণসংগীতের অন্যতম শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, যাকে গুরু মানতেন ফকির আলমগীর। গানটির কেন্দ্রে রয়েছেন আমেরিকান লোকগাথার কিংবদন্তি জন হেনরি।
ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে
তার গাওয়া ‘ও সখিনা’ গানটি এখনো তরুণ প্রজন্মের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। ১৯৮২ সালে বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পরপরই দর্শকের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে গানটি।
ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন, ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে/আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে’। ২০১৬ সালে এক নিবন্ধে এই গানের ‘সখিনা’ প্রসঙ্গে ফকির আলমগীর লিখেছিলেন, ‘সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুঃখিনী পল্লীবালা আবার কারও কাছে আহ্লাদী বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনও কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনও বা ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমিক।’
মায়ের একধার দুধের দাম
মাকে নিয়ে তার গাওয়া ‘মায়ের একধার দুধের দাম’ গানটি প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন সেই গানের পেছনের গল্প। ১৯৭৭ সালে মাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গাড়িতে যাচ্ছিলেন ফরিদপুরে। আরিচা ঘাটে এক অন্ধ বাউলের কণ্ঠে ওই গান শোনেন তিনি। শোনে এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, ঢাকায় ফিরে নিজের মত করে গানটি তৈরি করেন। পরে বিটিভির এক অনুষ্ঠানে সেটি পরিবেশিত হয়। পরবর্তীতে খালিদ হাসান মিলুর কণ্ঠে গানটি কাজী হায়াতের ‘বর্তমান’ সিনেমায় ব্যবহৃত হয়।
আহমেদ ছফা ও ফকির আলমগীর
তার গাওয়া ‘ঘর করলাম না রে’ গানটি প্রচলিত আছে দারুণ কিছু গল্প। এই গানটি লিখেছিলেন আহমদ ছফা। শোনা যায়, পরে গীতিকারের অনুমতি না নিয়েই গানটি গেয়ে ফেলেন ফকির আলমগীর। আর গান শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলেন কবি ও লেখক আহমদ ছফা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ফকির আলমগীরের কারণেই এই গানটি আলোর মুখ দেখতে পায়।
বাম আন্দোলনে সরব ফকির আলমগীর
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন ফকির আলমগীর। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ।
এলো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়। গানের শিল্পী ফকির আলমগীর তাতেও কণ্ঠ মেলালেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। নব্বইয়ে সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে প্রতিবাদী গানে ফকির আলমগীরের ছিল সরব উপস্থিতি।
গণসংগীত কেন বেছে নিলেন, দ্য ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন, ‘মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই আমাকে বেশ টানে। দেশপ্রেম আমাকে সাহস যোগায়। সংগীতের অনেক শাখা থাকার পরও আমি সারাজীবন গণসংগীত করেছি মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে। আর আমি আজও মানুষের জন্য গান গাই।’
বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গণ–অভ্যুথান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন তাঁর গান দিয়ে।
যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করার জন্যই দেশজ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ও তাঁর সময়ের কয়েকজন শিল্পী শুরু করেছিলেন প্রথম বাংলা পপ ধারার গান। বাংলা পপগানের বিকাশেও তাঁর রয়েছে বিশেষ অবদান।
গণসংগীতের কিংবদন্তী
হ্যাঁ, গণসংগীত ছিল ফকির আলমগীরের অন্তপ্রাণ; তা নিয়েই পথ চলেছেন আজীবন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে কলকাতার নারিকেল ডাঙায় শরণার্থী শিল্পী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন, ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। শিল্পীর ভাষ্য, ‘এটা শুধুমাত্র কোনো ভাষণ নয়। এর মধ্যে যুদ্ধের নির্দেশ ছিল, রণকৌশল ছিল। ততদিনে তো গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার ভাষণ শুনেই আমি যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম।’
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশে মাতেন তরুণ শিল্পীদের একটি দল। আজম খান, পিলু মমতাজ, ফিরোজ সাঁই আর ফেরদৌস ওয়াহিদের সঙ্গে ফকির আলমগীরও তখন পপ গানে উন্মাদনা ছড়িয়েছিলেন শ্রোতাদের মাঝে। এমনকি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
গণসংগীতের কিংবদন্তীকে হারিয়ে শোকার্ত যারা।
বর্ণিল জীবন
ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। ফকির আলমগীর কালামৃধা গোবিন্দ হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।
জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ পাস করেন। ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্য হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত বলয়ে প্রবেশ করেন। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী একজন শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। অবশ্য এর আগে ষাটের দশক থেকেই গণসংগীত গেয়ে আসছিলেন তিনি। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অসামান্য ভূমিকা রাখেন তিনি।
সম্মাননা
পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে বাংলার লোকজ সুরের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি বহু গান করেছেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’, ‘শেরেবাংলা পদক’, ‘ভাসানী পদক’, ‘সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার’, ‘তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক’, ‘জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক’, ‘কান্তকবি পদক’, ‘গণনাট্য পুরস্কার’, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা’, ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার’, ‘ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র’, ‘জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা’, ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা’ ও ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ’ পুরস্কারে তাকে ভূষিত করা হয়।
তবে আদৌ কি এই গণসংগীতশিল্পীকে তার কাজের সমান সম্মাননা দিতে পেরেছি আমরা?
আইনিউজ/এসডি
- নিউ জার্সির চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রীমঙ্গলের ২ নির্মাতার ৬টি চলচ্চিত্র
- ‘হাওয়া’ দেখতে দর্শকদের ভিড়, খোদ নায়িকা সিঁড়িতে বসে দেখলেন সিনেমা
- লুঙ্গি পরায় দেওয়া হয়নি সিনেপ্লেক্সের টিকেট, সেই বৃদ্ধকে খুঁজছেন নায়ক-নায়িকা
- বিয়ে করেছেন মারজুক রাসেল!
- সেরা পাঁচ হরর মুভি
- শোকের মাসে শ্রীমঙ্গলের স্কুলগুলোতে প্রদর্শিত হলো ‘মুজিব আমার পিতা’
- শাকিবের সঙ্গে বিয়ে-বাচ্চা তাড়াতাড়ি না হলেই ভাল হত: অপু বিশ্বাস
- গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর শোক
- নারী বিদ্বেষীদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন যাত্রা শুরু : জয়া আহসান
- ‘ইত্যাদি’ এবার সোনারগাঁয়ে