Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৩ ১৪৩২

ইমরান আল মামুন

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ১০ অক্টোবর ২০২৪

রতন টাটার জীবনী

রতন নাভাল টাটা, যিনি ২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৭ সালে মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং সমাজকর্মী। টাটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রতন টাটা হলেন টাটা সন্স-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং টাটা গ্রুপের প্রধান, যা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ও সম্মানজনক শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত।

তাঁর নেতৃত্ব শুধু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। রতন টাটার জীবনী এমন একজন নেতার কাহিনী, যিনি উদ্ভাবন, নৈতিকতা ও মানবিকতাকে একত্রিত করে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ভারতীয় ব্যবসার ইতিহাসে একটি অমর ছাপ রেখে গেছেন।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
রতন টাটার জন্ম হয়েছিল ভারতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র মুম্বাইতে, যেটি তখনকার বম্বে নামে পরিচিত ছিল। তিনি টাটা পরিবারের একজন সদস্য, যারা ইতিমধ্যে ভারতের ব্যবসায়িক ও শিল্প ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাঁর প্রপিতামহ জামশেদজি টাটা ১৮৬৮ সালে টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠা করেন, যা ভারতীয় শিল্প উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে এবং এই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক স্তরেও বিশাল খ্যাতি অর্জন করে।

রতন টাটা ছোটবেলায় মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং তারপর তিনি জেএন পেটিট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি শিমলার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলেও পড়েছেন, যেখানে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন।

রতন টাটার শিক্ষাজীবন থেকে বোঝা যায় যে তিনি শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দক্ষতা অর্জন করতে চাননি, বরং বিশ্বব্যাপী পরিবর্তিত প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে টেকসই উদ্ভাবনের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। এ ধরনের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা তাঁকে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি এবং নতুন উদ্যোগের প্রতি আস্থা দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল।

টাটা গ্রুপে যোগদান ও প্রাথমিক দিন

রতন টাটা ১৯৬২ সালে টাটা গ্রুপে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল টাটা স্টিলের জামশেদপুর কারখানায়, যেখানে তিনি ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগ দেন। উচ্চশিক্ষিত এবং পরিবারের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, তিনি কোনো বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করেননি। তিনি শ্রমিকদের সাথে মিলে-মিশে কাজ করতেন এবং তাঁকে দেখা যেত ম্যানেজমেন্ট এবং উৎপাদন দলের প্রতিদিনের কাজের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকতে। এই সময়েই তিনি কোম্পানির জটিলতার গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ পান এবং একজন সাধারণ কর্মীর মতো কঠোর পরিশ্রম করেন।

১৯৭১ সালে তাঁকে ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস কোম্পানি লিমিটেড (নেলকো)-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা সেই সময়ে ব্যাপক আর্থিক সংকটে ভুগছিল। রতন টাটা তাঁর উদ্ভাবনী ব্যবসায়িক দক্ষতা এবং কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে কোম্পানির উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, যদিও বৈশ্বিক বাজারের অবনতির কারণে কোম্পানিটি টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। তবে, তাঁর এই প্রচেষ্টা টাটা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বের ক্ষমতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করে।

টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব গ্রহণ
১৯৯১ সালে, ভারতের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তনের সময়, রতন টাটা টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন। তাঁর নেতৃত্বের প্রথম দিকেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল টাটা গ্রুপকে আধুনিকীকরণের পথে পরিচালিত করা এবং পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনীতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তোলা।

যখন তিনি টাটা গ্রুপের দায়িত্ব নেন, তখন গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থা একাধিক ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংস্থা গুলোর মধ্যে কোনো বিশেষ একীভূতকরণ বা সমন্বয় ছিল না। রতন টাটা এই বিচ্ছিন্ন সংস্থাগুলিকে একত্রিত করতে এবং টাটা ব্র্যান্ডকে আন্তর্জাতিক মানের একটি নাম হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্ব দেন। তিনি সংস্থার অভ্যন্তরীণ সংস্কার করেন এবং টাটা গ্রুপের অধীন বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বোর্ড স্তরে পরিবর্তন আনেন।

রতন টাটা যেসব বড় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল টাটা গ্রুপকে আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তৃত করা। তাঁর অধীনে টাটা গ্রুপ বহু আন্তর্জাতিক অধিগ্রহণ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০৭ সালে ব্রিটিশ স্টিল জায়ান্ট কোরাসকে অধিগ্রহণ এবং ২০০৮ সালে বিলাসবহুল গাড়ি নির্মাতা জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভার কেনা। এই ধরনের আন্তর্জাতিক অধিগ্রহণগুলো টাটা গ্রুপকে বিশ্বমঞ্চে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি দিয়েছে এবং ভারতীয় কোম্পানিগুলির জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করেছে যে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।

উদ্ভাবন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা
রতন টাটা সবসময়ই নতুন উদ্ভাবন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত পণ্য তৈরি করার পক্ষে ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রধান উদাহরণ ছিল টাটা ন্যানো। ২০০৮ সালে তিনি বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি, টাটা ন্যানো বাজারে আনেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি সাশ্রয়ী মূল্যের ব্যক্তিগত গাড়ি তৈরি করা, যাতে তারা সহজে পরিবহণের সুবিধা পেতে পারে। যদিও টাটা ন্যানো বাণিজ্যিকভাবে বড় সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, এটি ছিল একটি সাহসী উদ্যোগ, যা তাঁকে উদ্ভাবনী নেতাদের তালিকায় তুলে ধরেছিল।

রতন টাটা শুধু ব্যবসার মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করেননি; বরং তিনি বরাবরই বিশ্বাস করতেন যে ব্যবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। তিনি টাটা গ্রুপের সামাজিক উদ্যোগগুলোতেও অনেক গুরুত্ব দেন এবং এর মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর অধীনে টাটা ট্রাস্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবেশ বিষয়ক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল, এবং টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

নেতৃত্বের শৈলী
রতন টাটার নেতৃত্বের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর বিনয় এবং মানবিকতা। তিনি সর্বদা তাঁর কর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। কর্মক্ষেত্রে তিনি সবসময়ই একটি পরিবারের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যেখানে সবাই একে অপরকে সম্মান করে এবং সহযোগিতা করে। এই শৈলী তাঁকে তাঁর কর্মীদের মধ্যে একজন প্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

রতন টাটার নেতৃত্বের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাঁর দূরদৃষ্টি। তিনি সবসময় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন এবং শুধু বর্তমানের জন্য কাজ করতেন না। এই দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে শুধু ভারতের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও একজন সফল নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছে।

টাটা গ্রুপের উত্তরাধিকার এবং অবসর

২০১২ সালে রতন টাটা টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান পদ থেকে অবসর নেন। তাঁর অবসরের পরও তিনি বিভিন্নভাবে সংস্থার সাথে যুক্ত রয়েছেন এবং পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে সাইরাস মিস্ত্রি দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যদিও কিছু সময় পরে তাঁকে সরিয়ে নোয়েল টাটাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

রতন টাটার অবসর তাঁর কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠার কোনো হ্রাস ঘটায়নি। অবসর গ্রহণের পরও তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন। তিনি রতন টাটা ট্রাস্ট এবং অন্যান্য টাটা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কাজ অব্যাহত রেখেছেন এবং স্টার্টআপ কোম্পানিগুলিকে সমর্থন করছেন।

রতন টাটার মানবিক দিক
রতন টাটার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর মানবিকতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন সংস্থাগুলো সবসময়ই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে, এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। তিনি সবসময়ই বিশ্বাস করতেন যে ব্যবসা শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের জন্য নয়, বরং সমাজের কল্যাণে কাজ করতে হবে।

তিনি টাটা ট্রাস্ট-এর মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পে বিশাল পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে টাটা গোষ্ঠী বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংকটের সময়ে ভারতীয় জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।

রতন টাটা পশুপ্রেমী হিসেবেও পরিচিত। তিনি পশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বহুবার প্রকাশ করেছেন এবং অবসর সময়ে মুম্বাইয়ের রাস্তায় বেড়ানো পশুদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে এসেছেন। তাঁর এই মানবিক গুণাবলী তাঁকে শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী নয়, একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরেছে।

রতন টাটার জীবন এবং কাজের মাধ্যমে স্পষ্ট যে তিনি কেবল একজন ব্যবসায়িক নেতা নন, বরং একজন আদর্শ সমাজসেবীও। তাঁর নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে নৈতিকতা, উদ্ভাবন, এবং সামাজিক কল্যাণের মিশেল। তাঁর সাফল্য শুধু টাটা গ্রুপকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করেছে তা নয়, বরং একটি উদাহরণ তৈরি করেছে যে কীভাবে ব্যবসা এবং সমাজের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা যায়।

এই মহান ব্যক্তি ৯ অক্টোবর ২০২৪ মৃতবরণ করেছেন। রতন টাটা একটি প্রজন্মের জন্য একজন প্রেরণাদায়ক নেতা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব

Green Tea
বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়