হাসানাত কামাল
আপডেট: ২০:৫৪, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১
রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
ফাইল ফটো
গ্রামটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষা ছবির মত সুন্দর। ভূমি থেকে ৬১৫৩ ফিট উপরে হেম্পিওপেটের চূঁড়া দিয়ে সূর্যের আলো ছড়িয়ে এ গ্রামের সকাল শুরু হয়। ফুলের মৌসুমে নীল অর্কিডে ছেঁয়ে থাকে পুরো গ্রাম, সঙ্গে কমলালেবুর মিষ্টি বাগান। অথচ এখানে নাকি পাখিরা মরতে আসে! শুনতে অবাক লাগলেও প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে লাখ পাখি আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ভারতের আসামের উত্তর কাছাড় জেলার সদর শহর হাফলং থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে দিমা হাসাও জেলায় অবস্থিত গ্রামটি; নাম জাতিংগা। বহু বছর আগে ভারতের অন্যতম আদি অধিবাসী জেমে নাগা উপজাতিরা এ এলাকায় একবার শিকারের উদ্দেশে এসেছিল। সে সময় খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটানোর সময় তারা এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পায়। হঠাৎ করেই দলে দলে পাখিরা এসে সে আগুনে আত্মাহুতি দিতে থাকে তাদের চোখের সামনে।
অনাকাঙ্ক্ষিত এমন দৃশ্য দেখে তারা স্বভাবতই ভড়কে যায়। তারা ভাবতে থাকে এটা নিশ্চয়ই দুষ্টু আত্মার কাজ! দুষ্টু আত্মা আর শয়তানেরাই পাখির রূপ ধরে আকাশ থেকে আগুনের বুকে খসে পড়ছে। তারা তড়িঘড়ি তখন ওই গ্রাম ত্যাগ করে।
স্থানটি এরপর অনেকদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯০৫ সালের কাছাকাছি সময়ে জান্তিয়া বা জৈন্তা উপজাতির কিছু মানুষ জাতিংগাকে খুঁজে পায়। এর পরিবেশ, আবহাওয়া সবই তাদের কাছে বসবাসের জন্য উপযুক্ত মনে হয়। চাষবাস শুরু করে তারা এখানে থাকতে শুরু করে দেয়। এক বর্ষার মৌসুমে তারাও প্রত্যক্ষ করে এমন অবাক দৃশ্য।
একদিন যখন রাতের আঁধারে তারা বাঁশের মশাল হাতে খোয়াড়ের বাছুর খুঁজতে বের হয়, তখন পাখিদের এই অদ্ভুত আত্মহত্যার সাক্ষী তারাও হয়। এবার আর শয়তান নয়, জান্তিয়া জাতি উল্টো একে ভাবে ‘ঈশ্বরের উপহার’! তারপর থেকে তো এ রহস্যময় ঘটনার কথা সবার কানে পৌছে যেতে লাগল।
১৯৫০ এর শেষের দিকে প্রকৃতিবিদ এডওয়ার্ড প্রিচার্ড এবং পক্ষীবিদ সালিম আলী এ রহস্যের উন্মোচন করতে জাতিংগায় আসেন। তারাই একে প্রথম বহির্বিশ্বের নজরে আনলেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘ওয়াইল্ড লাইফ অব ইন্ডিয়া’ বইতে পিচার্ড লিখেন, কেবলমাত্র একটা ভৌগলিক স্থানে পাখিদের এমন আচরণ সত্যিই বিস্ময়কর।
জাতিংগার খুব নিকটবর্তী স্থানগুলোতেও রাতে আলোর মশাল জ্বালিয়ে অধিবাসীদের চলাফেরা করতে বা উষ্ণতা পোহাতে দেখা যায় কিন্তু সেখানে পাখিদের এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় না! ১৯৮০ সাল থেকে জাতিংগা পুরোদস্তুর পর্যটক প্রিয় স্থানে পরিণত হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পাখিবিশারদেরা ভিড় করতে থাকেন। পাখিদের আত্মহত্যা এক বার্ষিক আশ্চর্যজনক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৫ সালে ভারতীয় পত্রিকা ‘দ্য হিন্দু’ এক প্রতিবেদনে লেখে, পাখিরা ইচ্ছে করে এমন করে না। তাই একে পাখিদের আত্মহত্যা নাম দেয়াটাও অনুচিত। বরং সে স্থানের কুয়াশাচ্ছন্ন বাতাসের তীব্র গতিবেগ পাখিদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। তারা নিজেদের পথ হারিয়ে ফেলে এবং দলে দলে আলোর দিকে ছুটতে গিয়ে রাস্তায় কোথাও ধাক্কা খেয়ে মারা পড়ে।
জাতিংগায় ‘জুলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ অধিদফতর কর্তৃক প্রেরিত পর্যবেক্ষক ড. সুধীর সেনগুপ্ত মৌসুমী বন্যা এবং পানিস্তরের পরিবর্তনকেও দায়ী করেন পাখির এমন আচরণের জন্য। বর্ষাকালে রাতের দিকে জাতিংগার ভৌগলিক চুম্বকীয় স্তরে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। মৌসুমী একটা পানির স্রোত তো আছেই। এর প্রভাব পাখিদের মধ্যেও পড়ে। স্থানীয় পাখিগুলো অস্বাভাবিক ভাবে আলোর উৎসের দিকে ধাবিত হয়। ভারসাম্য হারিয়ে যেখানে সেখানে পড়ে যায় এবং গুরুতর আঘাত পেয়ে মারা যায়। এখন এই চুম্বকীয় পরিবর্তন কেন হয় সেটার সন্ধান চলছে।
আসামের সবচেয়ে নামী পাখিবিশারদ ড. আনওয়ারুদ্দিন চৌধুরীও তার 'বার্ডস অব আসাম' বইতে এ ঘটনার উল্লেখ করতে ভুলেননি। তিনি অবশ্য মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং মিজোরামের কিছু অঞ্চলের পাখিদের ভেতর সম আচরণ দেখেছেন।
তিনি লেখেন, বাতাসের উচ্চ বেগ আর তীব্রতা পাখিদের আশ্রয় খুঁজতে প্রতিবন্ধক তৈরী করে। আশ্রয়ের খোঁজে পাখিরা তখন যেখানে আলো দেখে সেখানেই ছুটে বেড়ায়। যাবার পথে তাদের সামনে চলে আসা বাঁশের খুঁটি, বড় গাছ প্রভৃতির সাথে তাদের সংঘর্ষ হয় যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নিশিবক, হরিয়াল, বাঁশঘুঘু, কালিজ, দামা, পাহাড়ি তিতির এবং মাছরাঙার কয়েকটি প্রজাতিসহ প্রায় ৪৪ ধরনের পাখি আছে জাতিংগার আত্মাহুতি দেয়া পাখিদের দলে। অদ্ভুত ঘটনাটি চাক্ষুষ করতে আসাম পর্যটন দফতর সেখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার বসিয়েছে।
সব পাখি কিন্তু ধাক্কা খেয়ে মারা যায় না। কিছু আধমরা হয়ে পড়ে থাকে মাটিতে, তারা আর ওড়ার চেষ্টা করে না। তাদের কিছু খেতে দিলেও খায় না, অভুক্ত থেকে মরে যায় পাখিগুলো। যেন মৃত্যুর পণ করেই এসেছিল তারা। তাছাড়া পাখির মাংস উপাদেয় খাদ্য।
নভেম্বর মাসে কিছু গ্রামবাসী জঙ্গলের নির্দিষ্ট জায়গায় আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঁশের লম্বা খুঁটি, লন্ঠন হাতে তারা এসব ‘আত্মহত্যাকারী’ পাখিদের ধরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মাটিতে পড়ে থাকা পাখি তুলে গ্রামবাসী মেরে রান্না করে খায়। ২০১০ সালে তো জাতিংগাবাসী এক উৎসবেরও আয়োজন করে পাখিমৃত্যুর মৌসুমে! ভুরভুর করে পর্যটকের দল পাখিদের মৃত্যু দেখতে সামিল হয়, জাতিংগার পর্যটন শিল্পও ফুলেফেঁপে ওঠে। আর রাতের ডিনারে সেসব পর্যটকের প্লেটে যোগ হয় হতভাগ্য এসব পাখির রোস্ট!
জাতিংগার পাখিদের নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে। কারণ এত বছরেও কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বর্তমানে অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন,পাখিপ্রেমী এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা পাখিদের হত্যা না করতে অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের ভেতর প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের এসব প্রচেষ্টায় আগের চাইতে জাতিংগায় পাখিমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ কমে এসেছে।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ