Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৩ ১৪৩২

ফিচার ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ৭ জুন ২০২০
আপডেট: ০৭:৪৩, ৭ জুন ২০২০

ডাক্তার কাঠঠোকরা: যিনি ‘গাছের চিকিৎসক’!

ছবি নাভিদ ইবনে সাজিদ নির্জন

ছবি নাভিদ ইবনে সাজিদ নির্জন

ট্রারর, ট্রারর, ট্রারর... পড়ন্ত দুপুরে গাছের গায়ে এমন অদ্ভুত শব্দ দৃষ্টিকে চঞ্চল করে তোলে। একটু অনুসন্ধান করলেই খুঁজে পাবেন এই শব্দের রহস্য। শব্দটি আসলে কাঠঠোকরা পাখির খাদ্য অনুসন্ধানের বিশেষ একটি পর্ব।

কাঠঠোকরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Dinopium benghalense) Picidae (পিসিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Dinopium (ডাইনোপিয়াম) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির অতি পরিচিত পাখি । পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। বাংলা কাঠঠোকরার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার বলীয়ান (গ্রিক: denios = শক্তিমান, opos = চেহারা; লাতিন: benghalense = বাংলার)। সারা পৃথিবীতে এক সীমিত এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত। প্রায় ৩০ লক্ষ ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে, আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। তবে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

পাখিটির বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং বন্যপ্রাণী গবেষক ড. কামরুল হাসান আইনিউজকে বলেন, সব কাঠঠোকরাই পতঙ্গভুক পাখি। যে গাছের বাকল (শরীরের অংশ) আলতোভাবে লেগে থাকে সেই গাছের চারপাশে কাঠঠোকরা বেশি ঘোরাফেরা করে। এর অর্থ হলো সেই গাছের বাকলের নিচের লুকিয়ে থাকা পোকাগুলো এরা খায়। ঠোকর দিয়ে গাছের বাকলটি ফেলে দিলে এর নিচ থেকে যে পোকা বা পোকার লার্ভা বের হয় সেগুলো ওরা খায়। এছাড়াও গাছের যে জায়গায় পচা অংশ থাকে সেখানেই ওরা বেশি ঘুরে। কারণ ওইখানেই পোকা থাকবে এবং পোকার লার্ভা থাকবে। ও গুলোই ওদের খাবার। 

ছবি তুলেছেন: হাসনাত রনি, রাজশাহীতে ছবিটি তোলা হয়েছে

ড. কামরুল হাসান আরো বলেন, আসলে সব কাঠঠোকরাই আমাদের অনেক উপকার করে। অনেক ধরণের পতঙ্গভুক পাখি আছে যারা গাছের পাতা থেকে পোকামাকড় ধরে ধরে খায় বা ঘাস থেকে পতঙ্গ ধরে খায়। কিন্তু কাঠঠোকরাই একমাত্র পাখি যাদের ‘গাছের চিকিৎসক’ বলা হয়। কারণ গাছের যেখানে পচা অংশ বা ভাঙা অংশ থাকে সেখানেই বিষাক্ত পোকা অবস্থান করে ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে গাছেরই ক্ষতি করে। কাঠঠোকরা এসে সেই গাছের পচা অংশ থেকে ক্ষতিকর পোকা বা সেই পোকার ডিমগুলো খেয়ে গাছের উপকার করে।

তিনি আরো বলেন, একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখা যায়, কাঠঠোকরা কিন্তু গাছের শরীরে খাদ্য অনুসন্ধানের সময় অনেক জোরে জোরে শব্দ করে। এটা তার ইচ্ছে করে না। তাদের ঠোঁট খুব শক্ত হওয়ায় গাছের বাকল ভাঙার সময়ে এমন শব্দ হয়।

সাধারণ মানুষ মনে করে- কাঠঠোকরা পাখিগুলো গাছের গায়ে বসে গাছের শরীর ছিদ্র করে গাছকেই নষ্ট করে। আসলে তাদের ধারণ ভুল। প্রকৃতপক্ষে কাঠঠোকরা গাছের উপকার করে থাকে। এই কাঠঠোকরা বিশেষ প্রজাতির পাখি যারা গাছের গায়ের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ক্ষতিকর পোকামাকড়-কীটপতঙ্গদের ঠোঁট দিয়ে বের করে খেয়ে গাছকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে।

চলুন কাঠঠোকরা পাখির আরো কিছু বিস্ময়কর তথ্য জেনে নেই - 

১. প্রতিদিন একটি কাঠঠোকরা আট হাজার থেকে বারো হাজার বার কাঠে ঠোকর দেয়। এভাবে কাঠ ঠোকরানোর ফলে এরা খুঁজে পায় গাছের বাকলের খাঁজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড়দের। এই পোকাগুলো এদের খাবার। 

২. গাছের গায়ে গর্ত করে বাসাও তৈরি করে এরা। সেই বাসায় থাকে এদের ডিম। আর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর পর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ দিন সেখানেই থাকে ছোট্ট কাঠঠোকরারা।

৩. প্রশ্ন জাগতে পারে- কাঠ ঠোকরাতে গিয়ে কাঠের গুঁড়ো এদের চোখে কিংবা নাকের ভেতর ঢুকে যায় কি না। অবাক করা বিষয় হলো- এদের চোখের সামনে খুব অল্প সময়ের জন্য ছোট একটা পর্দা চলে আসে আর নাকের ফুটোর কাছে কিছু পালক থাকে বলে এ ধরনের সমস্যায় এদের পড়তে হয় না। 

৪. এদের পায়ের আঙুলও এমন বিশেষ ধরনের যে কাঠ ঠোকরাতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। বেশ ভালোভাবেই গাছের ডালে আটকে থাকতে পারে এরা। 

৫. পৃথিবীতে ১৮০টিরও বেশি প্রজাতির কাঠঠোকরা আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকায় কাঠঠোকরা পাখি দেখা যায়। শুধু অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর দু-একটি দেশে দেখা মেলে না এদের। পোকামাকড় ছাড়াও এরা ফলমূল আর বাদাম খায়। 

৬. অন্য পাখিদের মতো এরা গান গাইতে পারে না।

৭. এরা নখ দিয়ে গাছের শরীর আকড়ে ধরে শক্ত লেজে ভর দিয়ে খাড়াভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠতে এবং নামতে পারে। শুধু তা-ই নয়, লেজে ভর রেখে সে খাড়াভাবে থাকতেও পারে এবং উঠেও ওইভাবে। দুই পা দিয়ে গাছটা ধরে থাকে আর লেজে ভর দিয়ে শরীরটা ঠেকিয়ে রাখে। তারপর লেজে ভর দিয়ে একটা লাফ দিয়ে উপরে ওঠে। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার লাফ দেয়। এভাবে সে লাফিয়ে লাফিয়ে গাছে উঠতে থাকে অথবা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতেও থাকে।

৭. কোনো কোনো কাঠঠোকরা দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে, কেউ কেউ আবার চায় একাই থাকতে। একা থাকতে পছন্দ করে, এমন কাঠঠোকরাদের থাকে একেকটি নির্দিষ্ট এলাকা। কাঠ কিংবা খুঁটির মতো কোনো কিছুকে ঠুকরিয়ে যে আওয়াজ করে এরা, সেই আওয়াজ দিয়েই নিজের এলাকা নির্দিষ্ট করে নেয়।

আইনিউজ/এইচ

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়