ফিচার প্রতিবেদক
ট্রি ট্রি ট্রি - ডাকছে লাজুক মুনিয়া
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছবিটি তুলেছেন হাসনাত রনি
ডানা মেলে ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতা শুধু পক্ষীকূলেরই রয়েছে। আমরা কতই না বিষ্ময় নিয়ে দেখি পাখি কীভাবে দুই ডানায় ভর করে আকাশে উড়ে বেড়ায়। পৃথিবীতে বহু প্রজাতির পাখি রয়েছে। রংবেরঙের অনেক পাখিই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। আমরাও মনমুগ্ধ হয়ে হরেক রঙা পাখি দেখি। তেমনি এক বিষ্মকর পাখি মুনিয়া।
এই নামটি সবারই বেশ পছন্দের। এই নামে অবশ্য অনেকের নামও রয়েছে। ছোট ঠোঁটের তিন রঙা এই পাখিটির নাম মুনিয়া। মুনিয়া পাখির মধ্যেও অবশ্য অনেক প্রজাতি রয়েছে। এই মুনিয়া পাখির শরীরে তিনটি রং রয়েছে। এর মাথার অংশটুকু কালে, বুক সাদা-কালো ও পিঠ ও পাখাসহ লেজ অনেকটা ফিকে লাল বা গাঢ় বাদামি। এই প্রজাতির পাখিটিকে কালো মাথার মুনিয়া, তেরংগা বা ধলাকোমর মুনিয়াও বলা হয়ে থাকে।
অনেকটা চড়ুই পাখির সমানই হবে মুনিয়া। মাত্র ১২ সে.মি লম্বা পাখিটির ইংরেজি নাম হোয়াইট রামড বা ব্ল্যাক হেডেড মুনিয়া। আর বৈজ্ঞানিক নাম লনচুড়িয়া মালাক্কা। অনেক প্রজাতির পাখি রয়েছে আমাদের দেশে। অধিকাংশ পাখিই আমাদের কাছে অপরিচিত। ব্যস্ত জীবনে এসব নিয়ে ভাবনারও সময় নেই কারো। তবে অনেক সময় হঠাৎ চোখে পড়ার পর জানতে ইচ্ছা হয় নিশ্চয় সেই পাখিটি সম্পর্কে! আজকের লেখায় থাকছে ছোট্ট মুনিয়া পাখির জীবনাচরিত্র।
কোথায় থাকে এই পাখি?
মুনিয়া নামের ছোট্ট সুন্দর এই পাখিটি অনেকটা লাজুক প্রকৃতির। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস। প্রায় ৫৪ লাখ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা স্থির রয়েছে। সাধারণত দল বেঁধে, কখনো জোড়া বেধে চলে মুনিয়া পাখিরা।
ঘাসবন, কাশবন, আখ ক্ষেত মুনিয়াদের অত্যন্ত পছন্দের স্থান। নদীর ধারে কাশবনে, ফসলের ক্ষেতে, খোলা মাঠের ঘাসবনে মুনিয়াদের দেখা মেলে। তবে এখন আর আগের মত ঘাসবন বা কাশবন না থাকায় আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে মুনিয়ার সংখ্যাও। অনেকে এই পাখি খাঁচায় আটকে পোষেন। পশু-পাখির দোকানগুলোতে হরহামেশাই দেখা মেলে এই পাখির।
মাটিতে হাঁটতে বোধ হয় মুনিয়াদের কষ্ট হয়। এজন্য তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায় গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে রাত কাটায়। কোমরের কাছটা সাদা হওয়াতে এই প্রজাতিকে ধলাকোমর মুনিয়া ডাকা হয়। এর দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১২ সে.মি, ডানা পাঁচ দশমিক দুই সে.মি, ঠোঁট এক দশমিক দুই সে.মি, পা এক দশমিক পাঁচ সে.মি, লেজ দুই দশমিক সাত সে.মি ও ওজন ১২ গ্রাম।
গায়ের রঙে গাঢ় কালচে বাদামি, কালো ও সাদার প্রাধান্য। হঠাৎ দেখলে সাদা-কালোই মনে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পুরো পিঠ কালচে বাদামি, কোমর সাদা। দেহের পেছনে ফিকে শিরযুক্ত লম্বা দাগ রয়েছে। লেজের উপরের দিকে আর ডানার দিকে খানিকটা কালো। লেজ সুঁচালো ও কালো। বুকে ফিকে আঁশের দাগ রয়েছে। পেট হালকা পিত-সাদা। পেটে কিছু লম্বালম্বি কালচে দাগ রয়েছে। বুক কালচে-বাদামি ও অবসারণী কালচে।
এর ঠোঁট দুই রঙের। ত্রিকোণাকৃতির ঠোঁট, নীলাভ কালো। উপরের ঠোঁট কালো এবং নিচের ঠোঁট স্পষ্ট নীলচে ধূসর। চোখ লালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা কালচে ধূসর। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কোমর হালকা রঙের এবং দেহ তলে নানান বাদামি ছোপ থাকে।
পুরুষ ও স্ত্রী মুনিয়া পাখি চেনার উপায়
পুরুষ এবং স্ত্রী মুনিয়া পাখি চেনার উপায় হচ্ছে এদের শরীরের রং। সাধারণত পুরুষ পাখির গায়ের রং তুলনামূলক স্ত্রী পাখির চাইতে বেশি উজ্জ্বল হয়। অপর দিকে স্ত্রী পাখির গায়ের রং তুলনামূলক কম উজ্জ্বল। পুরুষ পাখি চেনার আরো একটি উপায় হচ্ছে, এদের গলার ঘুরানো দাগ। পুরুষ পাখির গলা পর্যন্ত যে দাগটি থাকে এটি বেশ গাঢ় রংয়ের হয়।
এদের খাবার
মুনিয়া পাখিরা মাঝারি ঝোপ, বনের ভেতরের পরিষ্কার জায়গা, তৃণভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোপে বিচরণ করে। সচরাচর ১০ থেকে ১৫টি পাখির ঝাঁকে থাকে। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বা ঘাসের মধ্যে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। খাদ্য তালিকায় রয়েছে ঘাসবীজ ও বাঁশবীজ, তবে ছানারা পোকা খায়। এদের প্রধান খাবার হচ্ছে ধান, কাউন ও শস্যবীজ। তবে বিভিন্ন শাক, লতাপাতা, পোকামাকড়ও খায়। এরা সচরাচর করুণ কণ্ঠে ডাকে ট্রি-ট্রি-ট্রি, প্রিট অথবা ব্রিট।
মুনিয়ার প্রজনন
কাঁটা ঝোপ, কাশবন অথবা নল খাগড়ার বনে বাসা বাঁধে। শুকনো খড় লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। নতুন সংসারে পাঁচ থেকে ছয়টি ডিম দেয় মুনিয়া। ডিমের রং ধবধবে সাদা হয়। ১২ থেকে ১৬ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চারা বেড়িয়ে আসে। নতুন সন্তানদের পেয়ে মুনিয়া যুগল বেজায় খুশি।
সেই সঙ্গে শুরু হয় মা-বাবার পালাক্রমে বাচ্চাদের খাদ্যের সন্ধান আর পাহারা দেয়া। এই সময় বাচ্চাদের পেট ভরাতে গিয়ে মুনিয়া মা-বাবার চেহারা মলিন হয়ে যায়। মা মুনিয়া বাচ্চাদের ছয় থেকে সাত দিন বুকে আগলিয়ে রাখে। ১৫ থেকে ১৯ দিন বয়সের থেকে বাচ্চারা মা-বাবার পাশাপাশি উড়ে বেড়ায়।
মুনিয়ার প্রজাতি
অনেক প্রজাতির মুনিয়া আছে। এর মধ্যে ধলাকোমর মুনিয়া, লাল মুনিয়া, কালো মাথা মুনিয়া বেশি দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে প্রায় পাঁচ প্রজাতির মুনিয়ার সাক্ষাৎ মেলে। নানা কারণে তাও এখন সংকটের মুখে। গাছপালার কমতি, পাখি শিকারিদের আনাগোনা, ঘরে পোষার জন্য এখন অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।
মুনিয়া পাখি কত বছর বাঁচে?
এটি নির্ভর করে পাখিটি কি অবস্থায় আছে তার উপর। প্রাকৃতিক পরিবেশে এই পাখিটি সাত থেকে আট বছর বেঁচে থাকে। তবে খাঁচায় পালন করলে এদের গড় আয়ু চার বছর। এসব দিক বিবেচনা করে কখনোই তিন বছরের বেশি বয়সী মুনিয়া পাখি পালন করা উচিত নয়। আবার খাঁচায় কৃত্রিম খাবার খেতে এর থেকেও কম সময় বাঁচে অনেক মুনিয়া পাখি।
তবে বিলুপ্তপ্রায় পাখিদের সংরক্ষণে কাজ করছে বন বিভাগ। সরকারিভাবেও নানা পদক্ষেপ নেয়া হয় এসব বিলুপ্তের পথে থাকা পশু কিংবা পাখিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। পাশাপাশি আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। খাঁচায় পাখি পোষার মানসিকতা কমাতে হবে। আমাদের একটু সচেতনতা আর আন্তরিকতায় হয়তো এই ছোট্ট সুন্দর মুনিয়াদের দেখা পাবে আগামী প্রজন্ম।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ