ফিচার প্রতিবেদক
গহিন সুন্দরবনের রহস্যময় নিভৃতচারী ‘প্যারাপাখি’
ছবি- সংগৃহীত
প্রাণীকূল বৈচিত্রময়। নানা জাতের প্রাণীর বৈচিত্র মানুষকে করে বিস্মিত। আর প্রাণীকূলের বৈচিত্রের রহস্য ভেদ করতে মানুষের চেষ্টা থাকে নিরন্তর। সেই নিরন্তর চেষ্টার তালিকায় রয়েছে গহীন সুন্দরবনের বাঘ। তবে বাঘের চেয়ে একই বনে বাস করে আরেকটি রহস্যময় পাখি। নাম তার কালামুখ-প্যারাপাখি।
কালামুখ-প্যারাপাখি জলচর পাখি। স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির পাখিটি সুন্দরবনে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। এ প্রজাতির পাখির দৈর্ঘ্য ৫৬ সেন্টিমিটার, ডানা ২৪ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৫ সেন্টিমিটার, পা ৪.৮ সেন্টিমিটার, লেজ ১১ সেন্টিমিটার।
প্যারাপাখি দূর থেকে দেখে সহজেই হাঁস বলে ভুল হতে পারে, আকারে-প্রকারে পাতিহাঁসের সঙ্গে এর কিছু মিল আছে। তবে এর বিশাল হলুদ ঠোঁট বেশ চোখা, হাঁসের মতো চেপ্টা নয়। এর লম্বাটে সবুজ পায়ের প্রতিটি আঙুলে বিচ্ছিন্ন পর্দা আছে, হাঁসের মতো পর্দা দিয়ে আঙুলগুলো জোড়া নয়। ছেলে ও মেয়ে প্যারাপাখির আকার ও রঙে পার্থক্য আছে। মেয়ের চেয়ে ছেলে বড়। মেয়ের ওজন আধা কেজির কম, ছেলের ওজন পৌনে এক কেজি। মেয়ের গলার পালক সাদা, ছেলের ঘন কালো।
প্যারাবনের খাল ও চিরসবুজ বনের হৃদে বিচরণ করে কালামুখ-প্যারাপাখি। এরা একা, জোড়া বা ছোট পারিবারিক দলে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কাদায় হেঁটে বা অগভীর জলে সাঁতার কেটে খাবার খায় এরা। এ প্রজাতির পাখির খাদ্য তালিকায় মাডস্কিপার, ছোট মাছ, জলজ পোকা, শামুক ও অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী রয়েছে। ভয় পেলে মজার কাণ্ড করে কালামুখ-প্যারাপাখি। শুধু ঠোঁট ও মাথা ওপরে রেখে পানিতে ডুবে থাকে বা দৌড় দিয়ে লুকিয়ে যায়।
তাদের বিশ্রামের জায়গা হচ্ছে পানির ওপর ঝুলন্ত গাছ। গাছে বসেই ক্লান্তি দূর করে এ জাতের পাখি। মাঝে মাঝে হাঁসের মত উচ্চ ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দে ডাকে।
কাদামাটিতে হেঁটে অথবা তীরসংলগ্ন পানিতে সাঁতার কেটে প্যারাপাখি মাছ, মাডিস্কপার, চিংড়ি ও পোকা শিকার করে। মানুষ দেখলে প্যারাপাখি খুব দ্রুত পানিতে দেহ ডুবিয়ে ফেলে অথবা বনের মধ্যে গা ঢাকা দেয়।
বাঘের মতো নিভৃতচারী এ পাখি কখনো দলবেঁধে বাস করে না, একাকী বিচরণ করে এবং কেবল প্রজননের সময় জোড়া বাঁধে। পানির কাছে ঝুঁকে থাকা গাছের সমান্তরাল ডালে পাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে বর্ষাকালে প্যারাপাখি চার-ছয়টি ডিম দেয়।
বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা তবু মোটামুটি জানা আছে, কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা সম্পূর্ণ অজানা। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা, এ দেশে বাঘের চেয়েও প্যারাপাখির সংখ্যা কম, পাখিটি চোখে দেখেছেন এমন পাখিবিদের সংখ্যা আরও কম। বাগেরহাট ও খুলনা জেলার সুন্দরবনের দক্ষিণে মানুষের আনাগোনা কম এমন নিভৃত খালের পাড়েই অধিকাংশ প্যারাপাখির বাস, বনের উত্তরে ও পশ্চিমে পাখিটি কমই চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে প্যারাপাখির দেখা একেবারেই মেলে না। পৃথিবীর কোনো চিড়িয়াখানায় কালামুখ প্যারাপাখি নেই। সুন্দরবনের বাঘ গবেষণার মতোই দীর্ঘক্ষণ ধরে প্যারাপাখি পর্যবেক্ষণ করাও দুঃসাধ্য কাজ। ফলে পাখিটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে।
‘তথ্যের অপ্রতুলতার বিচারে কালামুখ প্যারাপাখির মতো পাখি পৃথিবীতে কমই আছে’—এ মন্তব্য করা হয়েছে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল প্রণীত ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ। প্যারাপাখির বিচরণভূমির বৈশিষ্ট্য, আহার্য-তালিকা, পূর্বরাগ, প্রজনন-সফলতা ও ছানার জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য এখনো মানুষের অজানা। অদূর ভবিষ্যতে পাখিটির বিলুপ্তি রোধ করার জন্য ওই সব তথ্য সংগ্রহে দেশের দক্ষ গবেষকদের উৎসাহ দেয়া জরুরি বলে পাখিপ্রেমীরা মনে করেন।
জুলাই-আগস্ট মাস কালোমুখ-প্যারাপাখির প্রজনন কাল। এরা পানি বা ভূমি থেকে ১-৩ মিটার উঁচুতে গাছের বড় ডালে ডিম পাড়ার জন্য বাসা বানায়। ডালের ঘন পাতার আড়ালে ডালপালা দিয়ে গোল স্তূপাকার করে বাসাটি। ডিমগুলোর রঙ হয় সবুজাভ। কালোমুখ-প্যারাপাখি সংখ্যায় ৫-৬টি ডিম দিয়ে থাকে। যার পরিমাপ ৫.২ ৪.৩ সেন্টিমিটার।
কালামুখ-প্যারাপাখিকে বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার, কাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পাখি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কালামুখ-প্যারাপাখি বিশ্বে সংকটাপন্ন ও বাংলাদেশে বিপন্ন পাখি হিসেবে বিবেচিত করা হয়। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কালামুখ প্যারাপাখির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ মুখোশওয়ালা সূর্য-শিশু (গ্রীক: helios = সূর্য, pais = শিশু; ল্যাটিন: personatus= মুখোশওয়ালা )।
এটি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। অর্থাৎ ১২ মাসই এদেশে থাকে। তবে সব জায়গায় দেখতে পাওয়া যায় না। সুন্দরবন গেলেই এ পাখি দেখতে পাওয়া যাবে এমনটি ভাবারও অবকাশ নেই। কারণ, এর সংখ্যা এতো কম যে, তাকে দেখাটা রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। সারা বিশ্বে এ পাখিটি সংকটাপন্নের তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ হারিয়ে যেতে বসেছে।
এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহজেই এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। সুন্দরবনের অনন্যসাধারণ এ পাখিটি সংরক্ষণে বন বিভাগেরও বিশেষ উদ্যোগ থাকা উচিত। বৈশ্বিক সংকটাপন্ন এ পাখি রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সব পাখিপ্রেমী ও সচেতন মানুষের।
সূত্র- বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, উইকিপিডিয়া
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ