ডেস্ক নিউজ
শত শত কোটি ডলারের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের নেপথ্যে
চার বছর; ইতোপূর্বে তৈরি হওয়া পৃথিবীর দ্রুততম ভ্যাকসিন গবেষণা ও উন্নয়ন সম্পন্ন হতে ঠিক এসময়টাই লেগেছিল। সংক্ষিপ্ত সময়ে ভ্যাকসিন তৈরির এটাই বিশ্বরেকর্ড। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে সময় লেগে যায়- কমপক্ষে ১০-১৫ বছর। অথচ মহামারির কারণে পৃথিবীর নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীরা মাত্র এক বছরের মধ্যে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন।
আমাদের গ্রহটির নানা প্রান্তে কয়েক ডজন গবেষক ও বিজ্ঞানী দল সার্স কোভ-২ ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত। প্রচলিত পন্থার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগেও এসব গবেষণা এগিয়ে যাচ্ছে।
ইতোপূর্বে কোনো রোগের প্রতিষেধক তৈরির গবেষণাতেও এ পরিমাণ অর্থায়ন মেলেনি, যেমনটা কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে করা হচ্ছে। শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন ধনী রাষ্ট্র। তবে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে যথাক্রমে; যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের কিছু দেশ।
কিন্তু, করোনায় আক্রান্তের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে ভ্যাকসিনের টিকা পৌঁছানোর সম্ভাবনা এখনও অনিশ্চিত। এজন্য দরকার আরো নানা আয়োজন ও চুক্তি।
নতুন করোনাভাইরাস অপ্রতিরোধ্য হারে বিস্তার লাভ অব্যাহত রেখেছে এখনও। ঠিক তার মধ্যেই জনসাধারণের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে আলোচিত তিনপক্ষ কিভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেটাই এখানে তুলে ধরা হলো।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া:
২০২১ সালের শুরুতেই কোভিড-১৯ মোকাবিলায় একটি ফলদায়ক এবং সুরক্ষিত ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সংক্ষিপ্ত এ সময়ের মধ্যে তৈরির লক্ষ্য মাথায় রেখেই গবেষণার সময় অনেক সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
তবুও একটি নিরাপদ প্রতিষেধক উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। কয়েকটি পরীক্ষামূলক স্তর সফলতার সঙ্গে পার করলেই- কেবল দেওয়া হয় অনুমোদনের সবুজ সংকেত। গবেষণাগারে ভাইরাস বিরোধী সক্ষমতা পরীক্ষাকে বলা হয় প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এখানে ল্যাবটেরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুকে প্রতিষেধকের সংস্পর্শে আনা হয়। সেখানে সফলতা মিললে পড়ে; ইঁদুর, শিম্পাঞ্জি, খরগোশ প্রভৃতি প্রাণির দেহে প্রয়োগ শুরু হয়।
প্রাণিদেহে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় সংক্রমিত ভাইরাস মোকাবিলায় প্রার্থী ভ্যাকসিন ফলদায়ক ও নিরাপদ প্রমাণিত হলে তারপরে শুরু হয় মানবদেহে পরীক্ষার পালা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নামের এ ধাপটি আবার তিন স্তরে বিভক্ত। আর সাধারণ অবস্থায় এর একেকটি স্তর সম্পন্ন করতে দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় নেওয়া হতো।
গবেষণা ও উন্নয়নের এই স্তরগুলো একটি প্রার্থী ভ্যাকসিনকে বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এবং কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপযুক্ত করে তুলতে সাহায্য করে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে বৈশ্বিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এসকল স্তর। ইতোমধ্যেই অনেকেই জানেন এগুলো সম্পর্কে। তবু আরেকবার মানবেদেহে পরীক্ষার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের স্তর বিন্যাসগুলোয় নজর দেওয়া যাক।
প্রথম পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: প্রাণীদেহে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের জন্য সুরক্ষিত কিনা তা জানতে, খুব কম সংখ্যক কিছু স্বেচ্ছাসেবী ব্যক্তির মধ্যে এটি প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত প্রথম স্তরের ভ্যাকসিন পরীক্ষায় ১০-১৫ জনের থেকে প্রার্থী ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: প্রথমবার সুরক্ষিত প্রমাণিত হলে, তারপর কয়েক শ' ব্যক্তির দেহে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করে- এর নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া, এই স্তরে পরীক্ষামূলক প্রতিষেধক গ্রহণকারীদের দেহে কেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ফেলছে- সে সম্পর্কেও আরো বিস্তারিত তথ্য মেলে। তাছাড়া, কি পরিমাণ ভ্যাকসিনের ডোজ প্রয়োগ করা দরকার এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতটুকু উদ্দীপ্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কেও বিপুল তথ্য পান গবেষকরা।
তবে করোনাভাইরাসের বেশকিছু প্রার্থী ভ্যাকসিন একাধারে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, প্রথমবারের মতো শত শত জনের দেহে পরীক্ষা করা হচ্ছে সম্ভাব্য এসব প্রতিষেধক।
তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: প্রার্থী ভ্যাকসিন সুরক্ষিত এবং ফলপ্রসূ কিনা তা পরীক্ষার সর্বশেষ এই স্তরে দশ সহস্রাধিক ব্যক্তির দেহে তা প্রয়োগ করা হয়।
স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে রাখা হয়; বিভিন্ন বয়স এবং স্থানে বসবাসকারীদের। এদের অর্ধেককে অবশ্য দেওয়া হয় পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন, বাকি অর্ধেককে তা দেওয়া হয়না।
পরীক্ষার ফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যা গোপন রাখা হয়। এমনকি স্বেচ্ছাসেবীদের দেহে ইঞ্জেকশন প্রয়োগকারী স্বাস্থ্য কর্মীরাও-তা জানতে পারেন না।
এর মূল লক্ষ্য স্বেচ্ছাসেবীরা কেউ ভাইরাস আক্রান্ত হন কিনা তা লক্ষ্য করা এবং পরীক্ষাধীন ভ্যাকসিন প্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে সুস্থতা লাভ করছেন কিনা- তা পর্যবেক্ষন করা। নতুন সংক্রমণ রোধে প্রার্থীটি (সম্ভাব্য প্রতিষেধক) কতটুকু ফলদায়ক হচ্ছে- তা জানতেই এমনটি করা হয়।
সবগুলো স্তরের পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য সফলতা আসলে, তারপরই সংশ্লিষ্ট দেশের জনস্বাস্থ্য ও ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এর অনুমোদন দেয়। তখন প্রার্থীটি পরিণত হয় আসল ভ্যাকসিনে। তারপর আসে ব্যাপক উৎপাদন এবং তা বিপুল জনগোষ্ঠীর মাঝে বণ্টনের স্তর।
তৃতীয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেওয়া ভ্যাকসিনগুলো:
মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে; এমন প্রার্থী ভ্যাকসিনের অধিকাংশই- হয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের কোনো দেশ নয়তো চীনে গবেষণাধীন আছে। ভ্যাকসিন গবেষণায় আর্থিক সহযোগীতাও দেওয়া হচ্ছে আলোচিত দেশসমূহের সরকারের পক্ষ থেকে। বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি নিরাপদ এবং কার্যকর ভ্যাকসিন অনুমোদনের প্রথম ঘোষনা- উল্লেখিত দেশসমূহের যে কোন একটি থেকে আসবে।
মার্কিন জৈব-প্রযুক্তি ভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারক মডের্না প্রথম মানবদেহে প্রার্থী ভ্যাকসিন পরীক্ষা শুরু করে গত ১৬ মার্চ থেকে। চীনা বিজ্ঞানীরা সার্স কোভ-২ ভাইরাসের জিন নকশা প্রকাশের মাত্র দুমাস পরই এ প্রক্রিয়া শুরু করে মডের্না।
বর্তমানে পরীক্ষার সর্বশেষ তৃতীয় স্তরে আছে ছয়টি প্রার্থী ভ্যাকসিন। অনুমোদনের আগের এই স্তরে থাকাদের মধ্যে; তিনটি প্রার্থী চীনের। দুটি তৈরি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি- সাইনোফার্ম এবং বাকি একটি চীনের বেসরকারি জৈব-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সাইনোভ্যাক বায়োটেক তৈরি করেছে।
অপর তিনটির মধ্যে; একটির গবেষণা চালাচ্ছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটিশ-সুইস মালিকানার ওষুধ প্রস্তুতকারক অ্যাস্ট্রা-জেনেকার বিজ্ঞানীরা। বাকি দুইটি যুক্তরাষ্ট্রের। একটি তৈরি করেছে, মার্কিন ফার্মা জায়ান্ট ফাইজার আর অপরটি মডের্না ইঙ্কের।
পরীক্ষার অবিশ্বাস্য গতি:
গবেষণা প্রক্রিয়ার গতি সম্পর্কে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউডের পরিচালক অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান হিল বলেন, কোনো সংক্রামক ভাইরাস আবিষ্কারের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন পরীক্ষার এই স্তরে চলে আসার ঘটনা নজিরবিহীন দ্রুতগতির। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এর আগে কখনোই তৃতীয় স্তর পর্যন্ত এত দ্রুত আসা সম্ভব হয়নি, বলেও জানান তিনি।
মানবদেহে সংক্রমণ ছড়ানোর প্রথম ঘটনা জানা যাওয়ার মাত্র ৬৭ দিন পর থেকে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
সার্স কোভ-২'র মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা গোত্রের অপর একটি ভাইরাস এইচ১এন১ ২০০৯ সালে দেখা দেওয়ার ৮৯ দিন পড়ে- এটির ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা শুরু হয়।
তারপরেই আছে ২০১৪ সালে দেখা দেওয়া ইবোলা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির প্রচেষ্টা। প্রথম সংক্রমণের ১৬৪ দিনের মধ্যে যা শুরু হয়।
সেই তুলনায় ২০১৫ সালে প্রথম জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এটির ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় বেশ ধীরগতিতে বা প্রায় ৪৫৪ দিন পর।
সংক্ষিপ্ত পথ বেঁছে নিয়েছে যারা:
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে খুব দ্রুত কোনো একটা সমাধান হাতের নাগালে রাখার ইচ্ছে থেকে কিছু দেশ তৃতীয় স্তরের পরীক্ষায় সফল প্রমাণিত হওয়ার আগেই ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। সর্বপ্রথম এ পদক্ষেপ নেয় চীন। জুনের শেষদিকে দেশটি পরীক্ষাধীন একটি ভ্যাকসিন সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রয়োগের অনুমোদন দেয়।
এরপর সেই দৌড়ে যোগ দিয়েছে রাশিয়াও। তবে চীনের বিপরীতে রাশিয়া একে সম্পূর্ণ একটি ভ্যাকসিন বলছে, যা জনগণের মধ্যে ব্যাপকহারে পরীক্ষার অনুমোদনও দিয়েছে দেশটির জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত সপ্তাহে স্পুতনিক-ভি নামের নতুন ভ্যাকসিন নিবন্ধন দেওয়ার কথা জানান। ব্যাপকহারে পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত এটি পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন। কিন্তু, তৃতীয় স্তরের পরীক্ষায় এটি অংশও নেয়নি। মাত্র দুই মাস গবেষণার পর অনুমোদিত এ ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ও ঝুঁকি নিয়ে ইতোমধ্যেই নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, সংক্রামক ব্যাধি এবং টিকা বিশেষজ্ঞগণ।
তাদের অভিযোগ, রাশিয়া নিজস্ব উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন পরীক্ষার কোনো তথ্য প্রকাশ না করেই এটি অনুমোদন দিয়েছে। তাছাড়া, তৃতীয় ধাপের মতো অতি-গুরুত্বপূর্ণ এ স্তর এড়ানোর মাধ্যমে তা গ্রহণকারীদের মৃত্যুঝুঁকিও বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যান্থনি ফসি বলেন, আমি আশা করছি- রুশ বিজ্ঞানীরা সত্যিকার অর্থেই কার্যকরভাবে ভ্যাকসিনটির নিরাপত্তা এবং ফলদায়ক প্রভাব প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা এমনটা করতে পারেননি।
মার্কিন জনগণকে রাশিয়া বা চীনের তৈরি প্রথম ভ্যাকসিন নিয়ে উত্তেজিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ওইসব দেশ থেকে আমাদের ওষুধ প্রশাসনের মানদণ্ড অনেক উঁচু স্তরের। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানদণ্ডের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদিত ভ্যাকসিন অনেক বেশি নিরাপদ ও ফলপ্রসূ হবে, এমন ইঙ্গিতও দেন ফসি।
সূত্র: সিএনএন
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ