ইমরান-উজ-জামান
আপডেট: ১৫:২৭, ৮ নভেম্বর ২০২০
বারদীর রাখের উপবাস
ছবি: ইমরান-উজ-জামান
সকাল থেকেই সারি করে ইট বিছিয়ে রাখা হয়েছে লোকনাথ মন্দিরের আঙিনায় প্রত্যেক ভক্তের জন্য একটি ইট বরাদ্দ। আগে থেকেই নিয়ম করে দেওয়া হয়, যাতে প্রার্থনা প্রার্থীরা অগোছালোভাবে না বসে শৃঙ্খলার সঙ্গে বসতে পারে। দুপুরের পর থেকে শুরু হয় প্রার্থনার প্রস্তুতি আর পুণ্যার্থীদের আগমন। সারি করে রাখা ইটের সামনে পছন্দমতো জায়গায় কলা গাছের খোল বিছিয়ে নিজের জায়গা নিশ্চিত করেন পুণ্যার্থীরা। সূর্য যত পশ্চিমে হেলে যেতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে সোনারগাঁওয়ের বারদী লোকনাথ আশ্রমের ভিড়।
কলাপাতা, ফুল, ধান-দূর্বা, মাটির প্রদীপ, ঘি, ডাব, দুধ ও ধূপদানি ইত্যাদি নিয়ে বসে নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। দুধ ঢেলে, আগরবাতি জ্বালিয়ে উৎসবের সূচনা করে। বাড়ি থেকে আনা ফলমূল কিছুক্ষণের জন্য রাখা হয় লোকনাথের প্রতিমূর্তির সামনে। তারপর সেগুলো নিয়ে উন্মুক্ত ময়দানে সারিবদ্ধভাবে বসে যান সবাই। সামনে কলাগাছের খোলের ওপর রাখা হয় ঘিয়ের প্রদীপ। ঘরের সদস্যদের বিপদ থেকে রক্ষার জন্য প্রার্থনা করা হয়, গুনে গুনে ঘরের সদস্য সংখ্যার পরিমাণ প্রদীপই রাখা হয়। আপনজনের কল্যাণ কামনা করে এই উপবাস করে লোকনাথ ভক্তরা। দুই-চার-দশ-বিশটা পর্যন্ত প্রদীপ দেখা যায়। চারপাশে সাজানো থাকে নানা রঙের কাটা ফল।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে ঘণ্টা। উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে সবাই একযোগে জ্বালাতে শুরু করে প্রদীপ। একসঙ্গে জ্বলে ওঠে শত শত প্রদীপ। ওপর থেকে দেখা সেই দৃশ্য দেখতে স্বপ্নের মতো লাগে। একসময় বাজনা, উলুধ্বনি, ধূপ পোড়ানো ধোঁয়া সব মিলিয়ে আশ্রম এলাকায় এক পৌরাণিক মহাজাগতিক অবস্থা বিরাজ করে। মাটির ছোটো পাত্রে ঘি ও পাতলা সুতি কাচাড় দিয়ে বানানো সলতে জ্বালানোর পিদিম যতক্ষণ জ্বলবে ততক্ষণ ব্রতকার্য চলবে।
ঘি শেষ হতে রাত ৮টা পেরিয়ে যায়, একটা একটা করে প্রদীপ নিভে যায় আর সেই পিদিম পাত্রটা উপুড় করে রাখা হয়। সবগুলো প্রদীপ জ্বলে শেষ হলে সারাদিনের উপবাস ভাঙা হয়। শেষ হয় কার্তিক ব্রত বা রাখের উপবাসের সকল আনুষ্ঠানিকতা।
নারায়ণগঞ্জের বারদীতে আছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির। ঢাকা থেকে গিয়ে গাড়ি থেকে আনন্দবাজারে নেমে দুই কদম হেঁটে পৌঁছতে হবে মন্দির প্রাঙ্গণে, বলা হয় লোকনাথ ব্রক্ষচারী বসে ধ্যান করছিলেন বারদীতে। তার আঙিনা দিয়ে যাচ্ছিলেন দেবী শীতলা। শীতলা জায়গা চাইলেন যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবা লোকনাথ কোনোভাবেই এই এলাকা দিয়ে যেতে দিলেন না। কারণ শীতলা দেবী যে এলাকা দিয়ে যান, সেই এলাকায় বসন্ত রোগ মহামারি আকারে দেখা দেয়।
বাবা লোকনাথ বসতি এলাকা ছাড়িয়ে পুবের আবাদি জমি মাড়িয়ে যাওয়ার কথা বললেন। সেই মতো শীতলা দেবী চলে গেল। সেই থেকে এই কার্তিক পার্বণ প্রচলিত হয়। কলেরা-বসন্তের হাত থেকে বাঁচার জন্য কার্তিক মাসে উপবাস পালন এবং আশ্রম প্রাঙ্গণে ঘিয়ের প্রদীপ ও ধূপ-ধুনা জ্বালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবা লোকনাথ।
‘রাখের উপবাস’ নামে পরিচিত এই অনুষ্ঠানকে ‘কার্তিক ব্রত’ও বলা হয়। দেশের অন্যান্য লোকনাথ মন্দিরেও রাখের উপবাস পালিত হয়। লোকনাথ ভক্তরা সারাদিন উপবাস থেকে তাদের স্বজনদের জন্য বিশেষভাবে প্রার্থনা করেন। বারদী লোকনাথ আশ্রমে এ রাখের উপবাস পালন করার জন্য হাজার হাজার লোকনাথ ভক্তের সমাগম ঘটে বাংলা কার্তিক মাসের ১৫ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত প্রতি শনি ও মঙ্গলবার।
দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বারদীতে লোকনাথ আশ্রমে রাখের উপবাস পালন করতে আসেন লোকনাথ ভক্তরা। মেলা বলতে প্রার্থনায় প্রয়োজনীয় মাটির ধূপধানি, পিদিম পট আর সঙ্গে আছে মাটির হাঁড়িকুড়ি। পাশে কয়েক সারি পেয়ারা, সন্দেশ, কালোজাম, মুরালি, খই, বালুশাইর দোকান। অস্থায়ীভাবে বসা দোকানগুলো ছেড়ে বাজারে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে কিছু লোহালক্কড় ঘেরা দোকান। নিরবধি ডকডাক ডকডাক শব্দ হচ্ছে। এগুলো সরিষা মাড়াইয়ের কল। এখানে পাওয়া যাবে খাঁটি সরিষার তেল। যান্ত্রিক কলে ভাঙানো সরিষার তেল, দামও কিন্তু বেশি না একশ টাকা লিটার। বাজারের পেছনে গিয়ে তাকালে যত দূর চোখ যায় চিরহরিৎ সবুজ শ্যামলিমা।
নারায়ণগঞ্জের বারদীর লোকনাথ আশ্রমের মেলায় ঘটে গ্রাম্য লোকসমাবেশ। এই সমাবেশের প্রায় সবাই প্রার্থনার জন্য আসেন। দেশের তো বটেই বিদেশ থেকেও লোকনাথ ভক্তরা আসেন বাবদীতে, হাজারো ভক্তের আগমন ঘটে মেলায়। হাজারো ভক্তের উপলক্ষ্য করে পসারিরা বাহারি সব পণ্য নিয়ে হাজির হয় মেলায়। লোকনাথ ব্রহ্মচারী নিজে তৈরি করেছিলেন এই আশ্রম. তাই ভক্তকুলের আলাদা আকর্ষণ আছে এই স্থানের প্রতি।
জীবনদশায় একশ ষাট বছরের মধ্যে তিনি বেশি সময় কাটিয়েছেন ধ্যান এবং যোগসাধনায়। হিমালয়ের নির্জন পাহাড়ের গুহা, গভীর অরণ্য, পরিত্যক্ত পর্ণকুটিরে তাঁর এই সাধনা চলেছিল। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি মক্কা, মদিনাও ঘুরে বেড়িয়েছেন। চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের। তিনি সর্বব্যাপী মানুষের কল্যাণ সাধনে মগ্ন ছিলেন আজীবন। সারা বিশ্ব চরাচর চষে অবশেষে তিনি নারায়ণগঞ্জের বারদীতে এসে থিতু হন। ১শ ৬০ বছরের তপস্যা জীবনের বারদীতে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ ২২টি বছর। বাংলা ১২৯৭ সালের ১৯শে জ্যৈষ্ঠ লোকনাথ ব্রহ্মচারী বারদীতে দেহত্যাগ করেন।
বাংলা ১১৩৭ সনের ১৮ই ভাদ্র কলকাতার অদূরে চব্বিশ পরগনার চৌরাশি চাকলা গ্রামে তাঁর দেহাগমন ঘটেছিল। ‘আমি শতাধিক বছর ধরে কত পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে বড়ো রকমের একটা ধন কামাই করেছি। তোরা বসে বসে খাবি। ‘রণে, বনে, জলে, জঙ্গলে যখনি বিপদে পড়বি, আমাকে স্মরণ করবি, তার পরের ভার আমার।’ লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিখ্যাত উক্তি।
শ্রীশ্রীবাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের ঠিক দক্ষিণের উঠোনে, তার সমাধিস্থলের পশ্চিমে, মূল গেটের ঠিক সামনে, পথ আগলে শত বৎসর ধরে কালের নানা ঘটনার সাক্ষী যে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে হলো বিশাল আকৃতির একটি বকুল গাছ। সে আজও তেমনি করে ছায়া দেয়। দেয় অসংখ্য পাপড়িযুক্ত হালকা মাটি রঙা ছোটো ছোটো সুগন্ধি ফুল। আশ্রমের ভেতরে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বিশাল তৈলচিত্র। এখানে সকাল-সন্ধ্যা পূজা হয়। মূল আশ্রমের পেছনে খোলা একটু উঠোন পেরিয়েই বিশাল পাঁচতলা ভবনের যাত্রীনিবাস। পশ্চিমে আরও দুটি বিশালাকার পুণ্যপ্রার্থী নিবাস।পুণ্যপ্রার্থীরা যে কেউ থাকতে পারবে এখানে। এর জন্য কোনো অর্থ দিতে হবে না।
একটু অবাক করণের বিষয়ই বটে, বর্তমান যুগে বিনে পয়সায় রাত যাপন। যে দিগ্বিজয়ী মহামানবের আলোয় আলোকিত এই বারদী তিনি হলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষ শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। প্রাকৃতিক অসম্ভবকে সাধন করার সাধক ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে বহু অলৌকিক ঘটনার কথা বারদী এলাকার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন বা জন্মাষ্টমীর দিন লোকনাথ বাবার জন্ম। তার পিতার নাম রামনারায়ণ ঘোষাল ও মাতা কমলা দেবী। তিনি ছিলেন তাঁর বাবা-মার ৪র্থ সন্তান। বাবার দেওয়া নাম শ্রী লোকনাথ ঘোষাল। সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর নাম রাখা হয় শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী। আর ভক্তবৃন্দ বাবা লোকনাথ বলে ডাকতেন, এখনও ডাকেন।
দীক্ষাগুরু হিসেবে ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় লোকনাথ ও বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায় শিষ্যদ্বয়কে সঙ্গে নিয়ে কালীঘাটে আসেন। ওই সময় কালীঘাট ছিল ঘন জঙ্গলাকীর্ণ একটি এলাকা। জঙ্গলে বসে অনেক সাধু-সন্ন্যাসী নিজ নিজ অভীষ্টে কাজ করতেন। লোকনাথের গুরুজিও তাদেরই কাজে নিযুক্ত করলেন। প্রথমে সারা দিন উপবাস, এরপর সারাদিন-সারারাত উপবাস। এই উপবাসকে বলে ‘একান্তর’। এরপর তিনদিন তিনরাত উপবাস, যাকে বলে ‘ত্রিরাত্র’। এমন করে শেষে টানা ৩০ দিন ৩০ রাত উপবাস, যাকে বলা হয় ‘মাসাহব্রত’। শেষে গুরুদেব তাদের গায়ে চিনি ছিটিয়ে পিঁপড়া ডেকে এনে পরীক্ষা করেন, তাদের ধ্যান ভঙ্গ হয় কি না। পরীক্ষায় তারা সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ভগবান চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাদের নিয়ে বারাণসী গমন করে যোগাবলম্বনে দেহত্যাগ করার পূর্বে।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ