শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১৩:২৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
রোড অব বোনস: রাশিয়ার কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে থাকা একটি রোড
বলশেভিকদের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত ঘুমিয়ে আছে ‘রোড অব বোনস’-এর গভীরে
‘রোড অব বোনস’ এই তিনটি শব্দ লিখে ইন্টারনেটে সার্চ দিলে সামনে চলে আসে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি নির্মম গল্প। সোভিয়েত জামানার ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে ‘রোড অব বোনস’। যেই স্মৃতির পরতে পরতে রয়েছে তৎকালীন রাশিয়ার বন্দিশিবিরের বন্দিদের হাড়গোড়। আজকের লেখায় রাশিয়ার ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়টি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
রাশিয়ার উত্তর পুর্বে সাইবেরিয়ার ইয়াকুটস্কের নিকটবর্তী এক হাইওয়ে রয়েছে। যেখানে গেলে চোখে পড়বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল। এগুলো নকল নয়, আসল কঙ্কাল। কোথাও মাথার খুলি, কোথাও হাত-পা বা শরীরের অন্য অংশের হাড়ের টুকরো প্রায় গোটা রাস্তাতেই ছড়িয়ে রয়েছে।
এই মানুষের হাড়গোড় ছড়ানো পথটিই ইতিহাসে ‘রোড অব বোনস’ নামে জায়গা নিয়েছে। অবশ্য এর অন্য নাম আর৫০৪ কোলাইমা হাইওয়ে।
স্তালিন জমানায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে এই হাইওয়ে নির্মিত হয়েছিল। জানা যায়, এই রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল সেভভোস্তলাগ লেবার ক্যাম্পের বন্দিদের শ্রম।
১৯৩২ সালে এই রাজপথের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয় যা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তা চলে। আর এতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল গুলাগ বা বন্দিশিবিরের আবাসিকদের শ্রম। অনুমান করা হয়, এই পথ তৈরি করতে গিয়ে বহু মানুষ মারা পড়েন। তাঁদের হাড়গোড় এই রাস্তার নীচেই চাপা পড়ে যায়।
এ রাস্তাটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল সেভভোস্তলাগ লেবার ক্যাম্পের বন্দিদের শ্রম
গ্রীষ্মে এই অঞ্চলটি আর্দ্র এবং অস্বাস্থ্যকর। শীতকালে অসম্ভব ঠান্ডার কারণেও এখানে তেমন ভাবে মানব বসতি গড়ে তোলা যায়নি। এই দুর্গম জায়গাতেই গুলাগে আটক মানুষদের দিয়ে তৈরি করা হয় এই হাইওয়ে। সেই কারণে এই রাজপথ আজ সোভিয়েত জমানার এক লজ্জাজনক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিবেচিত।
স্তালিন জমানার গুলাগে আটক মানুষের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার স্মারক এই পথ আজ যেন এক জীবন্ত মিউজিয়াম। কোলাইমা অঞ্চলের গুলাগে বন্দি ছিলেন কবি ভারলাম শালামভ। মুক্তি পাওয়ার ১৫ বছর পরে তিনি সেই বন্দিজীবনের স্মৃতিকথা ধরে রাখেন ‘কোলাইমা টেলস’ নামক গ্রন্থে।
শালামভ জানিয়েছেন, এই গুলাগে ৩ সপ্তাহ বাস করলে অতিরিক্ত পরিশ্রম, ঠান্ডা, খিদে এবং প্রহরীদের নির্যাতনে মানুষ পশুতে পর্যবসিত হয়। স্তালিন জামানা অতিক্রান্ত হলে গুলাগের জ্বলন্ত স্মৃতির উপরে প্রলেপ দিতে প্রচার করা হতে থাকে সোভিয়েত রাশিয়ার সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার কিংবদন্তি। কোলাইমা-সহ বহু গুলাগের এক সময়ের বন্দিরাও সেটা মেনে নেন।
শীতকালে এখানে অসম্ভব ঠান্ডায়, কম আহারে পোকামাকড়ের মতো মারা যেতেন বন্দিয়া
কোলাইমার গুলাগে বন্দিদের অনেক সময়েই নিকটবর্তী টিন বা অন্যান্য খনিতে কাজ করতে বাধ্য করা হত। অতিরিক্ত শ্রমে, ঠান্ডায়, কম আহারে পোকামাকড়ের মতো মারা যেতেন তাঁরা। তাঁদের অনেকের দেহাবশেষই আজ ‘রোড অব বোন’-এর নীচে বলে অনুমান করা হয়।
আজও রাশিয়ায় এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা স্তালিনকে ‘দেবতা’ বলে মানেন। তাঁদের মতে, যে নির্যাতন সাধারণের উপরে হয়েছে, তার জন্য দায়ী পার্টি ও দলের নেতারা। শালামভের স্মৃতিকথাকেও অনেকে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। আজকের স্তালিনভক্তরা তাকে আগাগোড়া কল্পিত বলে দাবি করেন।
গুলাগের স্মৃতি ধরা রয়েছে আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিনের মতো সাহিত্যিকের রচনাতেও। সুতরাং গুলাগের ভয়াবহতাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাশিয়ার উত্তর পূর্বের শহর মাগাডানের সঙ্গে লেনা নদীর তীরে নিঝনি বেস্টিয়াখ শহরকে সংযুক্ত করেছে ‘রোড অব বোনস’। গুলাগের ভয়াবহতাকে গণস্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য মাগাডানে রয়েছে একটি গুলাগ মিউজিয়াম।
আজও রাশিয়ায় অনেকেই স্তালিনকে ‘দেবতা’ বলে মানেন
১৯৯০ সালের দশকে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের আমলে ‘রোড অব বোনস’-এর মুখেই তৈরি করা হয় ‘মাস্ক অব সরো’ নামের একটি কংক্রিট ভাস্কর্য। কোলাইমার অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের স্মারক এই ভাস্কর্য।
সম্প্রতি আবার গুলাগের ভয়াবহতাকে উস্কে দিয়েছে ‘রোড অব বোনস’থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছু নরকঙ্কাল। অনুমান, ১৯১৭-১৯২২ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে মৃত ব্যক্তিদের কঙ্কাল সেগুলি।
অর্থাৎ শুধু গুলাগের দুঃখজনক স্মৃতি নয়, এই অঞ্চলের মাটির নীচে রয়ে গিয়েছে রুশ ইতিহাসের আর এক রক্তক্ষয়ী সময়ের ইতিহাসও।
সব মিলিয়ে, ‘রোড অব বোনস’ সোভিয়েত নির্যাতনের এক বহমান স্মারক। আর সাম্প্রতিক আবিষ্কার তার সঙ্গে যোগ করল বলশেভিক রাজ প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকের এক রক্তাক্ত অধ্যায়কেও। রাজতন্ত্রবাদী, বিদেশি শক্তি এবং সমরনায়কদের যৌথশক্তির সঙ্গে বলশেভিকদের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত ঘুমিয়ে আছে ‘রোড অব বোনস’-এর গভীরে।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ