শামীমা রিতু
আপডেট: ১৩:০৪, ৩০ নভেম্বর ২০২০
খনার কথা (প্রথম পর্ব)
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর , অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর'। কবির কথার সত্যতা ইতিহাসের দিকে একবার মুখ ফেরালেই দেখা যায়। এই পৃথিবীতে যতো ইতিহাস রচিত হয়েছে তার মাঝে রয়েছে নারীরও ভূমিকা। বহু নারী তাদের জ্ঞান দ্বারা পূর্ণ করেছেন মানব সভ্যতাকে। পুরুষের পাশাপাশি তারাও গেয়েছেন মানব সভ্যতার জয়গান। তেমনি একজন নারীর সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করবো আজকের লেখায়।
ভারতবর্ষ-পৃথিবীর আদি এক ভূখন্ড। ভরত রাজার দেশ, জম্মুদ্বীপ কিংবা ইন্দুস/ সিন্ধু পাড়ের ভূমি থেকে ইন্ডিয়া। ইতিহাস যে নামেই ডাকুক না কেন সুবিশাল এই ভারতীয় উপমহাদেশে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা, যাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে পৃথিবী। হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর, কাঞ্চনজঙ্গা থেকে ভারত মহাসাগর সবখানেই রয়েছে নারীদের গৌরবময় কৃতিত্ব। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে এই উর্বরভূমির নারীরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় কম যান নি। গার্গী, লীলাবতী, চন্দ্রাবতী সকলেই ছিলেন ভারতীয় কুলবধু। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
“হেথা আর্য,হেথা অনার্য,হথোয় দ্রাবিড়-চীন
শক, হুন, পাঠান, মোগল এক দেহে হলো লীন”।
প্রবাদ –প্রবচন সাহিত্য-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন একটি শাখা। যেকোন প্রবাদ – প্রবচনেই সেই দেশের বা জাতির সমাজ চিত্র ফুটে উঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচনের মধ্যে অন্যতম হলো ‘খনার বচন”।
কিন্তু কে ছিলেন এই খনা ?
খনার পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রূপকথা প্রচলিত থাকলেও ইতিহাস পর্যালোচনায় এটা প্রমাণিত হয় যে ,খনার প্রকৃত নাম ছিল ‘লীলাবতী”। তার পিতা ছিলেন অটনাচার্য। রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার ‘নবরত্নের” অন্যতম সদস্য বিখ্যাত পন্ডিত ‘বরাহ’ এর পুত্র ‘মিহির’ ছিলেন খনার স্বামী। (*খনার বচনে বরাহ কে শ্বশুর ও মিহিরকে স্বামী বলা হয়েছে)। খনার জীবন যেমন রহস্যময় তেমনি তার রচনাও ছিল হেয়ালিভরা। তাই সঠিক তথ্য উদঘাটনে বেশ বেগ পেতে হয়। নিম্নে খনা সম্পর্কিত কিছু চলমান রূপকথা তুলে ধরা হলো –
উড়িয়া পুরান
উড়িয়া পুরান অনুসারে, রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্সেন অন্যতম জ্যোতির্বিদ – পন্ডিত বরাহ একমাত্র পুত্রের জন্ম গণণায় দেখেন যে অকাল মৃত্যু যোগ রয়েছে। তাই পুত্রকে রক্ষার উপায় হিসাবে নবজাতককে বাক্সে ভরে স্রোতে ভাসিয়ে দেন। সে একটি দ্বীপে স্থান পায় এবং দ্বীপবাসী তাকে লালন পালন করে।
একই সময়ে রাক্ষসরোষে পলাতক রাজকন্যা লীলাবতীও সেই দ্বীপে বাস করেন এবং উভয়েউ বিভিন্ন শাস্ত্রে পান্ডিত্য লাভ করেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে অধিক পান্ডিত্যের কারনে লীলা মিহিরের পরিচয় পান এবং উভয়ে শুভক্ষণে দ্বীপ থেকে পালিয়ে উজ্জয়নীতে বরাহের কাছে আসেন। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পরে খনার পান্ডিত্যে বরাহ মেনে নেন এবং পুত্ররধূ রূপে গ্রহণ করেন।
এক সময় লীলার জ্যোতিষজ্ঞান বিস্তৃত হয় এবং লোকমুখের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত রাজসভাতেও লীলার স্থান হয়। এতে শ্বশুর বরাহ অপমান বোধ করেন এবং পুত্রকে বলেন লীলার জিহ্বা কর্তন করতে। জিহ্বা কর্তনের পূর্বে শ্বশুরের অনুমতি নিয়ে লীলা মানব জীবন ও কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন উপদেশ বলে যান এবং পরে নিজেই নিজের জিহ্বা কর্তন করেন। এরপর থেকেই লোকমুখে লীলার কথা ‘খনার বচন’ হিসাবে পরিচিতি পায়। ‘খনা’ অর্থ ‘বোবা’। খনার বচন অর্থ ‘বোবার বচন”।
বাংলাদশে খনা সম্পর্কিত চলমান রূপকথা
এদিকে আমাদের দেশীয় পুরান অনুসারে, লীলা ছিলেন সিংহল (বর্তমান শ্রীলংকা) এর রাজকন্যা। একসময় রাক্ষস আক্রমণে লীলার পরিবারের সকলে মারা যান এবং লীলা পালিয়ে দ্বীপে আশ্রয় নেন।একই সময়ে বরাহপুত্র মিহিরও ভাগ্যদোষে দ্বীপে পতিত হন। লীলাবতী ও মিহির একে অপরকে প্রণয় ও পরিণয়ে আবদ্ধ হন। জ্যেতিষ ও ভূগোল শাস্ত্রে লীলার ছিল অগাধ জ্ঞান।একসময় এই জ্ঞানধারাই লীলা তার পরিচয় জানতে পারেন এবং উজ্জয়িনীতে ফিরে এসে মিহিরের পরিচয় দিয়ে বরাহের ভুল ধরিয়ে বলেন-
‘কিসের তিথি কিসের বার, জন্ম নক্ষত্র করো সার,
কি করো শ্বশুর মতিহীন, পলকে জীবন বারো দিন।’
বরাহের হিসাব মতে ধারনা ছিল জন্মের এক বছরের মধ্যেই পুত্রের মৃত্যু ঘটবে। কিন্তু তিনি জানতের না সে গননা ভুল ছিল। এরপর বরাহ লীলাকে পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নেন। লোকমুখে লীলার প্রশংসা শুনে রাজা বিক্রমাদিত্য লীলাকে রাজসভার দশম পন্ডিত নিযুক্ত করলে বরাহ তাতে অপমানিত ও ক্ষিপ্ত হন। তিনি পুত্রবধূর জিহ্বা কর্তনের নির্দেশ দেন। লীলা তার সমস্ত কথা বর্ণনা করে নিজেই জিহ্বা কর্তন করেন এবং অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। পরবর্তী এই সব কথাই খনার বচন বা বোবার কথা হিসাবে ব্যাপক প্রচারিত হতে থাকে। *কথিত যে সেই জিহ্বার খন্ডিত অংশ ঠিকঠিকি খেয়ে নেয় এবং গুপ্ত জ্ঞান লাভ করে।
খনার প্রকৃত ইতিহাস
তবে এসবতো গেল পৌরানিক কথা, এখন আসি প্রকৃত ইতিহাসে- ইতিহাস অনুসারে খনার বসত হলো পশ্চিমবঙ্গের (প্রাচীন গঙঙ্গারিডই/কালান্তরে প্রাচীন যশোহর জেলা) চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাত মহকুমার দেগংগা থানার নিকটে দেউল নগরের কাছে বেড়াচাঁপার দেউলী গ্রামে।
রাজা ধুমকেতুর প্রপৌত্র রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনামলে এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তখন থেকেই স্থানটিকে স্থানীয় লোকজন ‘দেউলী’ বলে অভিহিত করে আসছেন। এখানে রাজবাড়ির অদূরে একখন্ড জমিকে বরাহ ‘মিহিরের বাস্ত’ নামে লোকে অভিহিত করে থাকে। ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন অবশ্য অনেক আগেই এ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে, খনার স্বামী মিহির অধুনা বিলুপ্ত চন্দ্রপুর নামক স্থানে দীর্ঘদিন বাস করেছিলেন, এটা ছিলো চন্দ্রকেতু রাজ্যে অবস্থিত একটি গড়।এ কারণে এটা জোর দিয়ে বলা যায় খনার জন্ম বাংলাদেশেই হয়েছিলো।
ড.দীনেশ চন্দ্র সেনের বর্ণনা মতে চন্দ্রকেতুর রাজভবনের পাশে এখনো একটি উঁচু মাটির স্তুপ দেখা যায় যে জায়গাটিএখন জঙ্গল হয়ে আছে এবং স্থানীয় লোকদের ধারণা এটাই মিহিরের বাসস্থান ছিলো।ওখানকার লোকেরা বংশ পরম্পরায় এ কথা বিশ্বাস করে আসছে। খনার বচনের উৎপত্তিস্থল চন্দ্রপুর বা চন্দ্রগড় হোক বা নাই হোক খনাকে নিয়ে এই স্থানটিতে লোকশ্রুতি প্রচলিত হওয়ায় স্থানটি বিখ্যাত হয়ে আছে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘চন্দ্রকেতু গড় যে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার হইয়াছে, তাহা দেখিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, স্থানটি ভারতের অতি পুরাতন স্থানগুলির অন্যতম।’ শুধু এইা স্থানটি খনা এবং মিহিরের বসবাসরে কারণে সুপ্রাচীন স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এটাকে অনেকে তীর্থস্থান হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ড. কল্যাণ কুমারের ভাষায় চন্দ্রকেতু গড় পূর্ব ভারতের এক সুমহান তীর্থ ক্ষেত্র রূপে জাগ্রত হয়ে আছে। এই ধরনের কথা আরো বহু পন্ডিত বলেছেন। খনা মিহিরের বাসভবন বলে কথিত স্থানটিকে যুগে যুগে ‘খনা মিহিরের ঢিপি’ বা ‘পোঁতা’ বলে আসছে। যা সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান।
আবার ড. আব্দুল গফুর সিদ্দিকী খনা সম্পর্কে গবেষণার জন্য প্রায় ১২০০ খনার বচন সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তার কলকাতার বাড়ি পোড়ানো হলে সেসব গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও পুড়ে যায়।
ড. আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর মতে, খনার জন্ম ছিল পূর্ব বঙ্গে এবং বিবাহ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের দেউলনগরে। কেননা, খনার বচনের ভাষা এবং স্থানিক আবহাওয়া সহ অন্যান্য বিচারে ডা.মেরাজ উদ্দিন আহমদ, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী,শ্রী দেবকুমার চক্রবর্তী ,ড.কল্যাণ কুমার গঙ্গোপপাধ্যায়,রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় সহ প্রমুখ পুরাতত্ত্ববিদ ও পন্ডিতগণ এই মত সমর্থন করেন।
তবে খনার জিহ্বা কর্তন/মৃত্যু নিয়ে কয়েকটি যুক্তি রয়েছে যা অনেকটা অকাট্য – যেমন,
- খনার ভবিষ্যৎবানীর কারনে শ্বশুর বরাহের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া।
- খনার বচনে ব্রাহ্মণবিদ্বেষ (*একসময় ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ গীতা শুনতে ও পড়তে পারতো না। কেউ তা করলে জিহ্বা কর্তন ও কানে সীসা ঢালা হতো।)
- কারো মতে, খনা ছিলেন চার্বাকের অনুসারী নাস্তিক।(*খনার বচনে কোন অলৌকিকতা নেই এবং ঘোর বাস্তবতার প্রকাশ)
- কারো মতে তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ভিক্ষুণী। যা বরাহ মেনে নিতে পারেন নি। (*জ্যোতিষ শাস্ত্রের ইতিহাসে খনার উল্লেখ নেই)।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘আর্কিওলজি অব ইন্ডিয়ার’ রিপোর্টে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক অধীক্ষক/প্রধান লং হাস্ট স্পষ্টভাবে ইতিহাসে প্রাপ্ত তত্বাবলি পর্যবেক্ষণ,স্থান ও জলবায়ুর বর্ণনা, কৃষিজপণ্যের বর্ণনাখনার বচনের অর্থিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সহ সার্বিক বিবেচনায় খনাকে গুপ্তযুগের রমনী এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার বাসিন্দা, বরাহেরর পুত্রবধূ ও মিহিরের স্ত্রী হিসাবেই উল্লেখ করা হয় এবং সমস্ত কিংবদন্তী ছাপিয়ে লীলাবতী – খনা ইতিহাসে অক্ষয় আসন পান।
চলবে…
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ