হেলাল আহমেদ
তারামন বিবির কতোকথা
প্রতীকী ছবি
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা। সারাদেশে যুদ্ধে চলছিলো। যুদ্ধ চলছিলো কুড়িগ্রাম জেলার আনাচে কানাচে। একদিন দুপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল খেতে বসেছিলো। সবাই খেতে বসলে তাদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য বলা হলো এই দলের একমাত্র কিশোরী যোদ্ধাকে। যার বয়স তখন মাত্র চৌদ্দ কী পনেরো বছর। কিন্তু বুকে অনেক সাহস জমা।
পাকিস্তানি সেনারা আসছে কিনা তা দেখার জন্য সেই কিশোরী সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷ হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি দল গানবোটে করে তাদের দিকে আসছে৷ এই খবর সাথে সাথে দিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তানীরা এদিকে আসছে খবর পেয়ে সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। মনে মনে সবাই একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। সবার সাথে প্রস্তুত সেই কিশোরীও। সরাসরি তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন কিশোরী। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, সেই মেয়েটি ভয়ে টু শব্দটিও করলেন না। বরং সাহস বুকে সবার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন।
মুক্তিযুদ্ধের গল্পের মতো শোনালেও এই গল্পটি সত্যিকারের একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প। যিনি তাঁর নারীত্বের সীমাকে ডিঙিয়ে অন্য দশটা পুরুষের মতোই মাতৃসম দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর নাম তারামন বিবি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরী সেই তারামন আজ বয়সের ভারে তারামন বিবি হয়েছেন। অর্জন করেছেন জীবনের উচ্চ পর্যায়ের সম্মান। একজন নারীও যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে, বীরপ্রতিক খেতাব পেতে পারে তারই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন তারামন বিবি। যেজন্য তারামন বিবি একটি বীরত্বপূর্ণ নাম।
মক্তিযুদ্ধের কিশোরী সৈনিক তারামন বিবি
তারামন বিবির জন্ম একটি বীরত্বপূর্ণ নাম। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর গ্রামে আবদুস সোবাহান এবং কুলসুম বেওয়ার ঘরে ১৯৫৭ সালে জন্ম তাঁর। তারামন বিবির প্রকৃত নাম মোছাম্মৎ তারামন বেগম। মুক্তিযুদ্ধে দেশের হয়ে কাজ করেছেন নানা ভূমিকায়। সিনেমার মতোই বাস্তব জীবনে অভিনয় করেছেন ভয়ংকর সব মুহূর্তে। সাহসিকতা এবং বীরত্বের জন্য ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার ‘বীর প্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করেন৷
যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে গেলেন তারামন বিবি
তারামন বিবির যুদ্ধের ময়দান ছিলো ১১ নম্বর সেক্টরে। সেটা ছিলো তাঁর নিজ গ্রাম কুড়িগ্রাম জেলার শংকর মাধবপুর৷ সেখানে মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধাই তাকে প্রথম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বলেন। তিনি তারামন বিবিকে উৎসাহিত করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।
মুক্তিযোদ্ধা মুহিব হালদারদের ক্যাম্প ছিলো তারামন বিবির গ্রামের পাশেই৷ তাই তিনি তারামনকে সেই ক্যাম্পে রান্নাবান্নার প্রস্তাব দেন৷ তবে এতে আপত্তি তোলেন তারামনের মা। তিনি মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে কাজ করতে রাজি হলেন না।
তারামন বিবি জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছে একই তারিখে
পরে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন৷ এরপরই তারামনকে দশঘরিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন তাঁর মা৷ তখন তারামনের বয়স ছিলো ১৪ বছর৷
সেখানে তারামন রান্নার কাজে গেলেও ক্রমশ তাঁর সাহসিকতার প্রকাশ ঘটতে থাকে। অল্প সময়েই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় হয়ে ওঠেন তারামন। নিজেও ধীরে ধীরে হয়ে ওঠতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সৈনিক। তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা মুহিব হাবিলদার অস্ত্র চালনাও শিখিয়ে দেন তারামনকে।
বহুরূপী যোদ্ধা কিশোরী তারামন
নানান সময় ক্যাম্পের পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারামন। সম্মুজ যুদ্ধ ছাড়াও ছলেবলে নানা কৌশলে শত্রু পক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজেও যুদ্ধ করেছেন। কখনো পাগল সেজে সোজা চলে গেছেন পাক বাহিনীর শিবিরে৷ কখনও চুল এলোমেলো সেজেছেন বোবা। তারপর পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷
আবার কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷ আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী৷ আর জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য৷
কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে
হারিয়ে গিয়েছিলেন তারামন বিবি
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবিকে তার সাহসীকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর প্রতীক” উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে প্রথম তার সন্ধান পান। এ কাজে বিমল কান্তিকে সহায়তা করেন কুড়িগ্রামের রাজীবপুর কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী।
এরপর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সংগঠন তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেই সময় তাকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন। তারামন বিবিকে নিয়ে আনিসুল হকের লেখা ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ নামক একটি বই রয়েছে। আনিসুল হক রচিত ‘করিমন বেওয়া’ নামক একটি বাংলা নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তারামন বিবি।
তারামন বিবি মৃত্যু হয়েছে যে তারিখে জন্ম হয়েছিলো সেই তারিখেই। ২০১৮ সালের ১ লা ডিসেম্বর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা এই মহিয়সী নারী পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যান।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ