হাসানাত কামাল
আপডেট: ১৭:০৩, ১ ডিসেম্বর ২০২০
মহারাসলীলা উৎসব : বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির এক অপরূপ ঐতিহ্য
ছবি: রণজিৎ জনি
ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো মনিপুরি মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব। ছন্দ-গীত আর ভাইটল রাতে রমণীদের মাতমের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ক্ষুদ্র নৃ-তাত্বিক জনগোষ্ঠী মনিপুরি সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় বর্ণিল এই উৎসবটি।
মহামারি করোনা থেকে মুক্তির প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠা মনিপুরি সম্প্রদায়ের এই মহারাসলীলা উৎসব।
সোমবার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে মনিপুরি কিশোরদের অংশগ্রহণে কৃষ্ণের বাল্যলীলা অনুস্মরণে গোষ্ঠলীলা ও রাখাল নৃত্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মনিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব।। গোধূলী লগ্ন পর্যন্ত চলে এ পরিবেশনা।
হেমন্তের রাতে দ্বিপ্রহরের চাঁদ। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথি। ধবল জ্যোৎস্নায় মন্ডপগুলো পুরোটাই উদ্ভাসিত। অপরূপ সাজে মনিপুরি তরুণীদের আবেগী ঢঙে অবস্থান। শুরু হয় রাসনৃত্য। তুলে ধরা হয় রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী।
আয়োজকরা জানান অসাম্প্রদায়িকতার মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠেছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের এই মহারাসলীলা উৎসব। মৌলভীবাজারের মহারাসলীলা উৎসব সময়ের সাথে সাথে এদেশের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ।
প্রতি বছরের মতো এবারও মাধবপুর জোড়ামণ্ডপে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ১৭৮তম রাস উৎসব। আর মৈথৈ সম্প্রদায়ভুক্ত মনিপুরিরাও ১৯৮৬ সাল থেকে আদমপুরে রাসমেলার আয়োজন করে আসছে।
করোনার কারণে এবারের রাস উৎসব ছিলো অনেকটাই সংক্ষেপিত। মহামারি কাটিয়ে আগামীর শুভ প্রত্যাশায় ভক্ত-অনুরাগীরা।
মনিপুরি লাস্যময় রাস নৃত্য উৎসব
ঢোল-করতালে রাসধারী গোপীনিদের লাস্যময় মৃদঙ্গ নৃত্য। মৃদঙ্গেঁর সুরে দাদরার তান। ছন্দের তালে অপরূপ সাজে মনিপুরি তরুণীদের আবেগী ঢঙে অবস্থান। চলতে থাকে নৃত্যগীতি। সেই সাথে মনিপুরি বন্ধনাগীতি। হেমন্তের রাতের দ্বিপ্রহরের চাঁদ ধবল জোছনা। মন্ডপগুলো পুরোটাই উদ্ভাসিত। কার্তিকের পূর্ণিমা তিথি। ঠিক সে সময়ে শুরু হয় মহারাসলীলা।
মনিপুরি তরুণীরা প্রদীপ প্রজ্বলিত হাতে কৃষ্ণের রাধিকারূপে অবস্থান করেন। মন্ডপজুড়ে তখন যুবতীরা উলুধ্বনিতে মুখরিত অভ্যর্থনা জানায়। রাধিকা এক সময় মঞ্চ ত্যাগ করেন। তারপরই কৃষ্ণরূপে বাঁশি হাতে উপস্থিত হন এক কিশোর। তার বাঁশির সুর উপস্থিত সকলকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে। সেই সুরের মাধুর্য্যে বিচলিত হয়ে পুণরায় অসংখ্য সখী ঘিরে ব্রজগোপীর রাসনৃত্য আস্বাদন ক্রিয়া। নৃত্যগানে সুরের তরঙ্গ ধ্বনি আর অভিনয়ের অনবদ্য প্রকাশ উপস্থিত সকলকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে।
পরিবেশিত হয় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলানুকরণ পালা। গোপীগণকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে বিমুগ্ধ বিহার, যমুনা পর্ব, কৃষ্ণের অন্তর্ধান। গোপীবধু আর কৃষ্ণের পদচিহ্ন ধরে একাকী রোদনরত গোপীবধুকে খুঁজে পাওয়া। কৃষ্ণ বিরহে ব্রজগোপীগণের রোদন। বিরহ কাতর চিত্তে ১১টি শ্লোকের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি বন্ধনা করা হয়। কৃষ্ণের বিচিত্র মহিমা শক্তির স্তুতি গীত পরিবেশিত হয়।
এভাবে দ্বিপ্রহর রাত ঘনিয়ে ভোরের আলো ফোটতে না ফুটতেই মনিপুরি যুবক যুবতীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শ্রীকৃষ্ণের বিদায়ে। একটি বছরের জন্য শ্রীকৃষ্ণকে বিদায় জানিয়ে সকলেই ফিরে আসেন নিজ নিজ ঘরে। এভাবেই উদযাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসব।
রাসের উৎপত্তি
প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘ না দেখিলে রাস, মিটবে না মনের আশ (আশা)। রাসে আনন্দ আছে। আনন্দে রস আছে। কিন্তু এ রস দৃশ্যমান নয়। কেউ কেউ এ রস আস্বাদন করে থাকেন হৃদয় দিয়ে। এই হৃদয়ও অদৃশ্য। ... অদৃশ্য রসের দৃশ্যমান প্রকাশই হলো রাস।’
মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেছিলেন। আর মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রাসলীলার যাত্রা শুরু হয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই মনমুগ্ধকর উৎসবটি তাই মাধবপুরই শুধু নয়, উৎসব-পার্বণ হিসেবে মৌলভীবাজারের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে।
রাস শব্দের উৎপত্তি এবং নৃত্যের কিছু তথ্য
জগৎপতি কৃষ্ণের ১২ ধরণের রস থেকেই এই রাস শব্দের উৎপত্তি। আর এই রাসের সঙ্গে মেলা যুক্ত হয়ে ‘রাসমেলা’। এই ১২টি রসের মধ্যে আবার সাতটি রস হচ্ছে গৌণ। আর পাঁচটি রস হচ্ছে মুখ্য। এই পাঁচটি রসের মধ্যে আবার তিনটি রস হচ্ছে প্রধান। এগুলো হচ্ছে সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এই তিন রসের উপস্থাপন করা হয়ে থাকে রাসলীলায়।
আবার মণিপুরী সমাজে প্রচলিত রাসনৃত্যকে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো, শারদীয় মহারাস, বসন্তু রাস, নিত্য রাস, কুঞ্জ রাস, গোপী রাস এবং উদখুল রাস। এর মধ্যে শারদীয় মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা সংঘটিত লীলাসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলেই একে মহারাস লীলা বলা হয়ে থাকে। প্রতিবছর শারদীয় পূর্ণিমা তিথিতে মাধবপুরের জোড়ামন্ডপে এই মহারাস লীলানুকরনের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
রাসলীলার ১০টি অঙ্গ
প্রথম- বংশীধ্বনি, দ্বিতীয়- সংজল্পন, তৃতীয়- রমনখেলা, চতুর্থ- অন্তুর্ধান, প ম- আবির্ভূত আসনে বসন, ষষ্ঠ- প্রশ্ন কুটোত্তর, সপ্তম- নৃত্যল্লাস, অষ্টম- কুঞ্জেরহ, নবম- বাড়িখেলা ও দশম- বনর্বিহরনম। রাধা গোবিন্দের লীলার ৪ প্রকার বিরহ এবং ৪ প্রকার মিলন হয়: বিরহ হলো: ১. পূবরাগ, ২. প্রেমবৈরিত্য, ৩. মান ও ৪. মাথুর। মিলন হলো:- ১. সংক্ষিপ্ত, ২. সম্পন্ন, ৩. সম্পূর্ণ ও ৪. সমৃদ্ধিমান।
মাধবপুর জোড়ামন্ডপের রাসলীলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়। অন্যদিকে উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের আদমপুরে রাসমেলার আয়োজন করেন মণিপুরী মৈতৈ সম্প্রদায়। দুই জায়গাতে আয়োজন হলেও উৎসবের মর্মবাণী সেই একই। আয়োজকরা জানালেন, রাসলীলার মূল বাণীতে রয়েছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্য সুন্দর মানবপ্রেমের কথা।
আইনিউজ/এইচএ
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ