Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ১৩ ১৪৩২

শামীমা রিতু

প্রকাশিত: ১৯:৫৮, ৬ ডিসেম্বর ২০২০
আপডেট: ১৬:০১, ৭ ডিসেম্বর ২০২০

খনার কথা (দ্বিতীয় পর্ব)

ছবি: অনলাইন

ছবি: অনলাইন

কিভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী একজন মহিলার মুখ থেকে উচ্চারিত বাণী শুধু বাংলাদেশে নয়,ভারতবর্ষের একটা বিরাট অংশে ছড়িয়ে পড়লো আর যুগ যুগ ধরে তা মানুষের স্মৃতিতে জেগে রইলো? তা সত্যিকার অর্থেই ভাববার বিষয়। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তৎকালীন সমাজে খনার বচনের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিলো।

খনার বচনের অস্তীত্ব সুদূর আসাম থেকে কেরালা পর্যন্ত বিস্তৃত। হোরাশাস্ত্র সম্পর্কিত গ্রন্থগুলোতে খনার বচনগুলোতে এর প্রমাণ মিলে।আবহাওয়া সম্পর্কিত খনার বচনগুলো বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যাতে প্রায় একই রকম। বিহারে কিছু বচন আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হলেও মূলত এগুলো খনার বচনেরই অনুবাদ মাত্র।এইগুলো নিয়ে বিহারে একাধিক সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।

খনার মৃত্যুর প্রায় চারশ বছর পর বাঙালি জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের ‘পঞ্চস্বর’ ও ষষ্ঠী দাসের গ্রন্থে খনার বচনের উল্লেখ দেখা যায়। খনার সমসাময়িক কিংবদন্তী রাজা বিক্রমাদিত্য এ কথাও আজ প্রমাণিত।খনার ঢিপি থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্মতাত্বিক নিদর্শন থেকে জানা গেছে এগুলো গুপ্তযুগের। এখানে প্রাপ্ত মুদ্রা এবং দেয়ালের গায়ে রাজা-রাণীর উৎকীর্ণ বিবাহ চিত্র প্রভৃতি তা ই নির্দেশ করে।

কিন্তু ১৪ এবং ১৫শ’ শতকের রচিত যেসব গ্রন্থে খনার বচনের উল্লেখ দেখা যায়,এতে মনে হয় খনা চতুদর্শ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বের লোক ছিলেন। তিনি তাহলে কি চতুদর্শ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর ও আগে কযেক শতাব্দী ডিঙিয়ে গিয়েছেন হয়তো এমনটাই হবে, না হলে খনার বচনে বৈষ্ণব মতবাদ,ভক্তিবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ইঙ্গিতও নেই, সেন আমলের জ্যোতিষ শাস্ত্র ছিলো ধর্ম নির্ভর কিন্তু খনার বচনে দেবদেবীর উল্লেখ নেই, আধ্যাত্মবাদও তার বচনে অনুপস্থিত, ব্রাহ্মণবাদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ, মায়াবাদ ও সন্ন্যাসবাদের কোনো প্রভাব নেই। এ কারণে অনেক গবেষক মনে করেন খনার কাল ছিলো মাধবাচার্য এবং শংকরাচার্যেরও পূর্বে। তা না হলে বৈদিক ধর্ম প্রচারের প্রবল তোড়ে খনার বচনগুলো ভেসে যেতো।

গবেষকদের ধারণা খনা সপ্তম শতাব্দীর লোক যখন বৌদ্ধ, জৈন, শাক্ত, শৈব, সাহজিয়া, বাউল, তান্ত্রিক,নাথ এবং চার্বাক-নাস্তিক্যবাদের ঘোরে সমাজ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো তখন খনার উদ্ভব। খনার বচনে অলৌকিকত্ব নেই। কুসংস্কার ও খনার বচনকে আবিষ্ট করতে পারেনি। বচনগুলো অধিকাংশই বাস্তবধর্মী ও ভাষাগত ব্যাকরণভিত্তিক। উড়িয়া এবং বাঙালিরা উভয়েই খনার বচনকে তাদের নিজস্ব সম্পদ বলে মনে করে।

উড়িয়া ভাষায় খনার বচনের সংখ্যা ও প্রচলন বাংলা ভাষার চেয়ে বেশি।মৈথিলী ভাষাও বহু খনার বচনকে আত্মসাৎ করেছে, অন্যান্য ভাসায়ও রূপান্তরিত হয়ে খনার বচন প্রচলিত আছে, নেপালী সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষায় অনেক প্রবচন দেখা যায়- সেগুলো খনার বচনের ভাষান্তর মাত্র।

মূলত কৃষি উৎপাদন এবং প্রকৃতি ভিত্তিক বিভিন্ন উপদেশই খনার বচনের মুল উপজীব্য। তাছাড়াও বর্ষপঞ্জী,জ্যোতিষ গণনা, বিধি নিষেধ,স্বাস্থ্য সহ নানা পরিসরে রয়েছে খনার বচনের ব্যাপ্তি।

যেমন –

  • ভালর পিরিত সোনার বাসন ভাংলেও গড়া যায় ,খলের পিরিত মাটির বাস ফাটিলে ফেলায়।

অর্থ– ভালো মানুষের সাথে ভাংলেও জোড়া লাগে/ফল ভাল হয় আর মন্দের সাথে সম্পর্ক ভাংলে কখনই জোড়া লাাগতে নাই/ফেলে দেয়াই উত্তম।

  • কলা রোয়ে না কেটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।

অর্থ– কলাগাছের পাতা না কাটলে তাতে কলার ফলন ভালো হয়।

  • নারিকেল গাছে নুনে মাটি, শীঘ্র শীঘ্র বাধে গুটি।

অর্থ– নারিকেল গাছের গোড়ায় লোনা মাটি দিলে নারিকেলের ফলন ভালো হয়।

  • হাত বিশেক করি ফাঁক,আম কাঠাল পুতে রাখ।

অর্থ– বিশ হাত ফাঁক করে আম কাঁঠাল গাছ না বুনলে গাছে ভালো ফল আসে না।

  • ডাক দিয়া বলে মিহিরের স্ত্রী শোন পতির পিতা,

        ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।

        রাজ্য নাশ গো নাশ হয় অগাধ বান,

        হাতে কাঠা গৃহী ফিরে কিনতে না পায় ধান।

অর্থ– ভাদ্র মাসে ভুমিকম্প হওয়া বড় বন্যা এবং ফসলের বড় ক্ষতির লক্ষণ।

  • শুক্লপক্ষে ফসল বুনে, ছালায় ছালায় টাকা গুনে।

অর্থ– চাঁদের শুক্লপক্ষে ফসল বুনলে ফলন ভালো হয়।

  • আষাঢ় শ্রাবণে টুটে পানি, তার মর্ম পাছে জানি।

অর্থ– আষাঢ় শ্রাবণ মাসে বর্ষা কম হলে পরে বন্যা হয়।

  • মানুষ মরে যাতে,

গাছলা সারে তাতে।

            পচলা সরায় গাছলা সারে,

               গোধুলা দিয়ে মানুষ মারে।

অর্থ– যে স্থান মানুষ বাসের অযোগ্য সে স্থানে গাছ ভালো হয়।পচা দুর্গন্ধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও গাছের জন্য তা উপকারী।

  • বাপ বেটায় করবে চাষ, তাতে পুরবে মনের আশ।

অর্থ- নিজের আত্মীয়/ আপনজন ব্যতিত সম্পূর্ণ অন্যের উপর চাষের ভরসা করলে চাষাবাদের ক্ষতি হয়।

  • ক্ষেতের কোনা,বাণিজ্যের সোনা।

অর্থ- কৃষিকাজ বাণিজ্যের থেকে উত্তম।

  • কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, বাঁশে/পাকলে করে ঠাস টাস।

অর্থ – সময়ের কাজ/চাষ সময়ে না করলে ফসল/কাজ অনিশ্চিত।

  • সাত হাত তিন বিঘতে, কলা লাগায় মায় পুতে।

অর্থ -সাত হাত পর পর তিন বিঘা গর্ত খুড়ে কলাগাছ লাগাতে হয়।

  • খনা বলে চাষার পো,আশ্বিনের শেষে সরিষা রো।

অর্থ– আশ্বিন মাসের শেষে সরিষা বুনতে হয়।

  • ষোল চাষে মুলা,তার অর্ধেক তুলা

         তার অর্ধেকে ধান, বিনা চাষে পান।

অর্থ– মুলাতে সবচে বেশী চাষ দিতে হয় আর চাষ ছাড়াই পান উৎপাদন করা যায়।

  • গাই দিয়া বায় হাল, দুঃখ তার চিরকাল।

অর্থ– গাই দিয়ে হাল বাইতে হয়না,তাতে অমংগল হয়।

  • কচু বনে ছড়ালে ছাই, খনা বলে তার সংখ্যা নাই।

অর্থ– ছাই কচুগাছের জন্য উপকারী তাতে প্রচুর ফলন হয়।

  • দিনে জল রাতে তারা, এই দেখবে খরার ধারা।

অর্থ– বর্ষার শুরুতে যদি দিনে বৃষ্টিপাত হয় আর রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে সে বছর খরা হবে।

 

  • আষাঢ় নবমী শুক্ল পক্ষা, কি কর শ্বশুর লেখা জোখা

         যদি বর্ষে মুষল ধারে, মাঝ সমুদ্রে বগা চড়ে

যদি বর্ষে ছিটে ফোটা, পর্বতে হয় মীনের ঘটা

যদি বর্ষে রিমঝিমি, শস্যের ভার না সহে মেদেনী

হেসে সূর্য বসেন পাটে, চাষার বলদ বিকোয় হাটে ।

অর্থ– আষাঢ় মাসের প্রথম চাঁদের শুক্ল পক্ষের নবমীর দিন অর্থাৎ চন্দ্র মাসের নয় তারিখে যদি মুষল ধারে বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা কম হবে। যদি সামান্য ছিটে ফোটা বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা বেশী হবে। সেদিন মাঝারী বৃষ্টিপাত হলে ফসলের উৎপাদন ভালো হবে আর যদি আদৌ বৃষ্টি না হয় তাহলে সে বছর ভালো ফসল হবেনা।

 

  • স্বর্গে দেখি কোদাল কোদাল মধ্যে মধ্যে আইল

       ভাত খাইলাও শ্বশুর মশাই বৃষ্টি হইবে কাইল।

অর্থ– যদি ছোট ছোট খন্ড খন্ড মেঘে আকাশ ভর্তি থাকে তাহলে পরদিন বৃষ্টি হবে।

  • চৈতে কুয়া ভাদ্রে বান, নরের মুন্ড গড়াগড়ি যান।

অর্থ- চৈত্র মাসে কুয়াশা অথবা ভাদ্রমাসে বন্যা দেখা দিলে মহামারী হয়।

  • যদি ঝরে কাত্তি, সোনা রাত্তি রাত্তি ,যদি ঝরে আগন, হাতে কুলায় মাগন।

অর্থ- কার্তিক মাসে বৃষ্টি হলে ধানের উৎপাদন ভালো হয়। আর অগ্রহায়নে বৃষ্টি হলে ধান নষ্ট হবে।

চলবে…

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়