শ্যামলাল গোঁসাই
বেগম রোকেয়া: নারীমুক্তির দীপশিখা জ্বেলেছিলেন যিনি
প্রতিকৃতি: আইনিউজ
এই আধুনিক সময়ে এসেও যেই নারীর কৃতত্বকে চলমান সমাজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁর নাম বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি নারীদের মুক্তির যে পথ তিনি রচনা করেছিলেন সেই পথ ধরেই হেঁটে গিয়ে কৃতিত্ব পেয়েছেন বাঙালি নারীরা। গণ্ডিবদ্ধ সমাজের বাইরে গিয়ে নারীকেও শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার মশাল জ্বেলেছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। আজ তাঁর জন্মদিন।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। পাউওরাবন্দ গ্রামের একটি অভিজাত পরিবারের ঘর আলো করে ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর জন্ম নেন বেগম রোকেয়া। কিন্তু রোকেয়া যতো বড় হচ্ছিলেন বুঝতে পারছিলেন তাঁদের অভিজাত পরিবারটি মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে রক্ষণশীল। তাই শিক্ষা গ্রহণের তৃষ্ণা থাকলেও পরিবার এবং তৎকালীন সমাজের জন্য সেই শিক্ষা নামক অমৃত লাভ করতে পারেন নি তিনি।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় ঘরের বাইরে গিয়ে একটি মেয়ের শিক্ষা গ্রহণকে ভালো চোখে দেখা হতো না। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে সেই সমাজ ছিলো উদাসীন। তাই সমাজের চলমান এই ধারার বাইরে গিয়ে রোকেয়াকে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ ছিলোনা রোকেয়ার পরিবারেরও।
তাই প্রথম জীবনে লুকিয়ে বড় ভাইয়ের কাছে একটু আধটু উর্দু ও বাংলা পড়তে শেখেন বেগম রোকেয়া। তাঁর বড় দুভাই কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষালাভ করেছিলেন। তাঁর বড় বোন করিমুন্নেসাও ছিলেন শিক্ষা অনুরাগী।
তবে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে যেটুকু শিক্ষা লাভ করছিলেন সেটুকুতে সন্তুষ্ট ছিলেন না বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার পরিপূর্ণ শিক্ষা লাভের সুযোগ ঘটে বিয়ের পর। বিহারের ভাগলপুরে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল।
কলকাতায় অধ্যাপিকা, গবেষক ও রোকেয়া সাহিত্য সমগ্রের সম্পাদক ড. মীরাতুন নাহার এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন, বেগম রোকেয়া খুব সুন্দরী ছিলেন এবং তাঁর বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তাঁর স্বামী ছিলেন খুব উদার মনের মানুষ এবং খুবই শিক্ষিত ব্যক্তি। বেগম রোকেয়া কিছুটা উর্দু তো আগেই শিখেছিলেন। বিয়ের পর সেই শিক্ষা তাঁর উর্দুভাষী স্বামীর সহায়তায় আরও প্রসার লাভ করল। এবং স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজিতে খুব ভাল দক্ষতা অর্জন করলেন। সুন্দর ইংরেজি রচনা করতে পারতেন তিনি’।
তবে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর টান ছিলো বেগম রোকেয়ার। ইংরেজিতে অত্যন্ত সুন্দর করে রচনা করতে পারা সত্বেও লেখালেখি করার জন্য তিনি বেছে নিলেন বাংলাকেই।
বেগম রোকেয়ার সাহিত্য চর্চা
বেগম রোকেয়ার সাহিত্যচর্চ্চার সূত্রপাতও হয়েছিল স্বামীর অনুপ্রেরণায়। তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০২ সালে 'পিপাসা' নামে একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ছিল প্রবন্ধ সংকলন 'মতিচুর' এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি 'সুলতানার স্বপ্ন'। 'সুলতানার স্বপ্ন’কে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়।
তবে যেই স্বামীর হাত ধরে বেগম রোকেয়া জীবনের নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন সেই স্বামী পৃথিবী ছাড়েন অল্প দিনেই। উনিশশ' নয় সালের তেসরা মে স্বামীর মৃত্যুর পর আত্মপ্রকাশ করলেন এক নতুন বেগম রোকেয়া। লেখালেখির বাইরে সমাজে বদল আনার দিকে এবং নারীশিক্ষার বিস্তারেও তিনি মন দিলেন।
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাতা বাণী দত্ত তার তথ্যচিত্তে দেখিয়েছেন কীভাবে কুসংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তিনি নারীদের শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন।
বেগম রোকেয়া নিজেই বলে গেছেন তাঁকে ৫ বছর বয়স থেকে পর্দা করতে হতো। সেই পর্দাকে পরিণত বয়সে মনের ভেতর থেকে তিনি কখনই সমর্থন করেননি। কিন্তু মেয়েদের অভিভাবকরা যাতে তাদের স্কুলে পাঠায় তার জন্য তিনি নিজে পর্দা করে, বোরখা পরে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি যেতেন।
মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা
বেগম রোকেয়া নিজের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে তাঁর স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি আজ কলকাতার একটি নামকরা মেয়েদের সরকারি স্কুল- সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাই স্কুল।
সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স হাই স্কুলটি তিনি প্রথম শুরু করেন ভাগলপুরে ১৯০৯ সালের পয়লা অক্টোবর। তারপর পারিবারিক কারণে বেগম রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন এবং ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ কলকাতার ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের একটি বাড়িতে নতুন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন 'সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'।
আটজন ছাত্রীকে নিয়ে শুরু হয়েছিল কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের যাত্রা।
বেগম রোকায়াকে নিয়ে বিশিষ্টজন যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সোনিয়া আনিম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন তিনি মনে করেন নারী হিসাবে মেয়েরা আজ যেখানে পৌঁছেছেন, তারা সেখানে পৌঁছতেন না, যদি নারীর উন্নতির জন্য বেগম রোকেয়ার মত মনীষীর অবদান না থাকত।
তাঁর সমস্ত কিছুর মাঝে যে একটা প্রচণ্ড ধরনের বিদ্রোহ ছিল- প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, নারীর প্রচলিত অবস্থান, নারীর প্রতি তৎকালীন সমাজের প্রচলিত যে দৃষ্টিভঙ্গি -এসব কিছু নিয়ে সমাজের বিবেককে তিনি চাবুক দিয়ে কষাঘাত করেছিলেন।
নারীর শিক্ষাগ্রহণ, নারীর বাইরে চলাফেরা এবং কাজের অধিকার, স্বাধীন চিন্তা-চেতনার অধিকার, এই বিষয়গুলো যে নারীর মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ সেসব কথা বেগম রোকেয়া সারা জীবন বলে এসেছেন।
তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নারী সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি কখনই সম্ভবপর নয়। সারা জীবন তিনি পিছিয়ে থাকা নারী সমাজকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস নিয়েছিলেন।
১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের অনেক প্রচলিত রীতিনীতি মেনেই তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়েই তিনি নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং শুধু শিক্ষাগত মুক্তি নয়, সার্বিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন।
নারী জাতি এবং অর্থনৈতিক সাবলম্বন বিষয়ে তাঁর এক প্রবন্ধে তিনি নারী পুরুষের সমকক্ষতার যে আর্দশের কথা লিখে গেছেন তা আজকের দিনে নারী সমাজের জন্য একটা আদর্শ। তিনি জন্মেছিলেন সময়ের অনেক আগে।
নিভে গেলো নক্ষত্রের আলো
বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জীবনাবসান হয় ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর।
পুরুষশাসিত সমাজের আচার অনাচার কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন বেগম রোকেয়া। মুসলিম মেয়েদের প্রগতির জন্য তিনি সারা জীবন কাজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মেয়েদের সাবলম্বী হবার পথে, মুক্তির পথে শিক্ষার বিকাশই আসল রাস্তা।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ