ফিচার ডেস্ক
আপডেট: ০১:৩৫, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
আমারে বাঁচান! আমি স্বাধীনতা দেইখা মরুম: টিটু
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানী হানাদারদের একটি দল টিটোর ভাইকে রাইফেলে লাগানো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তার সারা গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মিভুত করে দেয়। টিটুর চোখের সামনে নরঘাতক’রা কয়েক’শ নিরীহ মানুষকে মেরে আগুন দিয়ে পোড়ায়।
প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞায় পনেরো বছরের কিশোর টিটু, পাক সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পথ খুঁজতে থাকে। অবশেষে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে দেখা হয়। কিংবদন্তী যোদ্ধা ও রণকৌশলী খালেদ মোশাররফ; কিশোর টিটুকে ঢাকা উত্তরের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন ‘মানিক গ্রুপ’ নামে খ্যাত গেরিলা দলের কাছে সোর্পদ করেন।
স্বল্প সময়ের ভেতর কম্যান্ডার বাচ্চু’র (নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) সাথে টিটুর চমৎকার হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। এদিকে টিটুর কেবল একটাই চাওয়া, সে যুদ্ধ করবে, তাকে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। বাচ্চু ভাবেন মাত্র ১৫ বছরের কিশোরকে যুদ্ধে জড়ানো ঠিক হবে না।
টিটুকে বোঝানোর জন্য বলেন, ‘তুমিতো এতো ছোট কেমন করে যুদ্ধ করবে?’ টিটু সর্বশক্তি নিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আমি ওদের সবাইরে মাইরা ফালামু,ওরা আমার ভাইরে মারছে। আমি ওদের আগুনে পুইড়া ছাই বানামু। ওরা আমার গ্রাম পুইড়া ছাই বানাইছে। সব কয়টারে গুলি করে মাইরা প্রতিশোধ নিমু।‘
কম্যান্ডার বাচ্চু, এতটুকু কিশোরের প্রতিশোধ স্পৃহা দেখে জিজ্ঞেস করেন- ‘টিটু স্বাধীনতা কি বুঝ তুমি?’ টিটো বলে- ‘হ, জানি! সবাই কয় দেশ স্বাধীন হইলে সবাই নাকি সুখে থাকবো। দ্যাশ থিক্যা অশান্তি দূর হইবো। আমি স্বাধীনতা দেখমু। আমি যুদ্ধ করুম।‘
টিটুকে তাঁর মন রক্ষার্থে কিছু অস্ত্র ব্যবহার শেখানো হলো; কিন্তু বয়সে ছোট থাকায় সরাসরি যুদ্ধের সুযোগ দেওয়া হলো না। আর টিটুর অদম্য ইচ্ছা সে যুদ্ধ করবেই। তাকে বোঝানো হলো যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করাটাও যুদ্ধ। তাঁকে সে দায়িত্বটা দেওয়া হল। কয়েক দিনের মধ্যেই সে সবার প্রিয় হয়ে উঠলো।
নভেম্বরের শেষ দিকে ঢাকা সাভার আরিচা সড়কের দুই পাশ দখলে আসে ঢাকা উত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাভার থানা ঘেরাও করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একই সময় একদল পাকিস্তানি সেনাদল ঢাকার পথে ফিরছিলো।
ওরা এসে সাভার থানার পাকিস্থানী সেনাদের সাথে যোগ দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াবে। সাথে সাথে কমান্ডার বাচ্চু ওদের প্রতিরোধে নেমে পড়লেন।
১৪ই ডিসেম্বরের ভোরে, বর্তমান আশুলিয়া থানার জিরাবো এলাকার ঘোষবাগে চার’শ মুক্তিযোদ্ধা’কে কম্যান্ডার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু রণকৌশল বলে দিয়ে মাত্র ৫০ জনকে জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় রেখে, বাকীদের চার ভাগে ভাগ করে দেন। এই ৫০ জনের দলে পড়ে টিটু, সে এটা মানতে পারেনা। টিটো কান্নায় ভেঙে বাচ্চুকে বলতে থাকেন, ‘যুদ্ধে আমারে নিয়া যান। আমিও যুদ্ধ করুম’।
কমান্ডার গভীর আবেগে টিটুকে আদর করে বললেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা অনেকে না ফিরতে পারি। তুমি থাকো।‘ টিটু কেঁদে বলে, ‘আপনারা সব মইরা যাইবেন আর আমি বাইচা থাকমু ক্যান? আমিও মরুম।‘
কমান্ডার বাচ্চু টিটুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘টিটু তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। তুমি না স্বাধীনতা দেখতে চাও?’
যুদ্ধ শুরু হলো। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই। কিন্তু ভারী মেশিনগানটি ধ্বংস করতে না পারলে এ যুদ্ধে পাকি সেনাদের হারানো যাবে না। বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে কম্যান্ডার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সহযোদ্ধা আরিফকে নির্দেশ করলেন, সে যেন দৌঁড়ে দ্বিতীয় দলের যোদ্ধা নুরুকে জানায় যেভাবেই হোক ঐ হেভী মেশিনগান ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
আরিফ লিডারের নির্দেশ মতো না গিয়ে, কিশোর টিটুকে নির্দেশ দিলো। যার রক্তে প্রিয়জন হারানোর প্রতিশোধ স্পৃহা ও যার চোখে এক শোষণ মুক্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন সেই টিটুকে আর কে পায়।
নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে নিজেকে কাভারে না রেখে লাফ দিয়ে উঠে। কোন আড়াল ছাড়া মুক্তি পাগল কিশোর টিটু, সোজা নুরুকে লক্ষ্য করে দৌঁড়াতে লাগল আর চিৎকার করে নুরুকে বলছিলো লিডারের নির্দেশ। ঠিক তখনই সেই হেভী মেশিনগানের এক ঝাঁক বুলেট এসে বিদ্ধ হয় স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা কিশোর টিটুর বুকে।
বুলেটের আঘাতে মাটি থেকে কয়েক হাত উপরে উঠে, মাটিতে পড়ে টিটুর দেহ। মেশিনগানের বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছে টিটুর বুক।
টিটু চিৎকার করে বাচ্চু ভাইকে ডেকে বলে, 'বাচ্চু ভাই আমারে বাঁচান'। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রিয় টিটুর রক্তাক্ত দেহ দেখে শোক’কে মহাশক্তিতে পরিণত করে এক শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হায়েনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
সেদিন, রনাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সবার মুখে একই প্রশ্ন ছিল, ‘টিটু বেঁচে আছে কি?’
টিটো তখনো বেঁচে ছিলো। কাতর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমারে বাঁচান! আমি স্বাধীনতা দেখুম। স্বাধীনতা দেইখা মরুম। আমারে বাঁচান'।
স্বাধীনতার সূর্যকে দেখার জন্য টিটুর বুকে ছিলো তীব্র আকুলতা। টিটুর রক্তে সেদিন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের মাটি ভেসেছিল।
প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে টিটু, আর পাশে অসহায় সব সহযোদ্ধারা। সবার চোখে অশ্রু। টিটু বারবার বলতে থাকে তার খুব ব্যথা করছে। খুব শীত লাগছে। সহযোদ্ধারা একে একে ২০টি কম্বল দিয়ে ঢেকেও শেষ রক্ষা করতে পারছেন না।
টিটুর কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। এখন ওর শুধু ঠোঁট কাঁপছে; একসময় তাও বন্ধ হয়ে গেল! টিটো তখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। দেখে যাওয়া হয়নি সাধের স্বাধীনতা। মৃত্যুর সময় হয়তো বিড় বিড় করে বলে গেছে, ‘আমিতো স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলামনা।‘
- গেরিলার ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ