শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১২:৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০
রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান (ছবির গল্প)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিজীবনের প্রসঙ্গ উঠলে যে নারীর নাম অবধারিতভাবে উঠে আসে তিনি হলেন কাদম্বরী দেবী, রবির নতুন বৌঠান। একদম কাছাকাছি বয়সের এই দুই মানব-মানবীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কের কোন শেষ নেই।
কেউ তাদের মাঝে দেখেছেন গভীর বন্ধুত্ব আবার কেউবা নেহাতই প্রথাগত ভাবে খুঁজেছেন আঁশটে গন্ধ। তবে চিরাচরিত নিয়মের কাতারে ফেলে কিছু সম্পর্কের বিশ্লেষণ কখনই হয় না।
রবি ঠাকুর আর কাদম্বরী দেবীর অসংজ্ঞায়িত গল্পকে আমাদের চোখে দেখার এক ক্ষুদ্র প্রয়াসে সাজানো হয়েছে আজকের ছবিগল্প "নতুন বৌঠান"।
একদিন চতুর্দোলায় চড়ে একটি ছোট্ট মেয়ে গোধূলি লগ্নের সিঁদুরি রঙে রাঙা চেলি পরে প্রবেশ করল ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর কাঁচা শ্যামলা হাতে সরু সোনার চুড়ি, গলায় মোতির মালা সোনার চরণচক্র পায়ে। বাড়ির ছোট্ট ছেলে রবির হঠাৎ মনে হল, এতদিন যে রাজার বাড়ি খুঁজে খুঁজে সে হয়রান হয়েছে, খুঁজে পায়নি, সেই বাড়িটিরই বুঝি খবর নিয়ে এল এই রূপকথার রাজকন্যে, মাত্র আটবছরের তাঁর নতুন বৌঠান, কাদম্বরী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী।
কাদম্বরী দেবী আর জ্যোতিরিন্দ্রের এই বিয়েটা ঠিক যেন সুখের ছিল না। দু’জনের মধ্যে ছিল যোজন যোজন দূরত্ব। স্বামীর দৃপ্ত পদচারণার তুলনায় আপাতদৃষ্টিতে খানিকটা নিষ্প্রভই ছিলো কাদম্বরী। শ্বশুরবাড়িতেও অনেকটাই যেন অপাংক্তেয়।
তাই সে ছিলো নিভৃতচারী। স্বস্তি পেতো নিজের মনে একা একা থেকে- নিজের কল্পনার আকাশে। তবে তার একাকীত্ব আর অবসাদের জীবনে ছোট্ট একটা ছুটির মতন এসেছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এভাবেই হাসি-খুনসুটিতে কেটে যাচ্ছিল সময়। ক্রমেই বাল্যকাল থেকে কৈশোর আর এরপর যৌবনে পা রাখল রবি-কাদম্বরী। প্রায় সমবয়সী হওয়ায় বন্ধুত্বও ছিল সমানে সমানে। রবির যত টুকিটাকি আবদার সব সে করত নতুন বৌঠানের কাছে। আর বৌঠান শুনতে চাইতো রবির লেখা নতুন কোন কবিতা অথবা গল্প।
কাদম্বরী ছিল রবিঠাকুরের সাহিত্যের প্রধান সমলোচক। আবার তার অনুপ্রেরণাতেই রবিঠাকুর প্রচুর কবিতা, গান লিখেছে। রবির অধিকাংশ সাহিত্য রচনা যে নতুন বৌঠানকে ঘিরেই।
"অশোক বসনা যেন আপনি সে ঢাকা আছে
আপনার রূপের মাঝারে,
রেখা রেখা হাসিগুলি আশেপাশে চমকিয়ে
রূপেতেই লুকায় আবার…"
বউদিকে সাজতে দেখে রবি আপন মনেই সাজিয়েছিল এই চরণগুলো। এমনই রূপের বর্ননা তাকে ছাড়া আর কাকেই বা মানায়?
কাদম্বরী তার এই লাজুক দেবরটাকে প্রীতি আর বন্ধুত্ব দিয়ে আপন করে রাখে সবসময় আর রবিও তার মন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিতে পারে শুধু এই নতুন বৌঠানের কাছেই। দুজনেরই রয়েছে পরস্পরের জন্য অফুরান গল্প, সময় ওদের হাতের তালু দিয়ে গলে যায় বালির মতন।
তারা কখনও গল্প করে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা, কখনও ছোটাছুটি করে বাগানে। কখনও গলা মিলিয়ে গান করে কখনও গাছ থেকে ফল পাড়ে আবার কখনও ঘাটের সিঁড়িতে বসে থাকে পা ডুবিয়ে। নতুন বৌঠান যখন বনের মধ্যে ঝুলনায় দোলে রবি গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল তুলে এনে ফুলডোরে সেটাকে সাজিয়ে দেয়।
রবির জীবনে নতুন বৌঠান দখিনের খোলা জানলা হয়ে গেল। আর সেই জানলা দিয়ে আসা বাতাসে কখনও তার জীবন তৃপ্ত, সমৃদ্ধ আবার কখনওবা বেসামাল, আলুথালু। কাদম্বরীর জীবনের একাকীত্বের অন্ধকারও অনেকটা মুছে গিয়েছিলো রবির আলোয়। রবির চোখে নতুন বৌঠান গ্রীক দেবী "হেকেটি" আর কাদম্বরীর জীবনে সে চির ভাস্বর "ভানু"।
এমন ইন্দ্রপুরীর ছন্দপতন হওয়া শুরু করল তখন যখন থেকে রবি বাহিরমুখো হওয়া শুরু করল। তা বাহিরমুখী হবে নাই বা কেন? একটু একটু করে যে তখন রবির লেখার যশ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছিল সবখানে। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা রবি একসময় বের হয়ে আসলো সবার সামনে। কিন্তু নতুন বউঠান?
কাদম্বরী খুশি হয়েছিল বটে! রবির প্রতিভার প্রদীপে তেল সলতে দিয়ে আলো জ্বালার কাজ যে সার্থক হলো। কিন্তু প্রদীপের নিচেই যে অন্ধকারের বাস। ক্রমেই কাদম্বরী আবার ডুবে গেল একাকীত্ব আর বিষন্নতার রাজ্যে।
একদিকে ঠাকুরবাড়ির পরিশীলিত সাংস্কৃতিক আবহ ও বিনয় বচনের মধ্যেও নিন্দা বিদ্বেষ কুৎসার তীব্র আঘাত অন্যদিকে নিঃসঙ্গতার পীড়া। এত দুঃখ, এত হতাশার মাঝেও এতদিন যে ছিল তার সান্তনার মুগ্ধ প্রলেপ, একমাত্র আশ্রয় তার এখন একবিন্দু ফুসরত কোথায়?
এরই মাঝে রবির জীবনে শুরু হল আরেক নতুন অধ্যায়। বাবার অমোঘ আদেশে মৃণালিনীর সাথে গাঁটছড়া বাধলো সে। না তাতে কাদম্বরীর অবশ্য কোনো অমত ছিলো না। মৃণালিনীর আগমনে রবির আর তার মাঝে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও বড় সাধ ছিল নতুন বউকে সে গড়েপিটে যোগ্য করবে রবির।
কিন্তু সে আহ্লাদেও বাদ সাধল জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, রবির আরেক বউঠান। যেন সবাই মিলে নিঃসঙ্গতার শাস্তি দিতে চায় নতুন বৌঠানকে!
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক বিকেল বেলার কথা। যে ঘরটিতে রবি থাকতো সেটি পরিষ্কার করতে গিয়ে কাদম্বরী আবিষ্কার করল একটি অসমাপ্ত কবিতার দুটি পঙক্তি। পঙক্তি দুটি পড়ে ভেতরে তার রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ–তার প্রিয় রবি লিখেছে: ‘ হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুনের খেলা আরম্ভ হয়েছে..’
প্রচন্ড কষ্ট পেলেও কাদম্বরীর মনে হল, এটাই জগতের নির্মম সত্য। নতুনের জন্য পুরাতনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়, আর এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। তার সর্বক্ষণের ছায়া-সহচর যে এখন অনেক দূরে সরে গেছে। না, রবিকে আর সে কাছে টানতে চায় না। টানতে গেলে কষ্ট পেতে হবে, রবি আর কিছুতেই তাঁর একার হবে না।
কাদম্বরীর মনে আজ বেশ একটা লঘু প্রসন্নতা ছড়িয়ে আছে। জ্যোতিরিন্দ্রের প্রথম জাহাজ “সরোজিনী” আজ প্রথম ভাসবে পানিতে। আর সে উপলক্ষ্যেই পার্টি হবে জাহাজে। তাকে নিতে আসবে তার স্বামী। কাদম্বরী ঠিক করেছে আজ আর কোনও গ্লানি রাখবে না।
জ্যোৎস্না রাতের উৎসবে যোগ দেবে সম্পূর্ণ খোলা মনে। জ্যোৎস্না রাতে নীল রং মানায় তাই কাদম্বরী পছন্দ করল গাঢ় নীল রঙের নয়ন সুখ সিল্কের শাড়ি। আলতা দাসী এসে আলতা পড়িয়ে দিয়ে গেল। চোখে আঁকলো কাজল। সাজ শেষ করে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। সিঁড়িতে কি শোনা যাচ্ছে তাঁর স্বামীর পদশব্দ?
না কেউ আসেনি এখনও। তবে কাদম্বরীর দৃঢ় বিশ্বাস একটু দেরি হলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এসে পড়বে যে কোনও মুহূর্তে। অপেক্ষায় অপেক্ষায় সময় গড়ালো। ক্রমশ গভীর রাতের স্তব্ধতা আর অন্ধকারে ছেয়ে গেলো চারপাশ। কিন্তু কেউ এলো না।
তবে কি আজকের এইদিনেও সবাই ভুলে গেছে কাদম্বরীর কথা? তার স্বামীও আজ সত্যিই আসবে না? কাদম্বরীর কান্না আসছে না, চক্ষু দুটি শুষ্ক কিন্তু ভেতরে তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিই যেন তাকে বিদ্রুপ করে বলছে "ওরে তুই এমন সাজলি কার জন্য? তোর যে কেউ নেই। "
দু’হাতে মুখ চাপা দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ছুটে গিয়ে আলমারি থেকে বের করে আনল একটি গয়নার বাক্স। বাক্সে হীরে-চুনী-মুক্তোর মালার নিচে কাগজের মোড়কে রয়েছে চার খানা বড়ি যা খেলে পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া যায়। এ
ই বাক্সের মধ্যেই সযত্নে রক্ষিত আছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পকেট থেকে পাওয়া তিনখানা চিঠি যা কোন এক নারী জ্যোতি বাবুকে "প্রাণাধিকেষু" সম্বোধনে লিখেছে। সর্বগুণান্বিত, ব্যস্ত, বিখ্যাত স্বামীকে এই গুলো চিঠি সম্পর্কে কখনও প্রশ্ন করেনি সে।
আজ তিনটি চিঠিই পড়ে ফেলল আবার। দুই চোখ, প্রতিটি রোমকূপ তীব্রভাবে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল।
দিনে দিনে জমানো অভিমান আর কষ্টের বিশাল হিমবাহে অবশেষে ফাটল ধরল। ধীর স্থির, স্বল্পভাষী, নিজের কষ্ট গোপন করা নারীটির ধৈর্যের শিকল ছিঁড়ল।চিঠিগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চারটি কালো বড়িই গিলে ফেলল জল দিয়ে! আঃ, শান্তি শান্তি! এখন আর কোনও বাধা নেই। সব পথ তার জন্য খোলা।
নিরর্থক জীবনের মোহ ছেড়ে, নতুনের জন্য স্থান করে আঁধারে মিলিয়ে গেলো ঠাকুরবাড়ির চিরঅভিমানী বধূটি। এক নক্ষত্রের প্রস্থান- এক হৃদয়ের রাণীর মৃত্যু হল সেদিন।
নিমতলার শ্মশানে চিতার আগুনে যখন কাদম্বরীর নিথর দেহটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল তখন রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিপটে কত ছবিই না ভেসে উঠছিল! গঙ্গার বুকে নৌকা ভাসিয়ে আকাশের রং-বিভা দেখা, সদর স্ট্রিটের বাড়ির ছাদে বসে জ্যোৎস্নালোকে অবগাহন করে কেঁপে ওঠা, চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখা, নতুন গানে সুর বসিয়ে নতুন বউঠানকে শোনানো, নন্দন কাননের চাঁপা গাছ থেকে স্বর্ণচাঁপা তুলে বউঠানের খোঁপায় গুঁজে দেয়া, খোঁপায় যুঁইয়ের মালা জড়িয়ে নীল রংয়ের শাড়ি পরে আয়নার সামনে নতুন বউঠানের দাঁড়িয়ে থাকা, নতুন নতুন কবিতা নিয়ে আলোচনা, আরও কত ছবি,কত কথা!
রবি আর কাদম্বরীর মধ্যে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক ছিল সেটা তারা নিজেরা ছাড়া আর কারো স্পষ্ট জানার কথা না। একজন আরেকজনের মানসসঙ্গী ছিলো তারা। খুব সাধারণ “প্রেম” দিয়ে আসলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না এই সম্পর্কটিকে। তবে এতটুকু নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের জীবনে কাদম্বরীর স্থান ছিল দেবীর আসনে। তার অরুনকান্তি ছায়া সর্বদা বিরাজমান ছিল কবির পাশে। ঠিক কবির অনেক দিন আগে নতুন বৌঠানের দিকে চেয়ে বাঁধা গানটির মতই-
"তোমারে করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা…"
লিংকন দাশ রায় সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজারের একজন তরুণ ফটোগ্রাফার। ১৯৯০ সালের ১৯ মে মৌলভীবাজারে জন্ম তাঁর। পড়াশুনা শেষ করেছেন মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে।
রেডিও পল্লিকণ্ঠ ৯৯.২ এফএম মৌলভীবাজারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন প্রোগ্রাম প্রডিউসার এবং রিপোর্টার হিসেবে। রেডিওতে কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ পেয়েছেন মীনা এওয়ার্ড।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ