দীপংকর মোহান্ত
আপডেট: ১৮:৫৫, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০
একাত্তরে নারী নির্যাতন ও একজন যুদ্ধ শিশুর মায়ের বিভীষিকাময় জীবন
স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর কেটে গেল। কিন্তু বীরাঙ্গণাদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে এখনো আমাদের কার্পণ্যবোধ রয়েছে। আলোচ্য বীরাঙ্গণা তখন পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়েছিলেন। যুদ্ধের শুরুতে তাঁকে ধরে নিয়ে এক অস্থায়ী পাকসেনা ক্যাম্পে প্রায় ছয়মাস বন্দি করে রাখা হয়।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে অশ্রুসিক্ত অধ্যায় হচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিষাক্ত নখরে ক্ষত-বিক্ষোত হওয়া নারী সমাজের অবদান। অথচ স্বাধীনতাত্তোরকালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অধোমুখী চেতনার কারণে সেই রক্তক্ষরণ ও নীরব আর্তনাদের অধ্যায় উপেক্ষিত থেকে যায়। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁদের ‘বীরাঙ্গণা ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান দেখিয়েছিলেন।
জানালা বিহীন এক অন্ধকার ছোট ঘরে তার দুর্বিসহ দিনগুলো কেটেছিল অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ শেষে তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। পরে প্রতি পদে-পদে সংগ্রাম করে কেটেছে তাঁর জীবন তরী।
বয়সের ভারে আজ তিনি অসহায় ও পরের আশ্রিত। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র তাঁর প্রতি কী বিচার করেছে? তাঁর বর্ণার ভেতর দিয়ে অনুভব করা যাবে সেদিন পাকসেনাদের হাতে বন্দি হওয়া নারীদের প্রতি বর্বরতার মাত্রা যা ছিল অন্যরকম যুদ্ধ।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে অশ্রুসিক্ত অধ্যায় হচ্ছে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিষাক্ত নখরে ক্ষত-বিক্ষোত হওয়া নারী সমাজের অবদান। অথচ স্বাধীনতাত্তোরকালে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অধোমুখী চেতনার কারণে সেই রক্তক্ষরণ ও নীরব আর্তনাদের অধ্যায় উপেক্ষিত থেকে যায়। সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁদের ‘বীরাঙ্গণা ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু বৃহত্তর সমাজ তাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারেনি। বরং তারা অবহেলার পাত্র হিসেবে বেঁচেছেন কেউবা ‘পাঞ্জাবীর বউ’ অভিধা নিয়েছে। অবজ্ঞা আর মর্যাদাহীন জীবন-যাপন করেছেন।
দু-একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া তাদের দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণা ছিল সকলে অগোচরে। সবচেয়ে বড়কথা পাক বর্বরদের আদিম লালসার বিরুদ্ধে অসহায় নারীদের যুদ্ধ ছিল অনেক কঠিন ও অন্যরকম। যা কোনোক্রমে অস্বীকার করা যাবে না। সেই ভয়ংকর যন্ত্রণা লজ্জার বিষয় নয়; বরং বীরত্বের অংশ বিশেষ ভাবতে হবে।
নির্যাতিত মা-বোনরা লোকলজ্জা, মান-সম্মান, সমাজের কাছে হাস্যস্পদ হয়ে থাকার বেঁচে থাকার ভয়, পরিবারগত বিয়ে দেওয়ার সমস্যা, তার উত্তরাধিকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ করার ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
ফলে এই নির্মন সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সচেতনভাবে ইতিহাসে তাদের নাম থাকা প্রয়োজন। বলতে হবে যুদ্ধের সময় তাঁদের ইজ্জত লুণ্ঠন, রক্তাক্ত ক্ষত দেহের সীমাহীন যন্ত্রণা, যুদ্ধ শিশু নিয়ে ভবঘুরের মতো যাওয়া, আত্মাহুতি দেওয়া প্রভৃতি আমাদের লাল-সুবুজের পতাকার অংশ। তাঁদেরকে কখনো অবজ্ঞা ও হীনভাবে দেখা আমাদের উচিত হয়নি।
বলা যায় সমাজ তখনো গোটা নারী সমাজ নিয়ে নেতিবাচক ধারণার মধ্যে ঘোরপাক করছিল। সমাজে সমতার ধারণা, শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের আগমন এমনকি শিক্ষায় নারী সমাজের গণহারে প্রবেশের দ্বার রুদ্ধ থাকায় সেদিন মুখ খুলে কেউ যাতনার কথা বলেনি নিজের অব্যক্ত জ্বালার কথা বুকে চেপে রেখেছে।
আজ যুগচেতনায় নারী সমাজের উন্নয়ন যেমন বহুগুণ বেড়েছে; তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সামনে আসায় এখন মাতৃরূপী বীরাঙ্গণাদের চরণে ফুল দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়ার উপযুক্ত সময় এসেছে। রাষ্ট্রসহ সচেতন সমাজের দায়বোধ এখন অগ্নিপরীক্ষার সামনে।
২৫মার্চ কালো রাতেই নারীদের কপাল ভাঙ্গে। কিন্তু তা বড়-বড় শহরে সীমাবদ্ধ থাকে। এপ্রিল মাসে গ্রাম পর্যায়ে পাকসেনাদের টহল বেড়ে যায় এবং পরিকল্পিত ভাবে ছোট-বড় ক্যাম্প গড়ে ওঠে।
অতঃপর তাদের সহায়তার জন্য বেড়ে যায় দেশীয় দোসরদের নির্লজ্য সহায়তা। গড়ে ওঠে রাজাকার বাহিনীসহ উপর স্তরের সংগঠন। এই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নারী নির্যাতনের মাত্রা।
ক্ষেত্র গবেষণায় দেখা গেছে দেশীয় দোসররা ১. পাকিস্তান রক্ষার সহায়তার জন্য; ২. পাকসেনাদের যুদ্ধ মাঠে আমোদ-ফুর্তির সঙ্গে শত্রু নিধন কাজে মনোযোগ দেওয়ার নিমিত্তে; ৩. মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভাঙ্গার জন্য; ৩. মনোরঞ্জনের জন্য; ৪. শক্তির কাছাকাছি থাকার উদ্দেশ্যে; ৫. কিছু রাজাকার অরাজক সময়ে আদিম লালসা শক্তির দাপটে নিজে ভোগ করতে; ৬. ধর্মীয় চেতনায় পাকদের হাতে ভোগের উপকরণ হিসেবে মানবীকে তুলে দিয়ে পূণ্য অর্জন করতে ও যুদ্ধে সহায়তা করতে; ৭. উপরের স্তরের সেনাপতিদের হুকুম তালিম করতে; ৮. বাঙালিরা নাকি হিন্দু ও ভারত দ্বারা প্রভাবিত এই প্রতিশোধ নিতে; ৮. স্ত্রী রেখে এসে পুরুষ সৈনিকের পক্ষে দীর্ঘ দিন যুদ্ধে থাকার সময় নারী দখলে রাখা বা ভোগ করাকে পুরানো ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখেছে; ৯. যুদ্ধে নারী নির্যাতনের ঘটানাকে স্বাভাবিক বিষয় ভেবে নেওয়া; ১০. পাকিস্তানী সৈন্যদের সকল ধরণের খেদমদ করাকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের দায় দেখেছে । এই বিষয়াদি মাথায় রেখে সেদিন পাকদের দেশীয় দোসররা [অধিকাংশ] নারী নির্যাতনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল।
এই জন্য মাস্টার মাইন্ড মাহমুদ আলী [বাড়ি সুনামগঞ্জ। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টি আন্দোলনের নেতা ছিলেন। পরে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে জোরালো কথা বলে বলেছেন।
নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদকও মালেক ছিলেন। আশ্চর্য এই ব্যক্তি আবার স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বোচ্চ বিরোধীতা করে অনুগত্য প্রকাশের স্বার্থে পাকিস্তানে চলে যান। এবং পরে ‘ওয়ান ন্যাশন (মুসলিম) দু এস্টেট’ পলিসিতে কাজ করেন]।
কুলাউড়া থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, রোকেয়া হলের ওপর কালো রাতের অভিযান স্বাভাবিক ছিল। সুনামগঞ্জ জেলার রাজাকারের জেলা কামান্ডার মুসলিম উদ্দিন [সদর, সুনাগগঞ্জ, লেখকের সঙ্গে সাক্ষৎকার দিয়েছিলেন] মনে করেছিলেন, ধর্মীয় কারণে ও পাকিস্তান রক্ষার্থে সেনাদের সাহায্যের দরকার ছিল।
তখন কিছু মুসলিমলীগ সমর্থক পরিবার, সাধারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবার, রাজাকার, আলবদরের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল নারী নির্যাতনে। এক্ষেত্রে দেখো গেছে হাতে গুণা কতিপয় মুসলিমলীগার দেখেছিলেন যে, তাদের চোখের সামনে নিজের পরিবারের নারীদের পাক সেনারা তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তারা মনোযন্ত্রণায় ভুগেনি।
আবার অনেকে ঘৃণা ও প্রতিবাদ করেছেন এবং মত পরিবর্তন করেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুসলিমলীগার বলেছিলেন, ‘আমরা এই ইসলামী রাষ্ট্র চাইনি। তা নষ্ট হওয়ার কারণ ছিল তখন আমাদের মা-বোনের ওপর নির্যাতন করা। তাতে আল্লার আরশ কেঁপে ছিল।
অনেক রাজাকার আবার ‘বিবি লোক’কে সেনা ক্যাম্প পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন। কিছুরা ভয়ে করেছে। কিন্তু তারা নিজের পরিবারের অসহায় নারীদের অশ্রুসজল দেখেনি। অনেক রাজাকার পরের ঘরের মা-ঝিকে নরখাদকের হাতে তুলে দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে দেখেছেন নিজের বৌ-মেয়ের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।
কিন্তু প্রথম দিকে রাজাকাররা যে বিষধর সর্পকে দুদ-কলা দিয়ে পুষেছিলেন। একদিন তারা লাগামহীন হয়ে পড়লে ঐ রাজাকাররাও অসহায় হয়ে পড়েছিলেন পাকদের শিকলে।
পাক সেনারা কিছু মুসলিমলীগার পরিবারের প্রতিনিয়ত প্রবেশ তাদের চোখের সামনে মা-বোনকে পাশবিকাত করলেও লোক লজ্জা ও জীবনের ভয়ে প্রতিবাদ যেমন করতে পারেনি; তেমনি পরবর্তী সময় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিও তারা পরিবর্তন করতে পারেনি। তারা স্বাভাবিক হিসেবে ঘটনাকে সম্ভবত দেখেছে।
কিছু পরিবার আবার মেয়েদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিছু রাজাকার ও সমর্থক ক্যাম্পে নারী যোগান দিয়ে গেছেন পুর্বাপর। সাহসী কতিপয় রাজাকার সেনা টহলের সঙ্গে থেকে নির্বিচারে মেয়েদের ধরে নিতে সাহায্য করেছে। তারা আবার নিজের পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু পাকসেনারা বিষয়টি নিয়েছিল যুদ্ধের কৌশলে অবাদ ও বাধাহীন যৌনতার অংশ হিসেবে। তারা শিশু থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ নারীকে ছাড়েনি। ছেলে শিশুকে বলাৎকার করতে দ্বিধা করেনি।
যেকোনো যুদ্ধের সময় সবল শক্তির কাছে মানবতা ও ন্যায়ধর্ম হার মানে। নারীরা হয় অসহায়। এই সুযোগ নেয় বর্বর চেতনার পুরুষ সৈনিক। উপরের কমান্ডদাতারা যখন যুদ্ধের অংশ হিসেবে নারীকে জিম্মি করে নিজের আওতায় নেয় তখন সাধারণ সৈন্যরা পশুর মতো বাধাহীন হয়ে পড়ে যা খুশি তাই করে। বিষয়টি যুদ্ধের অংশ হয়ে ওঠে। কখনো হয় কৌশল। আইনের শাসন ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বন্ধুকের শক্তির দাপটে ধুলায় লুটায়। এই অরাজক সময়ে পৈচাসিকতার নির্মম ছোবল মাতৃজাতিকে মর্যাদাহীন করে তুলেছিল। আমাদের একাত্তর সালে ছিল এই বাস্তবতা।
চলবে…
- দীপংকর মোহান্ত, লেখক ও গবেষক
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ