দীপংকর মোহান্ত
আপডেট: ১২:৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০
একাত্তরে নারী নির্যাতন ও একজন যুদ্ধ শিশুর মায়ের বিভীষিকাময় জীবন
প্রথম পর্বের পর থেকে
তখন নারী নির্যাতনের দৃশ্য ছিল বিভৎস। কারণ, নির্যাতনের ধরণ ছিল বহুমুখী। নির্যাতিত নারীদের বয়ানের আলোকে কিছু স্থানের কথা বলা যেতে পারে যেখানে নিয়মিত নারী নির্যাতন হয়েছে বেশি। যেমন কিছু স্থায়ী জায়গা ছিলো।
১.বড়বড় শহরে অস্থায়ী পাকসেনাদের সেনাক্যাম্প (স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা); ২. মফস্বলে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প (তাঁতু ও বাড়িতে অবস্থান করতো) ৩. মাটির নীচে ব্যাঙ্কার ৪. সীমান্তবর্তী ক্যাম্প (ইপিআর) ৫. নিরাপত্তা ছাউনি ৬. ক্যান্টনমেন্ট ৭. বধ্যভূমির আশপাশের অস্থায়ী অবস্থান ইত্যাদি।
দেখা গেছে এসব জায়গায় সাধারণ সৈন্যদের জন্য, মধ্যম পর্যায়ের অফিসারদের জন্য এবং উর্দ্ধতন অফিসারদের জন্য নারীর যোগান রাখা হয় দুই ভাবে। একদল নারীকে স্থায়ীভাবে বন্দি করে হয়েছিল। আবার কিছু নারীকে প্রতিরাতে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। কিছু অফিসার বদলী হওয়ার সময় পছন্দ মতো বন্দি নারীকে সঙ্গে নিয়ে যেত। কোনো ক্যাম্পে যোগান কমে আসলে অন্য ক্যাম্প থেকে বন্দি চালান দেওয়া হয়েছে।
তবে স্থায়ী জায়গা ছাড়াও পাক সেনাদে কিছু অস্থায়ী জায়গাও ছিলো। যেখানে নির্বিচারে নারী নির্যাতন চালাতো পাক সেনা ও তাদের দোসররা। ১. গ্রামে টহল দেওয়ার সময় কারো না কারো বাড়ি; ২. কোথাও হত্যা/গণ-হত্যার পর সেই গ্রাম বা পাড়া বা পরিবারে মেয়েদের নিস্তার ছিল না (স্পট রেফড)। ৩. তাদের ভাষায় আওয়ামীলীগার, হিন্দু, ভারতীয় চর, মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তান বিরোধীকারী পরিবারের লোকদের ধরতে গিয়ে বাড়িতে ও গ্রামে নারী নির্যাতন করেছে; ৪. ছোট-ছোট বাজারের ঘর ইত্যাদি স্থানে।
পাকসেনাদের নারী নির্যাতনের ধরণের (নির্যাতন বলতে ধর্ষণ বুঝানো হয়েছে) দিকে কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে ১. বধ্যভূমিতে নিয়ে যৌথ ধর্ষনের পর হত্যা করেছে; ২. বাড়িতে হত্যার পূর্বে দলগত ভোগ করেছে; ৩. বিকৃত যৌনাচার করে রক্তাক্ত করেছে; ৪. বিবস্ত্র করে একত্র্রে থাকতে বাধ্য করেছে; ৫. আগুন দিয়ে পুড়ে মেরেছে; ৬. কোলের শিশুকে আছড়ে ফেলে পাশবিক লালসায় উন্মুত্ত হয়েছে; ৭. গর্ভবতী নারীকে উপর্যুপরি ও চক্রাকারে নির্যাতন করে গর্ভের সন্তান নষ্ট করেছে; ৮. পরিবার স্বামী-পুত্রকন্যা, শ্বশুড়-শ্বশুড়ির সামনে নির্যাতন করেছে; ৯. সদ্য জন্ম দেওয়া শিশুর মা বা প্রসূতিকে ভোগ করে দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে; ১০. অল্প বয়সী মেয়েদের আটকে রেখেছে (তাদের অধিকাংশ পরে যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন) ১২. পিরিয়ড়ের সময় ভোগ করেছে; ১৩. কামড়ে মাতৃঅঙ্গ ও স্তন ক্ষত করেছে কিন্তু ঔষধের ব্যবস্থা করেনি ১৪. আত্মহত্যা যাতে করতে না পারে সেজন্য পরনে কাপড় রাখতে দেয়নি এবং লম্বামাথার চুল কেটে দিয়েছে; ১৫. দিনের পর দিন দড়ি/শিকল দিয়ে ক্যাম্পে বেঁধে রেখেছে; ১৬. ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘৃণ্যকাজে বাধ্য করেছে;১৭. গোসল করতে দেয়নি; ১৮. যৌন দাসী করেছে এবং অপরের কাছে বিক্রী করেছে; ১৯. রাজাকারের হাতে তুলে দিয়েছে; ২০. ঘোরতর অসুস্থ হলে চিকিৎসার পরিবর্তে হত্যা করেছে; ২১. ছোট মেয়ে শিশুদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে; ২২. পালাক্রমে ধর্ষণের ফলে অনেক নারী সে জায়গায় মৃত্যুবরণ করেছে; ২৩. জোর করে তুলে নিয়ে গেছে তাদের পরবর্তী কালে কোনো খরব পাওয়া যায়নি (সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বুজনা গ্রামে চারজন মহিলার পরবর্তী খবর আর পাওয়া যায়নি।)
তাছাড়াও ধর্ষণকালে অতি গোপনীয় বহু ধরণের অত্যাচার ও অপরাধ করেছে যা বর্ণনা করা যাবে না। বন্দি ও অসহায় অবস্থায় পড়া নারীরা প্রবল প্রতিরোধ করলে পাক সেনারা মুখে কাপড় গুজে রাখত; একজন মুখ চেপে ধরত অন্যজন পাশবিকতায় লিপ্ত হত। একধরণের রাবার ধর্ষিতার মুখের ওপর এঁটে দিত।
কখনোবা দু হাত একত্রে করে এবং পা দুটো আলাদা করে কোনো খুঁটির সাথে বেঁধে রাখত; আগুন দিয়ে শরীরের অংশ পুড়িয়ে দিত (বীরাঙ্গণা কাকন বিবির উরু দেশে তাই করেছিল)। তবে সবচেয়ে কষ্ট করেছেন বন্দি নারীরা।
তাদের জন্য আহার ছিল অতি সীমিত এবং প্রস্রাব-পায়খানা করার জন্য একটি পট /বালতি রাখা ছিল। সামান্য পানি দেওয়া হত (বড় ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া অধিকাংশ জায়গায় রাতের বেলা বীরাঙ্গণা নিজের ময়লা নিজে পরিষ্কার করতেন)।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে আবার অল্প সংখ্যক নারী ইচ্ছকৃতভাবে উপরতলার অফিসারদের গোপনে মনোরঞ্জন দিয়েছেন এবং অন্য নারীদের সন্ধান দিয়েছেন। রাজাকারসহ সমধর্মী সমর্থকরা পাকদের খেদমতে রাতের বেলা নারী সরবরাহ করতেন। তারা শেষে বিষয়টা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যুদ্ধাবস্থায় ও স্বাধীনতার পর কিছু বীরাঙ্গণা লজ্জা-ক্ষোভ-যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কাউকে আবার তাঁদের পরিবার গ্রহণ করে নি। ভ্রাম্যমান জীবনে ঘুরে ঘুরে মরেছেন কেউ কেউ। তবে কতিপয়কে মুক্তিযোদ্ধারা স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে।
অনেক পরিবার নির্যাতিত মেয়েকে নিয়ে দেশত্যাগ করেছেন বা দেশের ভেতর অন্য জায়গায় গিয়ে বসবাস করেছেন। অনেকে সরকারী/ বেসরকারী আশ্রয় শিবিরে থেকে কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিন্তু পরে সংসার করেননি।
তাছাড়া ১. কিছু বীরাঙ্গণার সরকারী/বেসরকারী উদ্যোগে ভ্রুণ নষ্ট করা হয়েছে (কয়েক জন মারাও গেছেন); ২. কারো কারো ভবিষ্যতের কথা ভেবে জন্মের পরই শিশুকে হত্যা করা হয়েছে; ৩. অনেক নির্যাতিত নারী পাগল হয়েছেন; ৪. ভাসমান ও অসহায় নারী কারো আশ্রয় না পেয়ে যুদ্ধ শিশুকে নিয়ে অন্যত্র বড় করেছেন রাস্তায় থেকেছেন; ৫. কেউ-কেউ দত্তক শিশু দিয়েছেন; ৬. আশ্রয় কেন্দ্রের তত্ত¡াবধানে বিয়ে দেওয়া হয়েছে; ৭. কিছু নির্যাতিত অবিবাহিত মেয়ের বাবা তা মেনে নিয়ে ‘ঘর জামাই’ করে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন [সঙ্গে অর্থ বা জমি দিয়ে]; ৮. অনেকে আমৃত্যু শারীরিক যন্ত্রণায় ভোগেছেন; ৯. নানা ছল করে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে; ১০. যুদ্ধ শিশিরে থাকা (ব্যাঙ্কার, ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদি) কিছু বীরাঙ্গণা ওপারে গিয়ে (সীমান্তবর্তী অঞ্চলে])আত্মীয়দের আশ্রয়ে চলে যায়; ১১. অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে পুনরায় সংসার করেছেন।
অন্যদিকে স্বামী বা পরিবাররের লোকজনদের সমক্ষে যারা নির্যাতিত হয়েছেন তারা পরিবার থেকে মোটামুটি সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তবে বীরাঙ্গণাদের নিদারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন রাষ্ট্রে,সমাজে, আত্মীয় সমাজে।
১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক আত্মস্বীকৃত বীরাঙ্গণা এবং আশ্রয় শিবিরে আশ্রিত বীরাঙ্গণাকে তখন অর্থ, কাপড় ও চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে বীরাঙ্গণাদের নিয়ে আর বেশি ভাবা হয়নি।
বিভিন্ন জায়গার বীরাঙ্গণাদের সাথে আলাপে জানা যায়, এপ্রিলের শেষ দিক থেকে নারী নির্যাতন বাড়তে থাকে এবং সেপ্টেম্বর মাসের শেষ অবধি চলে। পুরোমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে পাকসৈন্যরা বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে যেমন লিপ্ত হয় তেমনি তারা পরাজিত হতে থাকে; এমতাবস্থায় নতুন নারী সংগ্রহ করার প্রবণতা কমে আসে।
যুদ্ধের সময় পাক ব্যাঙ্কারের ভেতরে বন্দি থাকা অনেক বীরাঙ্গণা মিত্র বাহিনির শেলিংএর সময় মারা যায়। তাদের নাম পরিচয় জানা যায় নি। মফস্বলে দায়িত্ব পালনরত কিছু উর্দ্ধতন পাকসেনা বন্দি নারীকে বিবাহ করেছে বলে প্রচার চালায়।
প্রথম দিকে তারা সচেতনভাবে হিন্দু নারীর প্রতি জিঘাংসা মিটায়। অধিকাংশ হিন্দু পরিবার শরণার্থী হলে পরে মুসলিমনারী নারীদের প্রতি অবিচার চালায়। তখন কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাক আর্মিরা শরীরবৃত্তীয় চাহিদার কারণে এই অপকর্ম নির্বিচারে চালিয়ে যায়।
নির্যাতিত হিন্দু পরিবার বা নারী কিছুটা আকার ইঙ্গিতে বিষয়টা স্বীকার করলেও নির্যাতিত মুসলিম পরিবার মুখ খুলতে না রাজ। তবুও সকলের প্রতি থাকবে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
চলবে...
- দীপংকর মোহান্ত, লেখক ও গবেষক
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ