শ্যামলাল গোঁসাই
২০২০ সাল: তাদেরকে পাবো না যাদের হারিয়েছি
আজ ৩০ ডিসেম্বর, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই বিদায় নেবে ২০২০ সাল। নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করবে ২০২১ সাল। কিন্তু হিসেব নিকেশের খাতায় ২০২০ সাল পদ্মা সেতুর মতো স্বপ্নকে যেমন বাস্তব হতে দেখিয়েছে; তেমনি অনেক কীর্তিমান মানুষদেরকেও হারিয়েছি ২০২০ সালে। যাদের হারিয়েছি তাঁদের প্রস্থানে যে শূন্যস্থান হয়েছে তা হয়তো পূরণ হবার নয়। আজকের প্রতিবেদনে দেখে নেব তেমনি কিছু মানুষকে যারা প্রাণ হারিয়েছেন এই বিদায়ী বছর।
কবি মোশাররফ করিম
২০২০ সালের সূচনাতেই আমরা হারিয়েছি সত্তুর দশকের খ্যাতিমান বাঙালি কবি মোশাররফ করিমকে। ১১ জানুয়ারি রাত সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা গিয়েছিলেন।
কবি মোশাররফ করিমের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৯ জানুয়ারি ময়মনসিংহে। তার পিতার নাম এম. এ. করিম ও মাতার নাম আমিনা খাতুন।
মোশাররফ করিম পেশাগত জীবনে সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিকও ছিলেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
- পাথরের পথে, (১৯৮২);
- অন্য এক আদিবাসে (১৯৮৪);
- সে নয় সুন্দরী শিরিন (১৯৮৭);
- কোথায় সেই দীর্ঘ দেবদারু (১৯৯০);
- নিবেদনের গন্ধঢালা (১৯৯২)
ক্রিস্টোফার নিকোলাস পারসন্স
একই বছর একই মাসে বিশ্ব হারিয়েছে খ্যাতিমান ইংরেজ অভিনেতা ও রেডিও, টেলিভিশন উপস্থাপক ক্রিস্টোফার নিকোলাস পারসন্সকে। জানুয়ারির ২৮ তারিখ মারা যান এই গুণী অভিনেতা।
তিনি কমেডি রেডিও শো "জাস্ট আ মিনিট"-এর দীর্ঘকালীন উপস্থাপক ছিলেন এবং ১৯৭০ এর দশক ও ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে গেম শো "সেল অফ দ্য সেঞ্চুরি"-এর হোস্ট ছিলেন।
পারসন্স লিংকনশায়ারের গ্রান্থামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এখানেই বেড়ে ওঠেন। তিনি লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি পূর্ণকালীন অভিনেতা হয়ে ওঠেন এবং আর্থার হেইনেসের সমর্থন সহ বিভিন্ন থিয়েটার, ফিল্ম এবং টেলিভিশন চরিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি "জাস্ট আ মিনিট" উপস্থাপন শুরু করেছিলেন এবং ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোনও অনুষ্ঠানই মিস করেন নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাকে মার্চেন্ট নেভিতে একটি পোস্টিংয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কিন্তু প্লুরিসিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে সেবার তিনি যোগদান করেননি। সেসময় তিনি পাঁচ মাস হাসপাতালে কাটিয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনার রেট দেওয়া হয়েছিল ৫০-৫০।
লরেন্স গর্ডন টেসলার
কম্পিউটার যোগাযোগ ক্ষেত্রে কপি-কাট এর জনক লরেন্স টেসলারকেও বিশ্ব হারিয়েছে ২০২০ সালে। টেসলার নিউইয়র্ক সিটিতে বড় হয়েছেন এবং ১৯৬১ সালে ব্রঙ্কস হাই স্কুল অফ সায়েন্স থেকে স্নাতক পাশ করেন। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান, যেখানে তিনি ১৯৬০ এর দশকে কম্পিউটার বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছিলেন।
টেসলার ১৯৬০ এর দশকের শেষদিকে স্ট্যানফোর্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ল্যাবরেটরিতেও কাজ করেছিলেন। হোরেস এনিয়ার সাহায্যে তিনি কমপ্লে ডিজাইন করেছিলেন, যা ছিলো প্রাথমিক একক অ্যাসাইনমেন্ট ল্যাঙ্গুয়েজ। এই কার্যনির্বাহী প্রোগ্রামিং ভাষাটি যুগপত প্রক্রিয়াকরণকে আরও প্রাকৃতিক করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল এবং এটি প্রাথমিকভাবে প্রোগ্রামিং ধারণাগুলি প্রবর্তনের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে টেসলার মারা যান
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
বাংলাদেশী শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও ২০২০ সালে মারা যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলন (১৯৫২), উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান (১৯৬৯) ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আনিসুজ্জামান শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। প্রবন্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তাকে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তাকে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ পদক প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার তাকে 'জাতীয় অধ্যাপক' হিসেবে নিয়োগ দেয়।
আনিসুজ্জামান ২০২০ সালের ১৪ মে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বার্ধক্যজনিত, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রোস্টেট সমস্যা, রক্তে ইনফেকশনসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
তার মৃতদেহ থেকে নমুনা নিয়ে করোনা পরীক্ষা করা হলে জানা যায় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন ।
জর্জ ফ্লয়েড
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদের শিকার হয়ে ২০২০ সালে মারা যান জর্জ ফ্লয়েড। কোনো খ্যাতিমান কেউ না হলেও জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যি কাঁপিয়ে দিয়েছিলো গোটা আমেরিকাকে।
জর্জ ফ্লয়েডকে আমেরিকান পুলিশ প্রকাশ্যে হত্যা করে। আমেরিকানদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয় সারা আমেরিকা জুড়ে। পরবর্তীতে এই হত্যাকাণ্ড গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২০ সালে ট্রাম্পের পরাজিত হবার পেছনে এই হত্যাকাণ্ডটিকেও অনেকে কারণ হিসেবে দেখে থাকেন।
কামাল লোহানী
২০২০ সালে অন্যান্যদের সাথে বাংলাদেশ হারিয়েছে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানিকে। ২০২০ সালের ২০ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সাংস্কৃতিক অঙ্গণের এই প্রাচীন বৃক্ষ।
ছিলেন একজন বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
তিনিই বাংলাদেশ বেতারে সেদিন ঘোষণা করেন, “আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।”
একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা বেতারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী এবং ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা সফর উপলক্ষে তৎকালীন দমদম বিমানবন্দরেও (বর্তমান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ১৬ মাস মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি পুনরায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে চলে আসেন।
২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পুনরায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
অন্যান্যদের মতো কলকাতার গুণী অভিনেতা ‘অপু’ খ্যাত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও বিদায় নেন এই সালে। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর এই অভিনেতা পশ্চিমবঙ্গে মারা যান।
অভিনেতা হিসেবে তিনি কিংবদন্তি, তবে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবেও তার নাম অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথেই উচ্চারিত হয়। তিনি কবি এবং অনুবাদকও। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ভিতর ১৪টিতে অভিনয় করেছেন।
সৌমিত্র সুদীর্ঘ ষাট বছরের চলচ্চিত্রজীবনে তিনশোরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন প্রমুখ অভিনেত্রীর প্রথম কাজও তার বিপরীতে ছিল।
তার অভিনীত চরিত্রগুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ ছবিতে ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
অভিনেতা আব্দুল কাদের
বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা ‘বদি ভাই’ খ্যাত আব্দুল কাদের কিছুদিন আগেই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান এই অভিনেতা। তাঁর মৃত্যুতেও বাংলাদেশের বিনোদন জগতে শোক নেমে আসে।
১৯৯৪ সালে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে তিনি বদি চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন। বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শকদের কাছে তিনি 'বদি' নামে পরিচিতি পান। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় বাংলাদেশী ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে তার অভিনয়ের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন।
আব্দুল কাদের অভিনয়ে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও মূল পেশা হিসবে তিনি একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এছাড়াও সারাবিশ্বে ২০২০ সালে আরও অনেক রথি-মহারথীরা মারা গেছেন। পুরোনো বছরের মতো তারাও হয়তো পুরোনো হয়ে যাবেন কিন্তু থেকে যাবেন স্মৃতি হয়ে আমাদের অন্তরে।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ