শ্যামলাল গোঁসাই
আব্দুল করিম: উজান ধলের নক্ষত্রের কথা
বাউলদের নিয়ে আমার একটা একান্ত ধারণা আছে। আর সেটা হলো বাউলরা অঞ্চলভেদে বা এলাকাভেদে আলাদা হলেও বাউল সত্তা থাকে এক। অর্থাৎ বাউলদের চিন্তার জগত প্রায় ক্ষেত্রেই একই রকম থাকে। শুধু পরিবেশ আর সময়ভেদে তারা তাদের গানের কথায় পরিবর্তন আনেন।
তবে এটাও বলে রাখা যে, আমাদের বাংলাদেশের বাউল আর পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের আবার মিলবে না। কারণ, বিভিন্ন ধরনের বাউল ধারা আছে। কিন্তু চিন্তার জগতটি মূলত এক বিষয়কে কেন্দ্র করে। যেন একই লক্ষ্যে পৌছানোর দশটি রাস্তার মতোন।
শাহ আব্দুল করিম একজন সমৃদ্ধ বাউল ছিলেন। যিনি পড়াশোনা তেমন না করেও তার গানে যে ভাবের সঞ্চার করেছিলেন তা অনেক শিক্ষিত সঙ্গীতবোদ্ধাদেরও অবাক করে দিয়েছিলো! তিনি এই ভব তরণীর মাঝি হয়ে একে একে পাড়ি দিয়েছেন বাউল গানের বিভিন্ন পর্যায় বা ধাঁপ। গানে তৈরি করেছেন তার নিজস্ব বলয়।
ফকির লালন সাঁই যেমন মানুষের দেহকে একটা 'খাঁচা' ভেবে সেখানেই সৃষ্টিতত্ব কিংবা দেহতত্বের উন্মোচন করেছেন। শাহ আব্দুল করিমও এর ব্যাতিক্রম করেন নি। বরং বলতে গেলে করিমের কিছু গানে লালনের সুস্পষ্ট ছাপ ছিলো।
এ ব্যাপারে আব্দুল করিমও জীবদ্দশায় অনেক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমি লালন ফকিরকে খুব গুরুত্ব দেই।'
তবে তিনি লালন সাঁইয়ের মতো দেহকে একখানা 'খাঁচা' না ভেবে সেখানে ঢেলে দিয়েছেন আঞ্চলিক উপমা। আঞ্চলিক উপাদানে সমৃদ্ধ করেছেন গানকে। যাকে সহজ ভাষায় গানের অলংকারও বলা যেতে পারে। লালনের সেই 'খাঁচা'কে আব্দুল করিম নিজের গানে করে নিয়েছেন 'ময়ুরপঙখী নৌকা'! তারপর এই নৌকার অবকাঠামোতেই তোলে ধরেছেন এই মানবদেহকে। তোলে ধরেছেন মানবদেহের রহস্য এবং সর্বশেষে প্রকাশ করেছেন অধরাকে ধরতে না পারার না ব্যাকুলতা।
এক্ষেত্রে আরেকটা বিষয় আব্দুল করিম সবসময়ই পরিষ্কার করে বলেছেন যে তিনি কোনো আসমানী খোদায় বিশ্বাস করেন না। মানুষের ভেতরে যে খোদা বিরাজমান আব্দুল করিম সেই খোদার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তি খোদায় বিশ্বাসী নন, তিনি বিশ্বাস করেন শক্তিকে। এই জায়গাটি লক্ষ্য করলে আব্দুল করিমের বিজ্ঞান কেন্দ্রিক ভাবনার বিষয়টি সহজেই বুঝা যায়। কারণ, বিশ্বের যেদিকেই তাকাই না কেন সবদিকেই শক্তির উপস্থিতি বিদ্যমান। বলতে হবে, শক্তি ছাড়া এই জড়জগৎ অচল।
এভাবেই আব্দুল করিম গানের মধ্য দিয়ে সুপ্রসস্ত করেছেন তার চিন্তা-ভাবনার পরিধি। নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তার এই অনন্য উচ্চতার বিষয়টি অন্যান্যদের মতো তৎকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানীর চোখে ধরা পড়েছিলো।
একবার মাওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে করিমকে বলেছিলেন, 'সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে।' আব্দুল করিম গণমানুষের শিল্পী হয়েওছিলেন।
আগেই বলেছি আব্দুল করিম তার গানের বলয় তৈরি করেছিলেন একান্তই তার আঞ্চলিক উপাদান দিয়ে। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ধল গ্রামে। যেখানে ৬ মাস পানিবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়। তিনি খুব কাছ থেকেই সেই ভাটি এলাকার মানুষের দুঃখ, দুর্দশার চিত্র অবলোকন করতে পেরেছিলেন।
তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনেও তাকে অভাব-অনটনের কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই গাঁয়ের মোড়লের বাড়িতে রাখাল হিশেবে কাজে গিয়েছিলেন। মাঠে, ঘাটে গরু চড়াতে চড়াতে তাই তিনি যে গানগুলো বেঁধেছিলেন সে গানগুলো মূলতই ছিলো সেইসব এলাকার মানুষের জরাজীর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই সঙ্গীত জীবনে তিনি বিভিন্ন তত্ব গান গেয়ে গেলেও তার ঝুলিতে রেখেছিলেন গণমানুষের জন্য কিছু গান।
একবার আমাদের মৌলভীবাজারের খ্যাতনামা লেখক এবং লোক গবেষক মাহফুজ ভাই আদুল করিমকে গরিব মেহনতী মানুষের মুক্তি নিয়েপ্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে আব্দুল করিম সহজ সাবলীল ভাষায় বলেছিলেন, 'এ দেশে বিপ্লব হোক, মানুষ মানুষের মতো বাঁচার অধিকার পাক, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক এটা আমি মনেপ্রাণে কামনা করি। এ সম্পর্কে আমি গানেও বলেছি।'
সাধারণত বাউল সম্প্রদায় দেহ সাধনার মাঝেই তাদের এক জীবন কাটিয়ে দেন। কিন্তু কেউ কেউ এর ব্যতিক্রমও হন। যেমন ফকির লালন সাঁই শুধুমাত্র একজন শুদ্ধ বাউলই ছিলেন না একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারকও। তিনি সমাজের বিভিন্ন প্রথার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন, লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেছিলেন, শিখেছিলেন শত্রুর মোকাবিলায় অস্ত্র ধরাও। তাই লালন শুধু একজন বাউল নয়, একজন সচেতন সমাজ সংস্কারকও।
আমাদের ভাটি এলাকার কবি আব্দুল করিমের মাঝেও কোথায় যেন সেই ছাপটা দেখতে পাই। আব্দুল করিমও নিজেকে শুধু দেহ সাধনা কিংবা পরমের সন্ধানেই ব্যস্ত রাখেন নি। তাঁর চোখে ধরা পড়েছে সমাজের অসাম্য, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, ধনী-গরীবের ভেদ।
তাই তিনি একবার বলেছিলেন, 'মানুষই যদি না বাঁদে তাহলে দেহ সাধনা করবে কে? দেহ সাধনা করতে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। তবে বিপন্ন মানুষের কথাও ভাবতে হবে। তাই আমি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তোলে ধরি।'
আব্দুল করিমের এমন বক্তব্যে একজন সময় সচেতন শিল্পী হিশেবে সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গাটি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। এতোসবের পরেও আব্দুল করিম নিজেকে নিয়ে দুঃখ করেছেন শেষ জীবনে। তিনি মনে করতেন একজন শিল্পী হিশেবে সাধারণ মানুষের যতোটা কাছে থাকার কথা তিনি তা পারেন নি।
তিনি বলেন, 'আমি আসলে তাক ধরে দুঃস্থদের জন্য কিছু লিখিনি। আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই। ভাটি এলাকার একজন বঞ্চিত, নিঃস্ব, দুঃখী মানুষ আমি। আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়।'
আসলেও তাই। আব্দুল করিম বুঝতেই পারেন নি তিনি তার গানের পরিধি বিস্তৃত করলেও তার মন সবসময় পড়ে রয়েছে ভাটি বাংলায়। তাই নিজের অজান্তেই তিনি নিজের দুঃখের কথা ভেবে যেই গানগুলো গেয়েছেন বা লিখেছেন সে গানগুলো অন্য দশটা হাভাতে মানুষের দুঃখের কথা হয়ে গিয়েছে। আব্দুল করিম সবশেষে ভাটির মানুষদের এক কার্ল মার্কস হতে পেরেছিলেন, দশজনের প্রিয় একজন হতে পেরেছিলেন। এবং এখানেই তার স্বার্থকথা বলে আমি মনে করি।
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ