সীমান্ত দাস
আপডেট: ১৯:১৩, ৪ মে ২০২১
সিনেমার মিষ্টি মেয়ে কবরী
সারাহ বেগম কবরী। বাংলা সিনেমার 'মিষ্টি মেয়ে' হিসেবে জনপ্রিয়। সত্তর ও আশির দশকে এই অভিনেত্রী ছিলেন দেশের মানুষদের কাছে প্রিয় মানুষ, একদম নিজের ও কাছের মানুষ। একের পর এক সিনেমায় মেধার কারণে পেয়েছেন দর্শকদের ভালোবাসা ও জনপ্রিয়তা।
যৌবনকালে 'মিষ্টি মেয়ে' হিসেবে যে খ্যাতি পেয়েছিলেন কবরী, সেই খ্যাতি এতোটুকুও ক্ষুণ্ণ হয়নি তার ষাটোর্ধ্ব বয়সেও। জীবনের পুরো সময়টুকু ধরে রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা। আর তাইতো, কবরীর অনুপস্থিতিতে কাঁদছে দেশের সিনেপ্রেমীরা।
কবরীর চলচ্চিত্রে আগমন...
সেইসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন সুভাষ দত্ত। 'সুতরাং' নামে সিনেমার জন্য তিনি এমন একজন অভিনেত্রী খুঁজছিলেন যে তার বিপরীতে মূল নায়িকার চরিত্রে থাকবেন। তখন সিনেমার সংগীত পরিচালক সত্য সাহা দিয়েছিলেন তাকে কবরীর সন্ধান। কবরীর সম্পর্কে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে একটি মেয়ে আছে, নাম মিনা পাল। তাঁর উচ্চতাও বেশি না। মঞ্চে কাজ করে।
ব্যস। এতোটুকুই। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই অভিনেত্রীকে। একের পর এক দর্শকমাতানো ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কিছুর নাম না বললেই নয়, 'সারেং বউ', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'ময়নামতি', 'সুজন সখী' ইত্যাদি। দর্শকদের অবাক করে একসময় তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি শুরু করলেন প্রযোজনা, জনপ্রিয়তা তখন আকাশসীমায় পৌঁছায়।
কবরী শুধু দর্শকদের মাঝেই নয়, জনপ্রিয় ছিলেন তার সহকর্মী এবং পরের শিল্পীদের মাঝেও। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ নিয়ে কবরীর সমসাময়িক অভিনয় শিল্পী মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা হিসেবে পরিচিত তিনি বলেন,
কবরী তার অভিনয় দিয়ে মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তেমনটা আর কেউ পারেননি।
সোহেল রানা বলেন,
কবরীকে মানুষ মনে করতো, এই শিল্পীটা আমার শিল্পী। আমার কাছের মানুষ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরীর মত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি প্রিয় শিল্পী আর কেউ নেই।
কবরী তার সিনেমার চরিত্রগুলোতে একদম বাস্তবের মতোই তুলে ধরেছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের বাস্তব মেয়েদের গল্প, তার অভিনয় দেখে প্রত্যেকেই নিজেকে যেনো নায়িকার চরিত্রে অনুভব করতে চাইতো।
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা মিনা পাল আত্মপ্রকাশ করেছিলেন কবরী হয়ে...
১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে এই মেধাবী অভিনেত্রীর জন্ম। তার পারিবারিক নাম মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের সাথে 'সুতরাং' ছবি দিয়ে শুরু করেছিলেন তার ক্যারিয়ার। তারপরেই অভিনয়ে মেধা ও পরিশ্রমের পরিচয় দিয়ে দর্শকদের মন জিতে নেন তিনি, তার নামের সাথে যুক্ত হয় দর্শকদের দেওয়া নাম 'মিষ্টি মেয়ে'। ক্যারিয়ারের শেষেও তার এই নাম একটুও জনপ্রিয়তা হারায়নি।
২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, এখনও দেখা হলে কেউ কেউ বলে, 'আপনি ঠিক আগের মতই আছেন।' কিন্তু কেউ কি কখনো একরকম থাকতে পারে! তখন আমি তাকে বলি যে আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন বলেই এরকম মনে হয়।
কবরী বলেছিলেন, 'সুতরাং' সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
শুরুর দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাকে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয়েছিল 'ভাষা থেকে চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক টান' এবং কথায় 'নাকি নাকি ভাব' দূর করতে।
কবরীর ভাষায়-
চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্তদা (সুভাষ দত্ত) শিখিয়েছেন। কিন্তু 'সুতরাং'এর পর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
কবরী-রাজ্জাকের জুটি ছিলো অকৃত্রিম...
তবে সুভাষ দত্তের সাথে শুরু করলেও দর্শকদের কাছে বেশি জনপ্রিয় ছিলো নায়ক রাজ রাজ্জাকের সাথে কবরীর জুটি। এ বিষয়ে বিবিসিও জানায়, এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত জুটি। বাংলাদেশের সিনেমায় কিংবদন্তী তুল্য এই জুটি দর্শকদের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, তার ধারে কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি আর কোনো জুটি।
এক সাক্ষাৎকারে সেই রাজ্জাক-কবরী জুটির রসায়নের রহস্য নিয়ে কথা বলার সময় কবরী বলেছিলেন
আমার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। প্রেম করা আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রাজ্জাকের সাথে অভিনয় করার সময় এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করতাম আমি।
কবরী মনে করতেন, রাজ্জাকের সাথে অভিনয়ের সময় তাদের দু'জনের আবেগের অকৃত্রিমতার কারণেই জুটির রসায়ন মানুষের মনে দাগ কেটেছে।
আলোচক-সমালোচক ও সিনেমা গবেষকরা মনে করতেন এই জুটিই ছিলো একদম পারফেক্ট। আর এছাড়াও কবরী অতুলনীয়।
সিনেমা গবেষক অনুপম হায়াৎ মনে করেন, সেসময়কার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে, ষাটের দশকের গুমোট পরিস্থিতিতে বিনোদনের মধ্যে দিয়ে একরকম স্বস্তি পেতে চাইতো মানুষ, এই রাজ্জাক-কবরী জুটি সেই স্বস্তিটা দিতে পেরেছিল।
উল্লেখ্য, কবরী ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।
করোনা কেড়ে নিয়েছে দর্শকদের মিষ্টি মেয়েকে...
১৬ এপ্রিল (শুক্রবার) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবদন্তী অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই হচ্ছিলো তার শারিরিক অবস্থার অবনতি, পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি কিংবদন্তী এই অভিনেত্রীকে।
১৩ দিন করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করে পরাজয় মানতে হয়েছে এই অভিনেত্রীকে। রাত ১২টা ২০মিনিটে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স ছিলো ৭০ বছর। তিনি ফেলে রেখে গেছেন বাংলা সিনেমায় তার অসাধারণ অভিনয়, নির্মাণ ও মেধার পরিচয়। সিনেপ্রেমীদের শোকভারাক্রান্ত মন বলে দিচ্ছে তার জনপ্রিয়তা।
কবরীর মৃত্যুতে পুরো দেশ জুড়ে ছেয়ে গেছে শোকের ছাড়া। সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাচ্ছেন সবাই তাদের ভালোবাসা...
অভিনেত্রী তারিন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, আমরা আরও একজন কিংবদন্তিকে হারালাম। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন যোদ্ধা, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তার বিদেহী আত্মার শান্তি দান করুন। দয়া করে সবাই তার জন্য প্রার্থনা করুন।আমরা একজন কিংবদন্তিকে হারালাম। আসুন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি।
গীতিকার ও লেখক ইশতিয়াক আহমেদ তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, সাদাকালো টিভি দেখা মানুষ আমরা।শাবানা, কবরীকে দেখে বড় হয়েছি। শাবনুর, মৌসুমীরা আসার আগে তাদেরই নায়িকা জানতাম। ক্যামেরার সামনের মিষ্টি অভিনেত্রী, ক্যামেরার বাইরে ঝাঁঝালো নেত্রী সব মিলিয়ে কবরী আমাদের কাছের মানুষ এক। কবরীকে মনে থাকবে অনেকদিন। করোনাকেও...
গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ সরকার তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, বিদায় কবরী আপা! অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো...আপনার অমলিন হাসিটা তুলে রাখলাম। বিদায়...
সংগীত শিল্পী শফিক তুহিন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম কিংবদন্তী অভিনেত্রী মিষ্টি মেয়ে খ্যাত কবরী সারোয়ার ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন(ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।এদেশ সারাজীবন আপনার ঐতিহাসিক কাজগুলো মনে রাখবে। ওপারে ভালো থাকবেন ....
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সুরকার ও সংগীত শিল্পী বেলাল খান তার ফেসবুক টাইমলাইনে লেখেন, আমাদের কৈশোর কালের নায়িকা ছিলেন কবরী।
বিদায় কবরী...
মহামারি পরিস্থিতির কারণে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শহীদ মিনার বা এফডিসি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না অভিনেত্রী-নির্মাতা-নেতা কবরীর মরদেহ।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গার্ড অব অনার। গার্ড অব অনার শেষে কবরীর শেষ ঠিকানা বনানী কবরস্থান।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন, যুগান্তর
আইনিউজ/এসডি
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ