Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ১৩ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৯ ১৪৩১

আহমদ আফরোজ

প্রকাশিত: ১৭:২৪, ১৭ এপ্রিল ২০২১
আপডেট: ১৬:২৭, ৪ মে ২০২১

আফ্রিকার শিল্পী সংগ্রামী বি কিডুডু

বি কিডুডু

বি কিডুডু

বছর কয়েক আগে অচেনা অপরিচিত ভাষার একটা গান ফেসবুকের টাইমলাইনে ঘুরছিলো। অতশীপর এক বৃদ্ধার কণ্ঠে অভূতপূর্ব শ্রুতিমধুর গানটি নিয়ে অনেকে ট্রল করছেন আবার ভালোবাসা জানাচ্ছেন কেউ কেউ। গানটির মানে জানিনা। কোন ভাষার? কে গাচ্ছেন? তাও অজানা। তারপরও অনেকে গানটি শেয়ার করছেন, মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন স্ব-বোধের বাউন্ডারি বরাবর। একটুখানি মনোযোগ দিয়ে গানটি শুনার পর কেমন একটা ভালোলাগা অনুভূত হয়। ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করে জানলাম সোয়াহিলি ভাষার বিখ্যাত গান এটি। আর এই শিল্পী যেনোতেনো কেউ নন; তিনি আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার মহান গায়িকা ফাতুমা বিনতি বারাকা। বি কিডুডু নামে যিনি সর্বাধিক পরিচিত। কাওয়ালি ধাচের সোয়াহিলি-আরব প্রভাবিত সংগীতের স্টাইল তারাব’র কিংবদন্তি পারফর্মার তিনি। তাঁকে তারাব  এবং ইউনিয়াগো Unyago (তানজানিয়া ও কেনিয়ার কয়েকটি অঞ্চলের সংস্কৃতি। এটি মেয়েদের বয়সের আগমন বা বিবাহের সময় উদযাপনের আনুষ্ঠানিক নাচ গানের রীতি) সংস্কৃতির রাণী বলা হয়।

বি কিডুডু’র সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হয় তিনি ১৯১০ সালে তানজানিয়ার জাঞ্জিবার দ্বীপের মাফাগিমিরিঙ্গ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন দ্বীপের একজন নারিকেল বিক্রেতা। আফ্রিকার আরেক কিংবদন্তি নারী কণ্ঠশিল্পী সিথি বিনতি সাদ’র অনুসারী বি কিডুডু তাঁর সমাজ ও প্রথার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কোরাণিক স্কুল থেকে পালিয়ে নিয়ম ভাঙতে শুরু করেন। রক্ষণশীল আফ্রিকান সমাজে তিনি নিজের ব্যক্তিগত বিপ্লবের মাধ্যমে আফ্রিকান সংগীত এবং নারী জাগরণে পথ তৈরী করে গেছেন।

বি কিডুডু'র গান শুনতে ক্লিক করুন

বিশ্ব সংগীতে অবদানের জন্য Womex award প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত বি কিডুডে অনেকটা আড়ালেই ছিলেন। ২০০৫ সালে এই মিউজিক পুরস্কার তাঁকে বিশ্বখ্যাতি প্রদান করে এবং বিশ্ববাসীর নজরে আসেন তিনি। ব্রিটিশ নির্মাতা andy jones বি কিডুডুর জীবন ও কর্ম নিয়ে ২০০৬ সালে তৈরি করেন তথ্যচিত্র I Shot Bi Kidudu. এটি তাঁকে নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র। এরপর আরো অনেকে কাজ করেছেন। এসবের মধ্যদিয়ে উঠে এসেছে এই শিল্পীর জানা অজানা অনেক বিষয় ও পরিসর।

প্রবল লিঙ্গ বৈষম্যের জাঞ্জিবার সমাজে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। সারল্য জেদ আর একঘেয়েমির মধ্যদিয়ে পদদলিত করেন সমাজের জরা, পশ্চাৎপদ প্রথা। প্রচলিত বিধিনিষেধ ভেঙে তিনি তাঁর সমাজের দুর্দান্ত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে মূর্ত করেন বিশ্ববাসীর সামনে। জাঞ্জিবার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। সোয়াহিলি সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের বিষয়গুলোর সাথে মেলবন্ধন তৈরি করেন আরব মরমীবাদের। বলা হয় তিনি যে জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন সে জীবনই যাপন করেছিলেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, রক্ষণশীল রীতিনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পর্দার নিচ থেকে বেড়িয়ে আসাটা কঠিন ছিলো তাঁর সময়ে। কিন্তু পেরেছিলেন তিনি।

ফাতুমা বিনতি বারাকা বা বি কিডুডু

 

নিঃসন্তান এই প্রথা বিরোধী শিল্পীর পুরো জীবনটাই ছিলো বিতর্কিত। কিন্তু নিজস্ব চেতনাকে অনুসরণ করেই ছুটেছিলেন তিনি। দুই স্বামী থেকেও দূরে পালিয়েছিলেন। প্রকাশ্যে ধূমপান করতেন। ভ্রমণের শখ ছিলো তাঁর। বিশ্ব ঘুরে বেড়াবেন এমন স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু জীবনে অর্জিত সকল অর্থ অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে নিঃস্বই থাকতেন। একজন ভেষজ বিশেষজ্ঞ হিসেবেও নাম আছে বি কিডুডুর। হাঁপানির নিরাময়ের জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন। গানের পাশাপাশি করেছেন অভিনয়ও। তিনি প্রায়শই একটি বড় ড্রামকে পিটিয়ে মঞ্চে নেচে গাইতেন। জাঞ্জিবার তরুণ শিল্পীদের সংগীত শেখানো এবং অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন।

আফ্রিকান লোক সংগীতকে বিশ্ববাসীর নজরে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে বি কিডুডুর অবদান অনেক। তিনি ১৯৮০ এর দশকে স্বৈরাচারী নাইজেরিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতামত প্রচার করতে সংগীত ব্যবহার করেন। নানা বিতর্ক মাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সবাইকে বিজয়ী করেছেন। শেষমেষ তাঁর সমাজই তাকে ‘জাতীয় ধন’ বলে গ্রহণ করে।
২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল শত বছর বয়সে ফাতুমা বিনতি বারাকা জাঞ্জিবার দ্বীপে নিজের বাড়িতে মারা গেছেন।  তাঁর প্রয়াণ দিবসে নিরন্তর শ্রদ্ধা। 
Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়