সীমান্ত দাস
আপডেট: ২০:৩৫, ১ জানুয়ারি ২০২২
২০২১ সালে পতন হয়েছে যেসব তারার
শেষ হয়েছে ২০২১ সাল। কম ভয়ানক ছিলো না সারা বছরটি। দুনিয়াজুড়ে করোনাভাইরাসের ভয়ানক তাণ্ডব আমরা দেখেছি ২০২১ সালে। এই ২০২১ সালেই মারা গেছেন আমাদের অনেক প্রিয়জন। অনেকের আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মী বা শুধু পরিচিত মানুষই হোক- কেড়ে নিয়েছে ২০২১ সাল। এবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক ২০২১ সাল বাংলাদেশের যেসব তারকাদের কেড়ে নিয়েছে।
২০২১ সালে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি যেসব তারকা ও গুণী মানুষ:
সারাহ বেগম কবরী
ছিলেন দেশের মানুষদের কাছে প্রিয় মানুষ, একদম নিজের ও কাছের মানুষ। একের পর এক সিনেমায় মেধার কারণে পেয়েছেন দর্শকদের ভালোবাসা ও জনপ্রিয়তা।
যৌবনকালে 'মিষ্টি মেয়ে' হিসেবে যে খ্যাতি পেয়েছিলেন কবরী, সেই খ্যাতি এতোটুকুও ক্ষুণ্ণ হয়নি তার ষাটোর্ধ্ব বয়সেও। জীবনের পুরো সময়টুকু ধরে রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা। আর তাইতো, কবরীর অনুপস্থিতিতে কাঁদছে দেশের সিনেপ্রেমীরা।
সেইসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন সুভাষ দত্ত। 'সুতরাং' নামে সিনেমার জন্য তিনি এমন একজন অভিনেত্রী খুঁজছিলেন যে তার বিপরীতে মূল নায়িকার চরিত্রে থাকবেন। তখন সিনেমার সংগীত পরিচালক সত্য সাহা দিয়েছিলেন তাকে কবরীর সন্ধান। কবরীর সম্পর্কে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে একটি মেয়ে আছে, নাম মিনা পাল। তাঁর উচ্চতাও বেশি না। মঞ্চে কাজ করে।
ব্যস। এতোটুকুই। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই অভিনেত্রীকে। একের পর এক দর্শকমাতানো ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কিছুর নাম না বললেই নয়, 'সারেং বউ', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'ময়নামতি', 'সুজন সখী' ইত্যাদি। দর্শকদের অবাক করে একসময় তিনি অভিনয়ের পাশাপাশি শুরু করলেন প্রযোজনা, জনপ্রিয়তা তখন আকাশসীমায় পৌঁছায়।
কবরী শুধু দর্শকদের মাঝেই নয়, জনপ্রিয় ছিলেন তার সহকর্মী এবং পরের শিল্পীদের মাঝেও। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ নিয়ে কবরীর সমসাময়িক অভিনয় শিল্পী মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা হিসেবে পরিচিত তিনি বলেন,
কবরী তার অভিনয় দিয়ে মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তেমনটা আর কেউ পারেননি।
সোহেল রানা বলেন,
কবরীকে মানুষ মনে করতো, এই শিল্পীটা আমার শিল্পী। আমার কাছের মানুষ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরীর মত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি প্রিয় শিল্পী আর কেউ নেই।
কবরী তার সিনেমার চরিত্রগুলোতে একদম বাস্তবের মতোই তুলে ধরেছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের বাস্তব মেয়েদের গল্প, তার অভিনয় দেখে প্রত্যেকেই নিজেকে যেনো নায়িকার চরিত্রে অনুভব করতে চাইতো।
১৯৫০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামে এই মেধাবী অভিনেত্রীর জন্ম। তার পারিবারিক নাম মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের সাথে 'সুতরাং' ছবি দিয়ে শুরু করেছিলেন তার ক্যারিয়ার। তারপরেই অভিনয়ে মেধা ও পরিশ্রমের পরিচয় দিয়ে দর্শকদের মন জিতে নেন তিনি, তার নামের সাথে যুক্ত হয় দর্শকদের দেওয়া নাম 'মিষ্টি মেয়ে'। ক্যারিয়ারের শেষেও তার এই নাম একটুও জনপ্রিয়তা হারায়নি।
- আরও পড়ুন- সিনেমার মিষ্টি মেয়ে কবরী
২০১১ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কবরী বলেছিলেন, এখনও দেখা হলে কেউ কেউ বলে, 'আপনি ঠিক আগের মতই আছেন।' কিন্তু কেউ কি কখনো একরকম থাকতে পারে! তখন আমি তাকে বলি যে আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন বলেই এরকম মনে হয়।
কবরী বলেছিলেন, 'সুতরাং' সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।
এ টি এম শামসুজ্জামান
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার। সকল ক্ষেত্রেই তিনি সফল। পেয়েছেন অনেক সম্মাননাও। আজ শনিবার সেই অভিনেতার চিরবিদায় ঘটেছে। নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই বরেণ্য অভিনেতা।
৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এটিএম শামসুজ্জামান। তার বাবা নূরুজ্জামানের পৈতৃক নিবাস লক্ষীপুরের ভোলাকোটের বড় বাড়িতে। তৎকালীন শামসুজ্জামানের বাবা নামকরা আইনজীবী ছিলেন। রাজনীতিতেও ছিলেন পারদর্শী। নূরুজ্জামান শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। শামসুজ্জামানের মায়ের নাম নুরুন্নেসা বেগম। নূরজ্জামান-নুরুন্নেসা দম্পতির আট ছেলে মেয়ের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
এটিএম শামসুজ্জামান বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। ঢাকার পগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। পগোজ স্কুলে পড়ার সময় তার সহপাঠী ছিলেন আরেক শক্তিমান অভিনেতা প্রবীর মিত্র। এক পর্যায়ে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন শামসুজ্জামান।
১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন এটিএম শামসুজ্জামান। ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি লিখেন কাহিনী ও চিত্রনাট্য। এটিই ছিল তার প্রথম কাহিনী ও চিত্রনাট্য। ছবির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। তার কাহিনী ও চিত্রনাট্যে অভিনেতা ফারুকের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনী লেখার অর্জন রয়েছে।
প্রথম দিকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন এটিএম শামসুজ্জামান। ১৯৬৫ সালের দিকে অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র পর্দায় আগমন। ১৯৭৬ সালে চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আলোচনা আসেন তিনি।
‘দায়ী কে?’ চলচ্চিত্র ছাড়াও কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ‘জলছবি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘রামের সুমতি’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ চলচ্চিত্রে তাকে কৌতুক চরিত্রে দেখা যায়।
শুরুতে নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করলেও আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রটিতে খল চরিত্র তাকে অভিনেতার তকমা এনে দেয়। তিনি ‘অশিক্ষিত’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘স্বপ্নের নায়ক’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মণিকোঠায় স্থান করে নেন।
খল চরিত্র ছাড়াও পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। ‘অনন্ত প্রেম’, ‘দোলনা’, ‘অচেনা’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘চোরাবালি’ উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্র।
- আরও পড়ুন- এটিএম শামসুজ্জামানের চিরবিদায়
পরিচালনার মাধ্যমেই এটিএম শামসুজ্জামানের চলচ্চিত্রে যাত্রা হয়। ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তদের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটির ‘এবাদত’ নামের ছবিটি।
- আরও পড়ুন- এটিএম শামসুজ্জামানের বর্ণাঢ্য জীবন
১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দায়ী কে?’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এটিএম শামসুজ্জামান। ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ চলচ্চিত্রে কৌতুক চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। এটিএম শামসুজ্জামান রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’তে অভিনয় করেন এবং শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তাকে ৪২ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১৭) অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
ফকির আলমগীর
গণ সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফকির আলমগীর। এ দেশে গণসংগীতকে আলাদা করে পরিচিত করে তুলেছিলেন তিনি। তার কণ্ঠে গণ সংগীত পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। কিন্তু তিনি শুধু গণ সংগীত শিল্পীই ছিলেন না। ছিলেন পপ গায়কও।
সর্বমহলে সমান জনপ্রিয় এক সঙ্গীতশিল্পী তিনি। বিশ্বজুড়ে বাঙালিদের কাছে সমাদৃত তিনি। নিজেকে বারবার উত্তরণ করে এখন তিনি দেশ সেরা গণসঙ্গীত শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের সকল গণআন্দোলনের পুরোটা তিনি। সাধারণ মানুষের জন্য গান বেঁধেছেন। মুকুন্দরায়, কানাইলাল শীল, আলতাফ মাহমুদ, অজিত রায়ের পথ বেয়ে তিনি এককভাবে ইতিহাস রচনা করেছেন। উদাত্ত কণ্ঠে লোকায়ত স্টাইলে গলা ছেড়ে তিনি গান মানুষের জন্য গেয়ে থাকেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গান তৈরি করতে পারেন। তিনি দেশের আনাচে কানাচে ছুটে ছুটে গান করেন। তিনি প্রবাসী বাঙালীদের সামনে স্বদেশ চেতনার বাণী তুলে ধরেন। ওপার বাংলাতেও তিনি সমান জনপ্রিয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পর তার অবস্থান।
ফকির আলমগীর। তিনি ফকির। তিনিই আবার বাদশা। ফরিদপুরে তার আদি বাড়ি। লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সারাজীবন তিনি সহজ মানুষ। সাধারণ পোশাক পরেন। এক মাথা ঝাঁকড়া ঢুল। সবসময় তিনি মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করেন। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই তার বন্ধু। ছোট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত, ধনী-গবির কোনো প্রভেদ নেই।
- আরও পড়ুন- তিনি ফকির, তিনিই বাদশা
সবাই সমান ফকির আলমগীরের কাছে। ফকির আলমগীর সকল খানে সহজ ও স্বচ্ছন্দ্য। সবার সঙ্গে খোলা মনে কথা বলে যাচ্ছেন। তাই অনেক সময় তার প্রকৃত মূল্য আমরা দিতে কৃপণতা করি।
বরেণ্য এই গণসংগীতশিল্পী করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার রাতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে একাত্তরের এই কণ্ঠযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৭১।
শিল্পী বেঁচে থাকেন সৃষ্টিতে, ফকির আলমগীরও বেঁচে থাকবেন তার গানের মাঝে। সুদীর্ঘ ৫৫ বছরের সংগীত ক্যারিয়ারে এক হাজারেরো বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। মোট অ্যালবাম সংখ্যা ৩০। কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পীর কণ্ঠে ‘ও সখিনা’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘সান্তাহার জংশনে দেখা’, ‘বনমালী তুমি’, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’, ‘মায়ের একধার দুধের দাম’, ‘আহা রে কাল্লু মাতব্বর’, ‘ঘর করলাম না রে’ প্রভৃতি গানগুলো উল্লেখযোগ্য।
ফকির আলমগীরের কণ্ঠে আরেকটি উল্লেখযোগ্য গান হলো ‘নাম ছিল তার জন হেনরি’। এই গানটি সর্বপ্রথম গেয়েছিলেন গণসংগীতের অন্যতম শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, যাকে গুরু মানতেন ফকির আলমগীর। গানটির কেন্দ্রে রয়েছেন আমেরিকান লোকগাথার কিংবদন্তি জন হেনরি।
তার গাওয়া ‘ও সখিনা’ গানটি এখনো তরুণ প্রজন্মের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। ১৯৮২ সালে বিটিভির ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানে গানটি প্রচারের পরপরই দর্শকের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে গানটি।
ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন, ‘ও সখিনা গেছোস কিনা ভুইল্লা আমারে/আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে’। ২০১৬ সালে এক নিবন্ধে এই গানের ‘সখিনা’ প্রসঙ্গে ফকির আলমগীর লিখেছিলেন, ‘সখিনা আবহমান বাংলার প্রেমিকা ও বধূ। কারও কাছে দুঃখিনী পল্লীবালা আবার কারও কাছে আহ্লাদী বোন। কারও কাছে সে বন্যায় ভেসে যাওয়া বিক্ষুব্ধ চিৎকার। এই সখিনা কখনো রিকশাওয়ালার প্রিয়তমা স্ত্রী। কখনও কারখানার শ্রমজীবী নারী, কখনও বা ফুটপাতের ইটভাঙা শ্রমিক।’
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন ফকির আলমগীর। সেই সূত্রে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী ও গণশিল্পী গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে তার গান আর সংগ্রামের জগতে প্রবেশ।
এলো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল সময়। গানের শিল্পী ফকির আলমগীর তাতেও কণ্ঠ মেলালেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। নব্বইয়ে সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলনে প্রতিবাদী গানে ফকির আলমগীরের ছিল সরব উপস্থিতি।
গণসংগীত কেন বেছে নিলেন, দ্য ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফকির আলমগীর বলেছিলেন, ‘মাতৃপ্রেম বা দেশপ্রেম দুটোই আমাকে বেশ টানে। দেশপ্রেম আমাকে সাহস যোগায়। সংগীতের অনেক শাখা থাকার পরও আমি সারাজীবন গণসংগীত করেছি মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা থেকে। আর আমি আজও মানুষের জন্য গান গাই।’
মিতা হক
মিতা হক ১৯৬২ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রয়াত অভিনেতা-পরিচালক খালেদ খানের স্ত্রী। তার একমাত্র কন্যা ফারহিন খান জয়িতাও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
মিতা হক বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী। তার এককভাবে মুক্তি পাওয়া মোট ২৪টি অ্যালবাম আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে। তিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।
মিতা হক প্রথমে তার চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সনজীদা খাতুনের কাছে গান শেখেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বার্লিন আন্তর্জাতিক যুব ফেস্টিভালে অংশ নেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলাবাদক মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে সঙ্গীত শেখা শুরু করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে সঙ্গীত পরিবেশনা করছেন।
১১ এপ্রিল সকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চা এবং রবীন্দ্র সংগীতকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’
ওয়াসিম
সত্তর ও আশির দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ওয়াসিম। তিনি মারা যান সারেং বউ খ্যাত কবরীর দাফনের দিনে। ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল দিনগত রাত ১২টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে ওয়াসিমের বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগসহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দিয়ে প্রবীণ এই অভিনেতার মৃত্যুর খবর জানান চিত্রনায়ক ও শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান।
কয়েকদিন আগে নায়ক ওয়াসিমের অসুস্থতার খবরও জানিয়েছিলেন জায়েদ খান। ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওয়াসিম ভাই কিছুদিন ধরে অনেক অসুস্থ। হাঁটতে পারছেন না। বিছানাতে শুয়েই সময় কাটছে। সবার কাছে দোয়া চাই ওয়াসিম ভাইয়ের জন্য।’ তবে সে সময় প্রয়াত অভিনেতার অসুস্থতা কোন ধরনের, সেটা উল্লেখ করেননি জায়েদ খান।
প্রসঙ্গত, নায়ক ওয়াসিমের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়েছিল ১৯৭২ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে। ওই বছর ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ নামে একটি সিনেমায় কাজ করেন তিনি। নায়ক হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় মহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপর দিন যতই যেতে থাকে ওয়াসিমের জনপ্রিয়তা ততই আকাশচুম্বী হয়।
- আরও পড়ুন- কবরীর পরে বিদায় নিয়েছেন নায়ক ওয়াসিম
একসময় বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমার অপরিহার্য নায়ক হয়ে ওঠেন ওয়াসিম। বিশেষ করে ফোক-ফ্যান্টাসি সিনেমার এক নম্বর আসনটি ছিল তার দখলে। শাবানা, ববিতা, কবরী, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষ ও নূতনদের সঙ্গে তার জুটি ছিল প্রশংসিত। ওয়াসিমের কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি- রাতের পর দিন, দোস্ত দুশমন, দি রেইন, রাজদুলারী, বাহাদুর, মানসী, সওদাগর, নরম গরম, বেদ্বীন, ঈমান, লাল মেম সাহেব প্রভৃতি।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী
একুশে পদক-জয়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশীও মারা গেছেন ২০২১ সালেই।
করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখানে ৭ এপ্রিল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গণমাধ্যমকে খবরটি নিশ্চিত করেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিন।
তিনি জানান, এই কণ্ঠশিল্পী করোনাভাইরাসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। সোমবার হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তাকে আইসিইউতে রাখা হয়।
মৃত্যুকালে স্ত্রী দীপ্তি রাজবংশী, পুত্র রবীন রাজবংশী ও মেয়ে প্রবাসীকে রেখে গেছেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। তারাও লোকগানের সঙ্গে জড়িত।
এ শিল্পীর পরিবারের পাঁচ প্রজন্ম গান লেখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী মূলত লোকগানের শিল্পী। সংগীত কলেজে লোকসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
১৯৫৭ সালে ছোটদের আসরে গান করতে শুরু করেন তিনি। ১৯৭১ সালে সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে ভিন্ন নামে দোভাষীর কাজ করতে হয় কিছুদিন।
পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতে যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
গান লেখা, সুর করা ও গাওয়া ছাড়াও লোকগান সংগ্রহ করতেন তিনি। গত ৫০ বছরে এক হাজার কবির লেখা কয়েক লাখ গান সংগ্রহ করেছেন।
মাহমুদ সাজ্জাদ
নন্দিত অভিনেতা মাহমুদ সাজ্জাদকেও কেড়ে নেয় ২০২১ সাল। গত ২৪ অক্টোবর বেলা সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাহমুদ সাজ্জাদের ভাই ম হামিদ বলেন, ‘মাহমুদ সাজ্জাদ রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কোভিড-১৯ পজেটিভ হওয়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর তাকে সেখানে ভর্তি করানো হয়।’
তিনি আরও জানান, পরে কোভিড নেগেটিভ ফল এলেও কোভিড পরবর্তী নানা জটিলতায় আক্রান্ত হন মাহমুদ সাজ্জাদ।
জহির রায়হান পরিচালিত ‘সংসার’ সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন মাহমুদ সাজ্জাদ। পরে তিনি খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘ঝড়ের পাখি’, ‘আপন পর’, আজিজ আজহারের ‘চোখের জলে’-সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি পান।
এক সময় মঞ্চ নাটকে সরব হয়ে পড়েন মাহমুদ সাজ্জাদ। সেইসঙ্গে টেলিভিশন নাটকেও ব্যস্ততা বাড়িয়ে দেন। টেলিভিশনে তার অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল-সন্ধ্যা’। এরপর তিনি সহস্রাধিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকমন জয় করেন।
আইনিউজ/এসডি
দেখুন আইনিউজের ভিডিও
মৌলভীবাজারে সাতদিনব্যাপী নাট্য উৎসব
মাহিকে ধর্ষণের ইচ্ছা প্রতিমন্ত্রী মুরাদের, হজ্ব থেকে বোরকা পড়ে যা বললেন নায়িকা
৮০ বছর বয়সে বৃদ্ধা নূরজাহান বেগমের মানবেতর জীবন
পুরুষ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছেন নারীরা
মিন্নির কবরের জীবন
অকালে মারা গেলেন পুনিথ রাজকুমার, তার অর্থে চলতো ২৬ টা অনাথ আশ্রম
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ