সীমান্ত দাস, নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেট: ২০:১৬, ৫ জানুয়ারি ২০২২
টেকবিশ্বে কেন ভারতীয়রা ছত্রপতি? বাংলাদেশ কেন তালিকার বাইরে?
অনেক আগে থেকেই টেক ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ভারতীয়দের হাতে। কিন্তু কেন? কেনো টেকবিশ্বে ভারতীয়রা একচ্ছত্র অধিপতি? টেক দুনিয়ায় কেন তাদের জয়জয়কার? এটা কি পুরোটাই কাকতালীয়? নাকি এর পিছনে কোনও ট্রিগার চাপা হচ্ছে?
অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্ব অসাম্য ল্যাবের সহ-কর্ণধার লুকাস চ্যান্সেল এবং অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি, এমানুয়েল সায়েজ ও গ্যাব্রিয়েল জুকমান একটি রিপোর্ট তৈরি করেছেন। রিপোর্টে সাফ উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের ১০ শতাংশ ভারতের মোট জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ রোজগার করে। নীচের সারির ৫০ শতাংশ অর্থাৎ গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তদের দেশের মোট আয়ের ১৩ শতাংশ নিয়েই জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের মধ্যবিত্তরা আদতেই গরিব। যাঁদের গড় সম্পদ মাত্র ৭ লক্ষ ২৩ হাজার ৯৩০ টাকা যা দেশের মোট আয়ের ২৯.৫ শতাংশ মাত্র। সেই তুলনায় দেশের প্রথম সারির ১০ শতাংশ এবং শীর্ষের ১ শতাংশ ভারতের ৬৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ আয় করে।
কিন্তু যে দেশের মানুষ খেতেই পারছে না ঠিকমতো, সেই দেশ কিন্তু আদতে পশ্চিমা বিশ্বে রাজত্ব করছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বা রাশিয়া এমনসব শক্তিশালী দেশে ক্ষমতা খাটাচ্ছে ভারতীয়রা? এর পিছনের কাহিনী কি?
শুরু করা যাক তাহলে।
২০২০ সালের জানুয়ারি টেক বিশ্বে দুটি ঘোষণা আসে। দুই টেক জায়ান্ট আইবিএম (IBM) অরবিন্দ কৃষ্ণাকে এবং উইওয়ার্ক (wework) সন্দীপ মাত্রানিকে তাদের কোম্পানির সিইও হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু এসব নিউজে ভারতীয়রা যেন পাত্তাই দেয়নি। কারণ এর অনেক আগে থেকেই টেক ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ভারতীয়দের হাতে। কিন্তু কেন? কেনো টেকবিশ্বে ভারতীয়রা একচ্ছত্র অধিপতি? টেক দুনিয়ায় কেন তাদের জয়জয়কার? এটা কি পুরোটাই কাকতালীয়? নাকি এর পিছনে কোনও ট্রিগার চাপা হচ্ছে?
টেক জায়ান্ট আইবিএম (IBM) এর সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণা
একটা দেশ পোষাক রপ্তানিতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, দক্ষ শ্রমিক বা ধান-চাল রপ্তানিতেও সেরা হতে পারে। অনেকে আগ্নেয়াস্ত্র রপ্তানিতে সেরা হয়ে বসে আছে। তবে ভারত এমন একটি দেশ, যারা সারা বিশ্বের প্রতিটি কোনায় কোনায় সিইও (CEO) বা চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (Chief Executive Officer) রপ্তানিতে শ্রেষ্ঠ হয়ে আছে।
উইওয়ার্ক (wework) এর সিইও সন্দীপ মাত্রানি
যে দেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ দারিদ্রতার সীমার নিচে বেঁচে আছে, জীবনযাত্রার মান যেখানে নিতান্তই নিম্নশ্রেণির সেই ভারতের ইদানীং নতুন পরিচয় গড়ে ওঠেছে। ভারতকে বলা হচ্ছে Big Bazar of CEO's। গুগোল অথবা ফেসবুক, এডোবি, বাটা, মাস্টারকার্ড, নোকিয়া, নেটঅ্যাপ, পেপসিকো কিংবা আইবিএমের (IBM) মতো জায়ান্ট কোম্পানি সিইও হিসেবে দায়িত্বে আছেন ভারতীয় নাগরিকরা। কিভাবে ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের পেছনে ফেলে মেধা আর মাপকাঠির যোগ্যতায় ওপরে উঠে এলো ভারতীয়রা? সুন্দর পিচাইয়ের জায়গায় কেনো গুগোল একজন আমেরিকানকে দায়িত্ব দিলো না? কেন বিলগেটস মাইক্রোসফটের দায়িত্ব তাঁর স্বদেশীকে না দিয়ে দিলেন ভারতীয় সত্য নাদেলাকে? অরবিন্দ কৃষ্ণ (আইবিএমের সিইও), জয়শ্রী উল্লাল (আর্টিস্টার সিইও), অঞ্জলি সুদ (ভিমিওর সিইও) অথবা সন্দীপ কাটারিয়া (বাটার সিইও) কেনো জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর সিইও? আমেরিকান বা ইউরোপীয়ান কেউ তো থাকতেই পারতো!
এই ভারতীয় মানুষগুলোই নানা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে আরোহন করেছে। বলতে পারেন তাদের তীক্ষ্ণ মেধা বা এমন কিছু, কিন্তু সে তো অনেকের মধ্যেই আছে। কঠোর পরিশ্রমী মানুষ কি শুধু ভারতেই জন্মাচ্ছেন? তাহলে ভারতীয়রা ঠিক কোন কারণে অন্যন্য হয়ে আছে? চীন বা জাপানের মতো দেশ থাকতেও কেন মেধা রপ্তানিতে ভারত সর্ব প্রথমে?
ডাইভার্সিটি বা বৈচিত্র্যতা
আসলে সিইও (CEO) হবার দৌড়ে ভারতীয়রা একটুখানি হলেও এগিয়ে থাকে তাঁর পেছনে কারণ হলো ডাইভার্সিটি (Divercity)। উদাহরণ হিসেবে সুন্দর পিচাইয়ের কথা ধরুন। গুগোলের প্রতিষ্ঠাতা সার্গেই বিং এবং ল্যারি পেইজ যখন গুগলের কর্তৃত্বটা কার হাতে তুলে দেবেন ভাবছিলেন, তখন কিন্তু বেশ কয়েকটি অপশনই তাদের হাতে ছিলো। তবে সুন্দর পিচাইয়ের যোগ্যতা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর ব্যাকগ্রাউন্ডটাকেও আমলে নিয়েছেন তাঁরা। সুন্দর এসেছেন বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ভারত থেকে। শুধু ভারতেরই আটাশটা (২৮) প্রদেশ আর একাধিক ইউনিয়ন টেরিটোরি আছে যার প্রত্যেকটা একটি থেকে আরেকটি আলাদা। নানান ঢঙয়ের, নানান মতের-ধর্মের অনেক মানুষের সাথে তাঁর সংস্পর্শ। আইইটিতে গ্রাজুয়েশন শেষ করে সুন্দর পিচাই এসেছিলেন আমেরিকায়। চাকরি করেছেন দীর্ঘ অনেক বছর ধরে। লম্বা এই সফরে অসংখ্য মানুষের সাথে তাঁকে মিশতে হয়েছে, কাজও করতে হয়েছে।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই
তবে গুগলের সিইও (CEO) হওয়ার আগে সুন্দর পিচাই যে জার্নিটা করেছেন সেটা হয়তো কোনও আমেরিকান বা ইউরোপীয়ানদের জন্য কল্পনা করাই কষ্টকর। গুগল শুধু নামেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ছিলো না তখন, বিশ্বের ৪০ টা দেশেই তৎকালীন সময়ে ছিলো গুগলের অফিস। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রায় ১৬০ টি দেশের বেশি নাগরিকরা। তাদের সবার কাজ, মনস্তত্ব বা উদ্দেশ্য বুঝতে হলে ডাইভার্সিটি থেকে উঠে আসা মানুষের গুরুত্ব বেশ ভালো ছিলো। যেটা ভারত থেকে উঠে আসা সুন্দরের মধ্যে ছিলো। এই ভার্সিটালিটির কারণেই আইইটি খড়কপুরের এই ছাত্র সুন্দরকে বেঁছে নিতে কোনও সমস্যাই হয়নি সার্গেই বিঙ বা ল্যারি পেইজের। গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইন কর্পোরেশনের সিইও হিসেবেই সুন্দরকে দায়িত্ব দেন তাঁরা।
ব্লুমবার্গ-এর প্রতিবেদনে উঠে আসে এনিয়ে মতামত। তাদের গবেষণায় বেশ কয়েকটি দিক এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে ভারত প্রায় ১৪০ কোটি লোকের দেশ। হাজার হাজার ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, অনুন্নত অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধার অনেক কিছুই যেখানে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অর্জন করতে হয় এ রকম জায়গায় টিকে থাকতে দরকার ভিন্ন ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। আর তাই নানা চ্যালেঞ্জ খুব সহজেই পার করতে পারে ভারতীয়রা।
আর এজন্যই ভারতীয় সিইওদের উপর ভরসা মার্কিনিদের অনেক। এর সাথে আরও একটি কারণ হচ্ছে বাজার ও ভোক্তা বোঝার ও ভবিষ্যৎ আন্দাজের ক্ষমতা। ভারতে বিশাল এবং নানা শ্রেণীর ও আয়ের ভোক্তা থাকায় সেখানকার কাজ করা লোকোদের বাজার ব্যবস্থা নিয়ে বড় অভিজ্ঞতা থাকে। যা কোম্পানির ভবিষ্যতের জন্য লাভজনক। আর তাই ভারতীয় সিইও-রাই থাকেন মার্কিন কোম্পানিদের নজরে। আর এ কথা স্বয়ং বলেছিলেন গুগলের চেয়ারম্যান জন হেনেসসি।
মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা
আরেকটা ব্যাপার ভারতীয়দের এগিয়ে রাখে সেটা হচ্ছে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা। এই কেসে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যাক মাইক্রোসফটের ভারতীয় সিইও সত্য নাদেলাকে। অর্থনীতিতে মারত্মকভাবে পিছিয়ে থাকা ভারতের প্রদেশগুলোর একটি হচ্ছে তেলেঙ্গানা। সত্য নাদেলার জন্ম সেখানেই। বাবা আইএস অফিসার ছিলেন আর মা সংসদের অধ্যাপক। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকে আইইটির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন সত্য, তবে ফেইল করেন সে পরীক্ষায়। তবে কর্নাটকের প্রত্যন্ত এক ভার্সিটি থেকে সুযোগ পান ইঞ্জিনিয়ারিং এর। সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন করে চলে আসেন আমেরিকায়। আমেরিকায় কম্পিউটার সায়েন্সে এমএস করলেন। তারপর যোগ দিলেন বিল গেটসের মাইক্রোসফটে। সত্য নাদেলাকে মাইক্রোসফট তাদের সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয় ২০১৪ সালে। গুগলের সুন্দর পিচাইয়ের আগে সত্য নাদেলাই ছিলেন টেক ওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ভারতীয় মুখ, যিনি আমেরিকার মতো দেশের আইটি সেক্টরের সবচেয়ে বড় কোম্পানীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন।
মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা
ভারতীয় সত্য নাদেলা এসেছেন ঘুনে ধরা শহর থেকে, যেখানে মেট্রোরেলের জন্য চাপাচাপি ভিড় সহ্য করতে হয়। এছাড়া ভারতীয় এমন একটি প্রদেশ থেকে, যেখানে অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। তিনি আমেরিকার বিত্তশালী একটি কোম্পানিতে এসে মানিয়ে নিতে পেরেছেন। তাঁর এই এডাপ্টিবিলিটি (Adaptibility) বা মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে আমেরিকানরা।
ভারতের প্রত্যন্ত একটা অঞ্চল থেকে উঠে এসে সত্য নাদেলা আমেরিকান জায়ান্ট একটা কোম্পানিতে কাজ করছেন, তাতে সাফল্যও পাচ্ছেন। অর্থাৎ তাঁর সার্টিফিকেট যোগ্যতা ছাড়াও মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাটা বেশ অসাধারণ লেভেলে। তাঁকে দিয়ে বিশ্বের যে কোনও স্থানে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় কাজ করানো যাবে। আর এটাকেই দেখেছে আমেরিকানরা। তাঁরা ভেবেছে তাদের জায়ান্ট কোম্পানিটির নেতা হিসেবে এই ভারতীয় নাগরিকটির বেশি কেউ যোগ্য হতেই পারেন না।
আনুগত্য
'নুন খাইলে গুণ গাইতে হয়' প্রবাদের মতোই নিজেদের সবকিছুতে ভারতীয়দের শ্রদ্ধা রয়েছে। এটা তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম বা নিজের পরিবার এমনকি প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানী এডোবি (Adobe) কর্পোরেশনের সিইও শান্তনু নারায়ন তাঁর বড়সড় উদাহরণ। হায়দ্রাবাদের একটি ভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক করেন তিনি। পরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এডোবিতে জয়েন করার আগেই অ্যাপল আর সিলিকন গ্রাফিক্সে কাজ করেছেন তিনি।
১৯৯৮ সালে শান্তনু যখন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এডোবিতে যোগ দেন, তখন সিলিকন ভ্যালিতে গুগল, মাইক্রোসফট আর অ্যাপলের জয়জয়কার শুরু হয়েছে। একাধিকবারই চড়া বেতনের অফার পেয়েছেন শান্তনু। যে বেতন এডোবি তাঁকে দেয় বা দিতো, তাঁর চেয়েও বেশি বেতনে চাকরির অফার পেয়ছেন বহুবার। তাই এডোবি শান্তনুর আনুগত্যকে পুরস্কৃত করেছে।
এডোবির সিইও শান্তনু নারায়ন
শান্তনুর আনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে এডোবি কর্পোরেশন ২০০৫ সালে চীফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে পদোন্নতি দেয় তাঁকে। এর দুই বছরের মাথায় ২০০৭ সাল থেকে শান্তনু নারায়ন এডোবির সিইও (CEO) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কমিউনিকেশন স্কিল
আরেকটি ব্যাপার আছে, যেটি ভারতীয়দের অন্য নাগরিকদের থেকে এগিয়ে রাখে। সেটি হলো কমিউনিকেশন স্কিল বা যোগাযোগ দক্ষতা। পৃথিবীতে ভারতীয়দের মতো যোগাযোগ দক্ষতা অন্য নাগরিকদের মধ্যে এতোটুকুও দেখা যায় না। জার্মান বা ফ্রেঞ্চরা বেশিরভাগ সময়ে টুকটাক ইংরেজি ছাড়া অন্যকিছুতে যোগাযোগে অক্ষম। জাপানি বা চীনা নাগরিকদের কথা বলার দরকারই নেই, তাঁরা নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা জানলেও কথা বলতে চায়না বললেই চলে।
অন্যদিকে দেশের বাইরে পড়াশুনা বা চাকরির উদ্দেশ্যে আসা শিক্ষিত ভারতীয়রা ইংরেজি বলেন নেটিভ ল্যাঙ্গুয়েজের মতো করেই। এছাড়াও ভারতের সব প্রদেশে আলাদা ভাষা থাকায় তাঁরা ইন্টারন্যশনাল ভাষা ইংরেজিতে এমনিতেই দক্ষ থাকেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের অনেক মানুষের মুখের ভাষা ইংলিশ, মুম্বাই বা দিল্লীতেও দেখা যায় ইংলিশ ভাষার আধিক্য।
চীন, জাপান, কোরিয়ায় মেধার কমতি নেই। তাঁরা যথেষ্ঠ পরিশ্রমীও, টেকনিক্যালিও এগিয়ে তাদের দেশ। তবু কমিউনিকেশন স্কিল তাদের জিরো লেভেলে। তাঁরা মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষাকে সম্মান দিতে ইতস্তত বোধ করেন, কথাও বলেন কম। অন্যদিকে সিইও বেঁছে নিতে একটি কোম্পানি চায় কমিউনিকেশন স্কিল যার অনন্য, তাকেই নিতে। কারণ সিইও তাঁর ভাষণ বা স্পিচের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করেন কর্মীদের কঠোর পরিশ্রমে। তাই এক্ষেত্রেও ছক্কা হাঁকাতে পেরেছেন ভারতীয়রা বিশ্বব্যাপী। ফলাফল- সিইও হিসেবে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ভারতীয়রা।
শিক্ষায় প্রযুক্তির ছোঁয়া ভারতে শুরু থেকেই
সুন্দর পিচাই ধরুন, বা শান্তনু নারায়ন। ভারতীয় যে সিইওরাই বাইরের বিশ্ব কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা কিন্তু আগে নিজেদের ভারতে আইটি বিষয়ে দক্ষ হয়ে এসেছেন। পড়াশুনা করেছেন ভারতের বিভিন্ন আইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থাৎ ভারতীয়রা সিইও সাপ্লাইয়ে আগে থেকেই রেডি। নিজেদের দেশে প্রচুর সংখ্যায় গড়ে তুলেছে আইটি বিশ্ববিদ্যালয়, আইটি ফার্ম, পাবলিক-প্রাইভেট স্কুল।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সক্ষমতা এবং পড়াশুনার মানে কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে বুড়ো আঙুল দেখাতে সক্ষম। গোড়া থেকেই গড়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় ইঞ্জিনারদের। তাহলে তাঁরা কেনো সিইও হতে পারবেন না বিশ্বের টেক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোতে?
ভারতে আছে বিশ্বজোড়া সুনাম পাওয়া আইআইটি বা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। আর বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়ানো ভারতীয়দের এক বড় অংশ পাশ করেগেছেন এই আইআইটি থেকে। আমাদের দেশেও কিন্তু এমন প্রতিষ্ঠান আছে- বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েট ইত্যাদি। তবে ভারতে এক আইআইটির শাখা প্রচুর। সবখানে উন্নতমানের পাঠদান, খেলার মাধ্যমে যেন শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দেওয়া হয় প্রযুক্তির ভিতরের থিওরি। অরবিন্দ কৃষ্ণা, সুন্দর পিচাই, শান্তনু নারায়ণ, পরাগ আগারওয়াল, জর্জ পুলিয়ান এরা সবাই এই আইআইটির ছাত্র।
এছাড়া ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাও আশেপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইর্ষণীয়। প্রতি বছর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ভারতীয়দের ৫-১০টি ইউনিভার্সিটি থেকে যায়, যেখানে বাংলাদেশের বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকবারই স্থান করতেই পারেনা।
একইসাথে বাংলাদেশি এবং ভারতীয়। সিইও হবেন কে?
টেকনিক্যাল কথাবার্তা বাদ দিয়ে ফেরা যাক বাস্তব দুনিয়ায়। ধরুন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একই দায়িত্বে আছেন দুজন। একইরকম দক্ষ, একইরকম সার্টিফিকেটের জোর। এদের একজনকে দেওয়া হবে সিইও পদ। কাকে বেঁছে নেওয়া হবে?
উত্তর হিসেবে পচানব্বই শতাংশ যাবে ভারতীয় সেই কর্মীর পক্ষে। কোনও কারণ ছাড়াই। কেনো? একটু ভেবে দেখুন, আপনার কোম্পানির সিইও হিসেবে কাকে দিলে মার্কেট বেশি ধরতে পারবেন? ১৮ কোটি নাগরিকের মধ্য থেকে উঠে আসা বাংলাদেশিকে দিলে নাকি ১২০ কোটি নাগরিকের দেশ থেকে উঠে আসা ভারতীয়কে দিলে? সোজা হিসেব।
ভারতীয়দের সিইও হিসেবে দিলে একটা সুযোগ বেশি পাওয়া যায়। এটা হচ্ছে ভারতীয়দের মারাত্মক বড় একটি মার্কেট ধরা সহজ হয়। টুইটার হোক, আমাজন হোক বা অ্যাপল, ভারতে মার্কেট করলেই খুশি। ভারত যেহেতু কোম্পানিগুলর বড় একটি মার্কেটপ্লেস, তাহলে সিইও ভারতীয় হলে সেই বড় মার্কেটপ্লেস ধরতে সুবিধা পাবে কোম্পানী, এছাড়া ভারতীয়রাও কোম্পানিটিকে নিজেদের কোম্পানি হিসেবে দেখবে।
এই কথাটি অসম্ভব মনে হচ্ছে? উড়িয়ে দেওয়ার আগেই একটি সত্য ঘটনা দেওয়া যাক। নেসলে (Nestle) কোম্পানিতে ঘটেছে এই ঘটনা। নেসলে গ্লোবালের ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন ভারতীয় নাগরিক সঞ্জয় বাহাদুর। সঞ্জয় এই দায়িত্বটি পাওয়ার সময় তাঁকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে এক শ্রীলঙ্কানের সাথে। কিন্তু এশিয়ায় নেসলের সবথেকে বড় মার্কেট ভারত, তাই কোনও কারণ ছাড়াই সঞ্জয় পেয়ে যান এই দায়িত্ব।
প্রতিবেশি হয়েও বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে?
সিলিকন ভ্যালিতে ভারতীয় সিইওদের জয়জয়কার চলছে। সিলিকন ভ্যালির বাইরেও ভারতীয়দের সুনাম। কিন্তু ভারতের ঠিক পাশের দেশ হয়েও বাংলাদেশ কেন তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না?
কারণটা অনুসন্ধান করতে কয়েকটি টপিক দেওয়া যাক।
- ভারতের মতো একটি আইআইটি আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। অর্থাৎ এমন একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান, যার শাখা সারা দেশে থাকবে অথচ সব শাখায় পড়াশোনার মান থাকবে একইরকম।
- আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি কখনোই। বাইরের দেশ থেকেও শিখতে পারছি না, বাইরের দেশের যোগ্য শিক্ষকদের এদেশে পড়ানোর জন্য নিয়ে আসাও জনপ্রিয় হচ্ছেনা।
- আমরা দেশজুড়ে ইংরেজি শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। এটি আমাদের বড় অংশকে পিছিয়ে রেখেছে। সিলেটের অধিকাংশ পরিবারের কেউ না কেউ উন্নত বিশ্বে আছেন। অথচ তারাও পিছিয়ে ইংরেজিতে। বছরের পর বছর বিদেশে থাকা সত্ত্বেও সেখানে তাঁরা বাংলাতেই কথা বলেন কর্মস্থলেও।
আমাদের দেশ ছোট্ট একটা দেশ। নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের তুলনায় কতোশত সহজ। আর সবকিছু নয়, শুধু শিক্ষাব্যবস্থা ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করলেই যথেষ্ঠ হবে এক্ষেত্রে। আমাদের দেশে এক শিক্ষাব্যবস্থায় কতো ভিন্নমত- বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম, মাদ্রাসা কারিকুলাম, ক্যাডেট কারিকুলাম, ভোকেশনাল কারিকুলাম কতোশত শিক্ষাপদ্ধতি খুলে রাখা হয়েছে। অথচ প্রতিটা পদ্ধতিতেই দুর্নীতি ভরা, ভুলে ভরা।
আর বাংলাদেশের এসব কারণেই এদেশের শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে। আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে পারছিনা বললে চলে, স্টুডেন্ট ভিসা আমাদের রিজেক্টও হয় বেশি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বাইরে পড়তে যাওয়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে শ্রমিক হিসেবে যেতে বেশি আগ্রহী।
দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কোনওরকমে বাইরের দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার সুযোগ পেলেও তাদের অনেকেরই যাওয়া হয়ে ওঠেনা। কারণ এর জন্য কম হলেও কয়েক লাখ টাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়না, কোনও লোন বা এরকম সিস্টেমও নেই, উপবৃত্তি বা বৃত্তির কথা না বলাই উত্তম। অথচ দেশের আমলারা বা সরকারি অফিসাররা ছোটখাট প্রশিক্ষণের জন্য বড় বাজেট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ করেন প্রায় প্রতি মাসেই।
বাংলাদেশে আছে ভারতের মতো অনেকগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেখানে পড়াশোনার থেকে বেশি মনযোগ দেওয়া হয় দেশের রাজনীতিতে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত থাকা এদেশে ফ্যাশন হয়ে উঠেছে। সেখানকার শিক্ষকদেরও ক্লাসে পড়ানোর চেয়ে বেশি আগ্রহ ছাত্ররাজনীতিগুলোতে।
বাংলাদেশে বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে হয় আবরার হত্যাকাণ্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা চুরি করেন ছাত্রের থিসিস। গোটা পৃথিবীর কথা বাদ দিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার হাতেগোনা দেশের সাথে তুলনা করা যাক। শিক্ষাখাতে বাজেটে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখি আমরা, আর যাও রাখা হয় তাঁর অনেকটাই চলে যায় ভুল হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সিস্টেম মুখস্থবিদ্যায় ভর করে, সেসব শিক্ষার্থীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়না, হয়ে ওঠে মুখস্থবিদ্যায় ওস্তাদ। এছাড়াও দেশের বর্তমান প্রজন্মের ভালোকরে বুঝা হয়েছে, পড়াশোনা ব্যাপারটা শুধু চাকরির জন্যই। চাকরি যে পদ্ধতিতে আগে, সে পদ্ধতিতে পড়াই ভালো, এক্ষেত্রে মার খায় শিক্ষার্থীর নিজস্ব প্যাশন।
বিসিএস বা সরকারি চাকরির দৌড়ে দেশের সকল শিক্ষার্থী। গতানুগতিক ধারা ভাঙা বা নতুন কিছু করার প্রবণতা দেশের শিক্ষার্থীদের নেই বললেই চলে।
আর তাহলে কোন মুখে আবার চান বাংলাদেশিরা ভারতীয়দের টক্কর দেবে টেকবিশ্বে? ভারতীয় সিইওদেরই হোক জয়জয়কার।
আইনিউজ/এসডি
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ