তমাল দাশগুপ্ত
আপডেট: ২৩:৪২, ১৮ এপ্রিল ২০২২
চড়ক উৎসব : নবতাৎপর্য
১৭৯৮ সালে কলকাতায় চড়ক উৎসবের চিত্র (অজানা শিল্পী)।
চড়ক পূজা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা চড়ক সংক্রান্তির মেলা নামে অভিহিত।
বাঙালির পূর্বমানুষ বলাকা মাতৃকার উপাসনা করতেন, যার প্রত্নপ্রমাণ পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে পাওয়া যায়, এবং বৈদিক আর্যের "বয়াংসি" শ্লোকও সেদিকে ইঙ্গিত করছে। পক্ষীমাতৃকার উপাসকরা এই উড্ডিয়ান ভঙ্গিতে মায়ের আবাহন করতেন, এটি সঙ্গত অনুমান।
১. হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই চক্র হল মাতৃকার আবহমান প্রতীক। এ বিষয়ে একাধিক গবেষণা হয়েছে। মূর্তি ব্যতীতও aniconic ভাবে মায়ের উপাসনা হত এবং চক্র ছিল এই বিমূর্ত বা aniconic উপাসনায় মায়ের প্রধান দ্যোতক। এরপর বিষ্ণুভাগবত ধর্ম চক্রের বহুল ব্যবহার করে (বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে তন্ত্র ও মাতৃকা উপাসনার সম্পর্ক নিয়ে আগে অনেকবার লিখেছি)।
২. বছর ঘুরে আসে, চক্রাকারে আমাদের ঋতুসমূহের আবর্তন হয়। চড়ক সেই বর্ষশেষ ও বর্ষসূচনার ইঙ্গিত দেয়।
৩. আবার কালচক্র। কালের পরিক্রমা চক্রাকারে ঘটে। ভারত মননে সময়ের ধারণা রৈখিক নয়, চক্রাকার। ভারতীয় তন্ত্রের ঐতিহ্যে কাল ও কালী অভিন্ন। কালচক্রযান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তন্ত্রধর্মীয় মার্গ। চড়ক এই কালচক্রের প্রতীক।
৪. সংসার দুঃখময়, এই দুঃখকে বরণ করে নিতে শেখায় ক্লেশ ও কৃচ্ছ্রসাধনের চড়ক উৎসব। শরীরকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলার শিক্ষা দেয় চড়ক: দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা। আবার সুখ ও দুঃখেরও চক্রাকারে আবর্তন, সেজন্যও চড়ক।
৫. বাঙালির প্রাচীনকালের যুদ্ধেও সম্ভবত এর ব্যবহার ছিল, দুর্গস্থিত শত্রুকে যুদ্ধ শিবিরে স্থাপিত চড়ক গাছ থেকে তীর ছুঁড়ে ব্যতিব্যস্ত করা হত। চড়ক একরকম মার্শাল আর্ট।
৬. মাতৃকা উপাসনার উৎসবেও চড়ক গাছের ব্যবহার ছিল। আমরা পালযুগে মা দুর্গার বিভিন্ন মূর্তি মণ্ডলের উপরের দিকে উড্ডীয়মান সহচর-সহচরী দেখি। বাস্তবে বাঙালির মাতৃপূজা মণ্ডপে এই চড়ক গাছ স্থাপিত হত, এবং সেখানে মাতৃকার গণ বা সহচর ঘূর্ণায়মান থাকতেন, এরকম খুবই সম্ভব, যে প্রথা মধ্যযুগে ইসলামিক আগ্রাসনে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এখন আর মূর্তিমণ্ডলে এই বিদ্যাধর বিদ্যাধরী দৃশ্যমান হন না। আবার আর্যাবর্ত বৈদিক পৌরাণিক বর্ণবাদী বিকৃতির ফলেও বিদ্যাধর বিদ্যাধরী হারিয়ে গেছেন, এ সম্ভাবনাও আছে। দুদিকের আগ্রাসনই রূঢ় সত্য, অস্বীকার করা যায় না।
৭. চড়ক গাছ আমাদের মধ্যে বৃক্ষ উপাসনা এবং বৃক্ষস্থিত মাতৃকা উপাসনার স্মৃতিবাহী, যা হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই জনপ্রিয়।
৮. একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বাঙালির পূর্বমানুষ বলাকা মাতৃকার উপাসনা করতেন, যার প্রত্নপ্রমাণ পাণ্ডু রাজার ঢিবি থেকে পাওয়া যায়, এবং বৈদিক আর্যের "বয়াংসি" শ্লোকও সেদিকে ইঙ্গিত করছে। পক্ষীমাতৃকার উপাসকরা এই উড্ডিয়ান ভঙ্গিতে মায়ের আবাহন করতেন, এটি সঙ্গত অনুমান।
৯. আবার উড্ডিয়ান নামে এক বিখ্যাত তন্ত্রক্ষেত্রের কথা জানা যায়। চড়ক গাছে উড্ডিয়ান সাধকরা সেই তন্ত্রক্ষেত্রের স্মৃতিবাহীও হতে পারেন।
ইতিহাস মুছে দেবে যতবার বিজাতীয় আগ্রাসন, ততবার ধ্বংসস্তূপে হবে মায়ের নতুন আবাহন।
তমাল দাশগুপ্ত, বাঙালির ইতিহাস-শেকড়-সংস্কৃতি-আত্মপরিচয়ের সন্ধানে উদ্যত একজন ভাষাকৃষক ও ইতিহাসশ্রমিক
[লেখাটি লেখক তমাল দাশগুপ্তের অনুমতিক্রমে তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে [প্রকাশকাল : চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২৯] সংগ্রহ করে আই নিউজ-এর পাঠকদের জন্য পাবিলিশ করা হয়েছে।]
আইনিউজ ভিডিও
১৫ হাজার টাকার মধ্যে বাজারের সেরা ৫ ফোন
মাথায় ৭৩৫টি ডিম নিয়ে বিশ্বরেকর্ড
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ