শ্যামলাল গোঁসাই
গৌতম বুদ্ধের গল্প
যেভাবে গৌতম বুদ্ধ একজন খুনীকে সন্ন্যাসী বানিয়েছিলেন
গৌতম বুদ্ধ ও খুনি অঙ্গুলিমালা। প্রতীকী ছবি
বহুকাল আগের ঘটনা। গৌতম বুদ্ধের একজন ঘনিষ্ট শিষ্য ছিলেন, যার নাম ছিলো অঙ্গুলিমালা। তবে এটিই তার প্রকৃত নাম নয়। তার একটি পারিবারিক নাম ছিলো বলেও জানা যায়, কিন্তু ঠিকঠাকভাবে কেউ তার সে নামটি বলতে পারেন না। তাই সকলেই তাকে অঙ্গুলিমালা বলে ডাকেন।
অঙ্গুলিমালা ঘটনাচক্রে গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং একজন সন্ন্যাসী হন। সন্ন্যাস জীবনের আগের জীবনে অঙ্গুলিমালা ছিলেন একজন ভয়ংকর মানুষ। সেটা তার নামের বিবরণ শুনলে অনেকে বুঝে যাবেন।
লোকে তার নাম অঙ্গুলিমালা দিয়েছিলেন কারণ অঙ্গুলিমালা তার গলায় মানুষের হাত থেকে কেটে নেয়া একশোটি বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তৈরি মালা পরতেন। শোনা যায়, তিনি যে এলাকায় থাকতেন কোনো এক কারণবশত সেই এলাকার মানুষদের প্রতি তার মনে তীব্র ক্রোধ, ক্ষোভের জন্ম নেয়। এবং তিনি একটি ভয়ংকর পণ করে বসেন। অঙ্গুলিমালা পণ করেন যে মানুষদের কারণে তাকে এমন দূর্গতি পোহাতে হচ্ছে সেইসব মানুষদের মধ্যে একশো একজনকে তিনি হত্যা করবেন।
অঙ্গুলিমালা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিলেন পাশের এক জঙ্গলে। এই জঙ্গলে আশ্রয় নেয়ার কারণ এখানে তাকে কেউ দেখবে না আবার তার হত্যার কাজটিও সহজেই সম্পন্ন করা যাবে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে লোকজনকে আসাযাওয়া করতে হতো। অঙ্গুলিমালা তার পণ অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড শুরু করলেন। যাকেই হত্যা করতেন তার হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি কেটে গলায় মালা বানিয়ে পরতেন। এরকম করে ধীরে ধীরে তার মালায় একশোটি হাতের কাটা বুড়ো আঙ্গুল জমা হয়। সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় অঙ্গুলিমালা।
অঙ্গুলিমালা ওই গ্রামের একশো জনকে ইতিমধ্যে হত্যা করে ফেলেন। পুরো এলাকায় অঙ্গুলিমালার নাম শুনলে বুড়ো, বাচ্চা, যুবক সকলেই আতংকিত হয়ে যেতেন। কারণ প্রতিদিনই জঙ্গলের রাস্তায় কারো না কারো বুড়ো আঙ্গুল কাটা মৃতদেহ পাওয়া যেতো। অঙ্গুলিমালা এসব হত্যা করে পৈশাচীক আনন্দ বোধ করতেন। গ্রামের সবাই তাকে ভয় পেতো বলে তার গর্ববোধ হতো। ওই গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের কাওকে না কাওকে অঙ্গুলিমালার হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে।
এদিকে অঙ্গুলিমালার পণ পূরণ করতে আর মাত্র একজন লোককে হত্যা করতে হবে। তিনি শেষ হত্যাটি করবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এমনসময় একদিন ওই গ্রামে আসেন গৌতম বুদ্ধ। গ্রামের সকলেই তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। তার কাছ থেকে অনেককিছু জানতে চান, কেননা তিনি ছিলেন একজন আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি। তার ব্যক্তিত্ব সবাইকে আকৃষ্ট করতো। দুই চারদিন ওই গ্রামে অবস্থান করার পর গৌতম ফিরে যাবেন বলে স্থির করলেন। এবং যখন তিনি বললেন যে, ওই জঙ্গলের রাস্তাটি ধরে তাকে যেতে হবে তখন গ্রামের সকলেই তাকে এই পথ দিয়ে যেতে বারণ করলেন এবং অঙ্গুলিমালার ঘটনা খুলে বললেন। তারা বললেন, অঙ্গুলিমালা একটা পশু হয়ে গেছে। সে মানুষকে হত্যা করে আনন্দ পায়। আর তার পণ পূরণ করতে মাত্র একজনকে হত্যা করার বাকি। আপনি যদি ওই রাস্তা দিয়ে যান তাহলে সে আপনাকেও হত্যা করবে এবং তার পণ পূরণ করে নতুন কোনো ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাতে উদ্যত হবে।
গৌতম তখম শান্তভাবে বললেন, তাহলে তো আমাকে অবশ্যই সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়া উচিত। আমাকে হত্যা করে যদি অঙ্গুলিমালার ইচ্ছা পূর্ণ হয় ওতে আপনাদের ক্ষতি কোথায়? বরং আমি যদি না যাই সে তার ইচ্ছা পূরণ করতে আপনাদের মধ্য থেকেই কাওকে না কাওকে হত্যা করবে। সুতরাং, আমাকে যেতে দিন।
গ্রামের সবাই গৌতমকে বারবার বারণ করা সত্বেও তিনি জঙ্গলের ওই রাস্তা দিয়ে চললেন। তিনি যখন ঘন জঙ্গলে নিস্তব্ধ পরিবেশে রাস্তায় হাঁটছিলেন হঠাৎ দেখলেন অঙ্গুলিমালা রাস্তার পাশেই হাতে ইয়া বড় ছুরি নিয়ে একটি পাথরের উপর বসে আছেন। তার গলায় ঝুলছিলো একশোটি কাটা বুড়ো আঙ্গুলের মালা। তিনি কিছু না বলেই চুপচাপ হেঁটে যেতে লাগলেন। এমনসময় অঙ্গুলিমালা হুংকার দিয়ে উঠলেন, 'ওহে যাচ্ছো কোথা? তোমার সাহস তো কম নয়! আমার ব্যাপারে কি তুমি কিচ্ছু শোনো নি? কেউ বলে দেয়নি তোমাকে এই অঙ্গুলিমালা কে?'
গৌতন স্বাভাবিকভাবে বললেন, 'হ্যাঁ আপনার ব্যাপারে আসতে আসতে অনেক কিছুই শুনলাম। তবে ওতে আমার কিছু যায় আসে না।' বলেই গৌতম আবার হাঁটা শুরু করলেন।
গৌতমের এহেন কথা শুনে অঙ্গুলিমালা ভয়ংকরভাবে ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ' দাঁড়াও। আমার ব্যাপারে শোনেও তোমার ভয় হচ্ছে না? তুমি কোথায় যাচ্ছো? তুমি কি জানো আমি চাইলে এক্ষুণি তোমার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দিতে পারি। আমি না বলা পর্যন্ত তুমি কোথাও যাবে না।'
গৌতম বললেন, 'আমি তো কোথাও যাচ্ছিনা। আমার কোথাও যাবার দরকারও নেই। কারণ, আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। আমার মনে হয় আপনি কোথাও যেতে চাচ্ছেন কিন্তু সঠিক রাস্তায় অভাবে পৌঁছুতে পারছেন না।'
গৌতমের এ কথা শুনে অঙ্গুলিমালা আরও ক্ষেপে গেলেন আর বললেন, 'তুমি তো আচ্ছা পাগল লোক দেখছি। আমি এখানে বসে আছি অথচ বলছো আমি কোথাও যেতে চাচ্ছি কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না। এদিকে তুমি হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছো তবু বলছো তুমি কোথাও যাচ্ছো না, পৌঁছে গেছো!'
গৌতম বুদ্ধ
গৌতম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'আমার কাজ মানুষকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া। আপনার যদি মনে হয় আমাকে হত্যা করে আপনি আপনার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে হত্যা করতে পারেন। কিন্তু হত্যার আগে একবার এটা ভাবুন এতে কিই সত্যিই আপনার অবস্থার পরিবর্তন হবে বা আপনি প্রকৃত সুখী হতে পারবেন? আপনাকে সবাই ভয় পায় বলে গর্ববোধ করেন? অথচ গর্ববোধ তখন হবার কথা যদি কেউ আপনাকে সম্মান করতো। আপনার কি মনে হয় কেউ আপনাকে সম্মান করে?'
এই কথা শুনে অঙ্গুলিমালা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি এতোদিন ধরে এতো এতো মানুষকে হত্যা করেছেন সত্যি, সবাই তাকে ভয় পায় এটাও সত্যি কিন্তু কেউ তাকে সম্মান করেনা। সম্মান অর্জনের মতো কোনো কাজই তিনি করেন নি! এভাবে তিনি কখনোই সম্মান অর্জন করতে পারবেন না। অঙ্গুলিমালার মনে পরিবর্তন আসলো। তিনি হাতের ছুরি ফেলে দিয়ে গৌতমের পায়ে পড়ে কান্না করতে লাগলেন। তিনি গৌতমকে তাঁর শিষ্য করে নেয়ার অনুরোধ করেন।
গৌতম তখন বলেন, আমি আপনাকে শিষ্য হিশেবে গ্রহণ করবো। কিন্তু তার আগে আপনাকে একবার সেই গ্রামে ফিরে যেতে হবে। যে গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবারের কাওকে না কাওকে আপনি হত্যা করেছেন। আপনাকে গিয়ে দেখে আসতে হবে তারা কীরকম আছেন এবং আপনার ব্যাপারে কী ভাবেন।
অঙ্গুলিমালা সেই গ্রামে ফিরে যেতে রাজি হলেন। গৌতম তাকে একটি গেরুয়া বসন পরিয়ে দিলেন। যা মূলত সন্ন্যাসীরা পরিধান করেন। তার গলা থেকে আঙ্গুলের মালা সরিয়ে নিলেন।
একদিন সকালে অঙ্গুলিমালা একা একা সেই গ্রামে প্রবেশ করলেন। সবাই তাকে দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেলো। গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো অঙ্গুলিমালা এসেছে, অঙ্গুলিমালা এসেছে, নিশ্চই সে গৌতমকে হত্যা করে ফেলেছে।
সবাই ভয়ে ঘরের দরজা জানালা লাগিয়ে দিলো। কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরে অঙ্গুলিমালাকে শান্ত স্বভাবে দেখে সবাই কিছুটা অবাক হলেন। তারা বাইরে বেরিয়ে এলেন এবং সবাই অঙ্গুলিমালার উপর আক্রমণ করে বসলেন। ইট, পাথর, মাটির ঢেলা তার দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলেন। কিন্তু অঙ্গুলিমালা কিচ্ছু করলেন না, কিচ্ছু বললেন না। সহ্য করে গেলেন। তার অবস্থা যখন খুব শোচনীয় তখন গৌতম এসে হাজির হলেন এবং সবাইকে থামতে বললেন।
সবাই তখন অবাক হয়ে বললো, আপনাকে আমরা আমাদের প্রভু জ্ঞান করি। আমরা ভাবছিলাম সে বোধয় আপনাকেও হত্যা করে ফেলেছে। আপনি কেন এই নিষ্ঠুর, বর্বরকে বাঁচাতে চাইছেন। একে মেরে ফেলাই তো উচিত।
গৌতম বললেন, তোমরা যাকে মারতে চাইছো এই মানুষটি সেই মানুষটি নয়। এই মানুষটি অনেক কঠোর অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়ে আজকের এই মানুষটিতে পরিণত হয়েছেন এবং তিনি এখন ভালো হয়ে বাঁচতে চান। আপনারা তাকে এ সুযোগটি দেবেন না? তখন গ্রামের সবাই আর কিছু বললো না। এভাবেই গৌতম বুদ্ধ একজন খুনিকে সন্ন্যাসীতে রূপান্তর করলেন।
অঙ্গুলিমালা পরবর্তী জীবনে অনেক বড় একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। যিনি বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গৌতমের আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজও কিছু এলাকায় অঙ্গুলিমালার এ গল্প শোনা যায়।
শ্যামলাল গোঁসাই, ফিচার প্রতিবেদক, আইনিউজ
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ