হেলাল আহমেদ
আপডেট: ১৪:৪৪, ২৭ জুন ২০২২
মুরারিচাঁদ কলেজ: শিক্ষার আলো ছড়ানোর ১৩০ বছর
মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট যেখানে হিরন্ময় ঐতিহ্যের পতাকা উড়ে পত পত করে। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় অনিন্দ্যউজ্জ্বল দীপশিখা এ মুরারিচাঁদ কলেজের জন্ম ১৮৯২ সালের ২৭ জুন। সিলেটের শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘ ১৩০ বছর ধরে অবদান রেখে আসছে কলেজটি। সেই সাথে সিলেটের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ হিসেবে এটি বর্তমানে সিলেটের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য।
মুরারিচাঁদ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় তৎকালীন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের অনুদানে। কলেজটির নাম মুরারিচাঁদ করা হয় তার প্রমাতামহ মুরারিচাঁদ এর নামে। পূর্বে কলেজটি সিলেটের বন্দর বাজারের নিকট রাজা জি. সি. উচ্চ বিদ্যালয় এর পাশে অবস্থিত ছিল। ১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফ. এ. ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মুরারিচাঁদ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। সেসময় ছাত্রদের বেতন ছিল ৪ টাকা এবং ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশকৃতদের জন্য বিনা খরচে পড়ার ব্যবস্থা ছিল।
১৮৯২ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত রাজা গিরিশচন্দ্র রায় নিজেই কলেজটির সকল খরচ বহন করেন। ১৯০৮ সালে রাজা মারা গেলে কলেজটি বন্ধ হবার অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তখন থেকে কলেজটি সরকারি সহায়তায় পরিচালিত হতে থাকে। এরপর ১৯১২ সালে কলেজটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কলেজ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। একই বছর তৎকালীন আসামের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল কলেজটিকে ২য় শ্রেণির কলেজ থেকে ১ম শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন । ১৯১৩ সালে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস চালু হয়। পরবর্তীতে জননেতা আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) সহ আরও অনেকে মিলে ১৮০০০ টাকা অনুদান দিলে কলেজটিতে স্নাতক শ্রেণি চালু হয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য নানা সমস্যার কারণে কলেজের ক্যাম্পাস পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন কলেজ থেকে ৩ কি. মি. দূরে থ্যাকারে টিলায় (বর্তমান টিলাগড়) ১২৪ একর ভূমি নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাসে কলেজ স্থানান্তর করা হয়। সে সময় কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৫৬৮ জন। ১৯২১ সালে তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস কলেজের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯২৫ সালে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম রীড।
১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। দেশ বিভাগের পর এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬৮ সালে কলেজটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়, এবং সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এর মত মুরারিচাঁদ কলেজটিকেও বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত করা হয় এবং অদ্যাবধি রয়েছে।
সিলেট মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাসের এক মহান নায়ক সৈয়দ আব্দুল মাজিদ (কাপ্তান মিয়া)। ১৮৯৭ সালের বিরাট ভূমিকম্পের ফলে রাজার বাড়ি ঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি ঋণ গ্রহণ করে তা পুনর্নির্মাণ করতে যেয়ে ধীরে ধীরে আর্থিক অনটনে পতিত হন। ১৯০৮ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্রের মৃত্যুর পর এইডেড প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বাবু দুলাল চন্দ্র দেব এবং কাপ্তান মিয়ার উদ্যোগে কলেজটি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। সেই সময় মুরারিচাঁদ কলেজ সিলেট শহরের ভিতর ছিল এবং প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি কলেজের উপযুক্ত পরিবেশ এবং দালান কোঠা সেখানে ছিলনা। তিনি শহর থেকে তিন মাইল দূরে ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বর্তমান মুরারিচাঁদ কলেজ প্রাঙ্গণের ভিত্তির সূচনা। কাপ্তান মিয়া কলেজের নতুন কোনো নাম বা নিজের নাম না দিয়ে এই নতুন প্রাঙ্গণে কলেজটিকে মুরারিচাঁদ কলেজের নামই রাখেন। রাজা গিরিশ চন্দ্রে যে বীজ বপন করেছিলেন কাপ্তান মিয়া সেটাকে মহীরুহুতে পরিণত করেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে সিলেট আগমন করলে তাকে যে বিরাট সংবর্ধনা দেয়া হয়, আব্দুল মাজিদ কাপ্তান মিয়া ছিলেন সেই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি।
সিলেটের প্রাচীন এই শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার্জন করে পবর্তীতে খ্যাতি কুড়িয়েছেন অনেক দেশ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও বামপন্থী রাজনীতিবিদ আবু তাহের, বীর উত্তম,খ্যাতিমান ঐতিহাসিক নীহার রঞ্জন রায়, জনপ্রিয় রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও সমালোচক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এই কলেজেই পড়াশোনা করেছেন।
এছাড়াও দেশের অনেক বাঘাবাঘা রাজনীতিবিদদেরও এককালে ক্যাম্পাস ছিলো এই প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। এদের মধ্যে পাকিস্তানের সাবেক শিল্পমন্ত্রী আলতাফ হোসেইন, ভারতের সাবেক এমপি এবং আসাম সরকারের প্রাক্তন ভেটেরিনারি মন্ত্রী জয় ভদ্র হগজর, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান, আবুল মাল আব্দুল মুহিত, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য শাহীনুর পাশা চৌধুরী, বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অন্যতম।
বর্তমানে সিলেট বিভাগরে চার জেলার শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। প্রতিবছর ফলাফলের দিকেও এগিয়ে রয়েছে কলেজটি। শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমে পড়ালেখার মধ্যেই থেমে নেই; নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত। এমসি কলেজে রয়েছে নাটক সংগঠন থিয়েটার মুরারিচাঁদ, মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন, মুরারিচাঁদ কবিতা পরিষদ, মুরারিচাঁদ ডিবেটিং সোসাইটি, বিজ্ঞান ক্লাব, ফটোগ্রাফি সোসাইটি, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি ও এমসি কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।
বছরজুড়েই তাই নানা অনুষ্ঠান চলে ক্যাম্পাসজুড়ে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষ, বসন্তবরণ, বর্ষবরণসহ নানা আয়োজন করে থাকে। এমসি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করছেন। কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অমিত বিক্রম দেব বর্তমানে কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসায়। ১৯১৯ সালে সিলেটে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমসি কলেজের তৎকালীন ছাত্ররা কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
এই অঞ্চলের শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখা প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ শিক্ষার আলো জ্বেলে জ্বেলে আর ১৩০ বছরে পদার্পণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির এ দীর্ঘ যাত্রায় কেটেছে এ অঞ্চলের দীর্ঘ অন্ধকার, জ্বলেছে জ্ঞানের আলো। সেই আলোয় আগামী প্রজন্মও ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠ দ্বারা আলোকিত হবে এই আশা আমরাও করি।
আইনিউজ/এইচএ
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ