হাসানাত কামাল
আপডেট: ১৭:৪৪, ১৬ আগস্ট ২০২২
মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু : খুঁজে পাই পিতার পদচিহ্ন (ভিডিও)
ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিলেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নেতা। তার প্রমাণ মৌলভীবাজার জেলা। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে যখন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে যাই, খুঁজে পাই পিতার পদচিহ্ন।
এই অঞ্চলের গণমানুষের অস্তিত্বে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম ও তাঁর অবদান। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অবদানের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
পিছিয়ে পড়া চা-শ্রমিকদের সাথে বঙ্গবন্ধুর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। চা-শ্রমিক কেন্দ্রিক মৌলভীবাজারের সাথে বঙ্গবন্ধুর এক ধরনের যোগাযোগ ছিল। চা-শ্রমিক নেতারা তাঁদের সুখে-দুঃখে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেন। বঙ্গবন্ধুও এই অঞ্চলে আসলে চা-শ্রমিকদের খুঁজ নিতেন। তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। এদেশে চা-শ্রমিকদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। বঙ্গবন্ধুই তাঁদের ভোটাধিকার দেন। চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠী তাঁদের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পান, সেটা বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই। আর তাই তো এখনও চা-শ্রমিকেরা প্রতিটি নিঃশ্বাসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।
বঙ্গবন্ধুর সাথে মৌলভীবাজারের আত্মিক সংযোগ
পর্যটন ও প্রবাসীদের জেলা মৌলভীবাজার। হাওর, পাহাড়-টিলা, সমতল ঘেরা প্রকৃতি কন্যা এ জেলায় রয়েছে চা-বাগানের ছড়াছড়ি। তৎকালীন মহকুমা মৌলভীবাজারের মাটি ও মানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর ছিল এক আত্মিক সংযোগ। ঘুরেফিরে বারবার ছুটে এসেছেন এখানকার মানুষের কাছে। আন্দোলন-সংগ্রামে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী চা-শ্রমিকদের প্রতি ছিল তাঁর আলাদা ভালোবাসা। তাদের উন্নয়নে-উত্তরণে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ। সুবিধাবঞ্চিত চা-শ্রমিকদের অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধু নিরন্তর কাজ করে গেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের সবুজ ঘাসে পা ফেলেছেন বঙ্গবন্ধু। তার আগে তৎকালীন আনসার ফিল্ড (বর্তমান ডিসি অফিস), মৌলভীবাজার ক্লাব ও জনমিলন কেন্দ্রে নানা উপলক্ষে এসেছেন। বক্তব্য রেখেছেন দরাজ কন্ঠে।
তাছাড়া বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া, রাজনগর, শ্রীমঙ্গলসহ প্রতিটি উপজেলায় ছুটে গিয়েছেন মানুষের কথা শুনতে। দেশের মানুষকে শোষণ-বঞ্চনার কথা শুনিয়েছেন। দেখিয়েছেন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন।
বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজারে প্রথম পা রাখেন ১৯৫৬ সালে
রাজনীতিবিদ ও গবেষকেরা বলছেন- বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজারে প্রথম পা রাখেন ১৯৫৬ সালে। তখন তিনি যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। শ্রমিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হতে রেলযোগে সিলেট যাত্রাপথে শ্রীমঙ্গল ও কুলাউড়া স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেন। তখন এ অঞ্চলের চা শ্রমিকেরা তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করেন।
১৯৬৪ সালের ১২ এপ্রিল রেলযোগে বঙ্গবন্ধু কুলাউড়ায় আসেন। কুলাউড়া শহরের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জনসভায় যোগ দেন। জনসভা শেষে শহরের উত্তরবাজারে হাজী আসদ উল্লাহর বাড়িতে অবস্থিত আওয়ামী লীগ অফিস পরিদর্শন করেন। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগ কুলাউড়া উপজেলা শাখার তৎকালীন সভাপতি জয়নাল আবেদীনের বাসায় রাত্রিযাপন করেন।
১৯৬৮ সাল, বিশাল ছাত্র সমাবেশে যোগ দিতে মৌলভীবাজারে আসেন বঙ্গবন্ধু। সেইদিন তিনি মহকুমা শহরের শাহ মোস্তফা সড়কে তৎকালীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (ওয়াপদা) রেস্ট-হাউজে রাত্রিযাপন করেন। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে তোরণ নির্মাণ করেন তখনকার তরুণ-যুবারা।
সত্তরের নির্বাচনী প্রচারণায় মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু
সত্তরের নির্বাচনকে ঘিরে একাধিকবার মৌলভীবাজারে এসেছেন বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সিলেট থেকে বড়লেখা, এরপর কুলাউড়া ও টেংরাবাজার হয়ে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন জনতার নেতা শেখ মুজিব। বড়লেখা রেলওয়ে স্টেশন মাঠের পশ্চিম-উত্তর কর্নারে ডা. শুক্কুর সাহেবের বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। জুড়ীর জাঙ্গীরাই পুরাতন ভাঙ্গা রেলওয়ে ব্রীজ সংলগ্ন স্থানে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রচারণামূলক জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
এরপর কুলাউড়া হয়ে রাজনগরের টেংরাবাজারে জনসভায় যোগ দেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে টেংরাবাজারের ভটেরবাজারে লোকজন জড়ো হয়ে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করেন। সেখানে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিতে প্রচারণামুলক বক্তব্য রাখেন। এরপর মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বিশাল নির্বাচনী জনসভায় যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। একই সময়ে তিনি কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে নির্বাচনী জনসভায়ও যোগ দেন। সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি শ্রীমঙ্গল পৌরসভা শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে প্রচারণায় যোগ দেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে মৌলভীবাজারের প্রতিটি উপজেলা চষে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কথা বলেছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সাথে।
১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে দলীয় কাজে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আসেন বঙ্গবন্ধু। শহরের হবিগঞ্জ রোডস্থ বর্তমান হোটেল প্যারাডাইসের সামনে গাড়ী থেকে নেমে উপস্থিত জনতার সামনে বক্তব্য রাখেন জনতার নেতা। সেখান থেকে মিশন রোডস্থ আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলী সাহেবের বাসায় দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠকে যুক্ত হন। ডা. আলী সাহেবের সহধর্মীনী আখলাতুন্নেছার স্মৃতিতে এখনও সেদিনটি উজ্জ্বলিত।
তখন ফুলছড়া চাবাগানের তৎকালীন ম্যানেজার ও আওয়ামী লীগ নেতা আকবর সাহেবের বাংলোতে যান। সেখানে সময় কাটিয়ে মৌলভীবাজার সার্কিট হাউজে রাত্রিযাপন শেষে পরের দিন সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করেন।
চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেসময় চা-শিল্পের উন্নয়নে ১৯৫৭ সালের ৪ জুন চা-বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। তখন তিনি চা-শ্রমিক, চা-শিল্প ও মালিক-ব্যবস্থাপক ত্রিমুখী উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন যে চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করতেন, তা আজও শ্রীমঙ্গল টি রিসোর্ট মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
চা-শ্রমিকদের আস্থা ও প্রিয়ভাজন বঙ্গবন্ধু
প্রান্তিক জনগোষ্ঠি চা শ্রমিকের আস্থা ও প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন তিনি। চা শিল্পের উন্নয়নে ঘুরেছেন বিভিন্ন বাগানে। শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া, রাজঘাট ও নন্দরাণী চা-বাগানে অবস্থান করেছেন। নন্দরাণী চা-বাগানের ডাক বাংলোতে রাত্রিযাপনও করেছেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন চা-শ্রমিক নেতারা। চা শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে দেখা করতেন বঙ্গবন্ধুর সাথে। তিনিও মৌলভীবাজারে এলে খোঁজ নিতেন চা শ্রমিকদের।
বঙ্গবন্ধু বারবার ছুটে এসেছেন এ মাটির টানে
মৌলভীবাজারের মাটি ও মানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর ছিলো হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। তাইতো বারবার ছুটে এসেছেন এ মাটির টানে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুক্তি পাওয়ার পর এ জনপদে আসেন ইতিহাসের এই মহানায়ক। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেও মৌলভীবাজার আসেন বঙ্গবন্ধু। তখন মৌলভীবাজার ক্লাব প্রাঙ্গণে জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্মের পরেও জাতির পিতা এসেছেন মৌলভীবাজারে। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয় বিশাল গণসংবর্ধনা। মৌলভীবাজারবাসী অধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন প্রিয় নেতার। অতঃপর মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নির্মিত মঞ্চে ওঠেন জনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেইদিন স্বাধীন দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান, গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে মানুষের ঢল নামে বিদ্যালয় মাঠে।
প্রতিটি উপজেলায় খুঁজে পাই বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন
সেই ছোট্ট খোকা থেকে তিনি হয়ে ওঠেছেন গণমানুষের নেতা, একটা দেশের গ্রষ্টা, বাঙালি জাতির পিতা কিংবা বঙ্গবন্ধু। সেই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটি দেশ স্বাধীন করেছিলেন বলে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ একটি দেশের পথে। মৌলভীবাজার একটি অগ্রসর ও উন্নত জেলা। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এ জেলার অপার সৌন্দর্য্য পরতে পরতে বিদ্যমান। পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত এজেলার প্রতিটি উপজেলায় আমরা খুঁজে পাই বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন।
তথ্যসূত্র -বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জেলা প্রশাসন ও আইনিউজ (eyenews.news) নির্মিত ভিডিও ডকুমেন্টারি।
- -বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, গণপরিষদ সদস্য প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাত পাওয়া অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী।
- -সৈয়দ মোশাহিদ আহমদ চুন্নু, প্রত্যক্ষদর্শী।
- -আব্দুল ওয়াহিদ, তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সদস্য।
- -আখলাতুন্নেছা, শ্রীমঙ্গলের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আলী সাহেবের সহধর্মীনির বর্ণনা।
- -রাজেন্দ্র বুনার্জী, চা-শ্রমিক নেতা, শ্রীমঙ্গল। -বাংলাদেশ চা-বোর্ডের ওয়েবসাইট।
- -শ্রীমঙ্গল টি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত তথ্য।
হাসানাত কামাল, জেলা প্রতিনিধি, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও সম্পাদক, আই নিউজ
আইনিউজ/এসকেএস
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখা কবিতা- `বিশ্বমানব হতেই তবে` ।। তাওফিকা মুজাহিদ ।। আবৃত্তি ।। EYE NEWS
নয় বছরের মেয়েটি কিভাবে নেভায় একের পর এক আগুন?
ইসলাম ও কুরআনের আলোকে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ