Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১০ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৭ ১৪৩১

হেলাল আহমেদ

প্রকাশিত: ১৭:১৭, ২৫ অক্টোবর ২০২২
আপডেট: ২০:৪৪, ২৫ অক্টোবর ২০২২

‘খিচুড়িনামা’ | খিচুড়ি | Eye News

বাঙালির তালিকায় খিচুড়ির রয়েছে একাধিক প্রজাতি

বাঙালির তালিকায় খিচুড়ির রয়েছে একাধিক প্রজাতি

সম্রাট জাহাঙ্গীর থেকে শুরু করে সম্রাট আওরঙ্গজেব, চাণক্য থেকে মেগাস্থিনিসের ঐতিহাসিক লেখাতেও পাওয়া যায় বাঙালীর খিচুড়ি প্রীতির কথা। জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভায়ও রান্না হতো খিচুড়ি। এই খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে ইংরেজরা ধারণা নিয়ে তৈরি করলো তাদের পছন্দের ব্রেকফাস্ট ‘কেদেগিরি'। সুতরাং, বাঙালীর এ খিচুড়ি এতোটাও ফেলনা নয়। আজকে এই বৃষ্টির দিনে আইনিউজের পাঠকদের জানাবো খিচুড়ির সব অজানা কথা....

বৃষ্টির দিনে খিচুড়ির প্রসঙ্গটি না আসলে বৃষ্টি-বাদল ব্যাপারটাই যেন অনেকের কাছে জমে না। বৃষ্টির দিন মানেই কারো কারো ক্ষেত্রে পাতে চাই ঝুরঝুরে কিংবা ভোগের পাতলা খিচুড়ি। মেঘলা দিনে খিচুড়ি খাওয়ার প্রবণতা বাঙালী ভোজন রসিকদের মাঝে ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তা অনিশ্চিত। চালের সাথে ডাল মিশিয়ে তৈরি এই সরল রেসিপিটি অনেক আদিকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের ব্যঞ্জন তালিকায় দেখা যায়। এর প্রমাণও বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলপত্রে পাওয়া যায়।

বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি তৈরির কায়দা কানুন নিয়ে না ঘেঁটে চলুন বৃষ্টির দিনে জানা যাক খিচুড়ি ইতিহাস; অথবা বলা যায় বৃষ্টির দিনে খিচুড়ির গল্প। বর্ষা, বাঙালি এবং খিচুড়ির মধ্যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে যদি ভুনা মাংস কিংবা ইলিশ ভাজা হয় তবে তা ভোজনরসিক বাঙালির কাছে নির্ঘাত অমৃত সমান। বাঙালির ঘরে খিচুড়ি নিয়ে নিরীক্ষাও হয় প্রচুর। কখনও মাংস দিয়ে, কখনও মাছ দিয়ে বা কখনও সবজি সহযোগে। বাঙালির তালিকায় খিচুড়ির রয়েছে একাধিক প্রজাতিও! মুগ ডালের খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি, মুসুর ডালের খিচুড়ি, গমের খিচুড়ি, সাবুর খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, ডিমের খিচুড়ি, মাছের খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি কি নেই সে তালিকায়?

ভারতবর্ষে খিচুড়ির রাজকীয় ইতিহাস
খিচুড়ি চাল-ডালের মিশ্রণে তৈরি অতি সাধারণ একটি খাবার হলেও এর জনপ্রিয়তা ছিলো রাজমহলেও। এ শুধু কথার কথা নয়, ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় কতো রাজা-জমিদারদের খিচুড়িপ্রীতির কথা। চাণক্যের লেখায় মৌর্যযুগের চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে চাল, ডালের মিশ্রণে তৈরি খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়।

গ্রিক পরিব্রাজক মেগাস্থিনিসের লেখাতেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের রাজসভার রান্নাঘরে খিচুড়ির কথা পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকে ফরাসি পরিব্রাজক তাভেরনিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারত-বাংলার প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের ‘লাজিজান’, আওরঙ্গজেবের প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’
শুধু তাই নয়, সম্রাট আকবরের শাসনামলে তো খিচুড়ি প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কিত বৃহদ বইও পাওয়া গেছে। সেখানে আকবর এবং বীরবলের খিচুরি রান্নার একটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে।

খিচুড়ি খেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশদের বানানো নাস্তা কেদেগিরি

মুঘল রান্নাঘরে জাহাঙ্গীরের প্রিয় বিশেষ ধরনের খিচুড়ি তৈরি করা হতো পেস্তা, কিসমিস দিয়ে। সেই খিচুড়িকে জাহাঙ্গীর নাম দিয়েছিলেন ‘লাজিজান’। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রিয় ‘আলমগিরি খিচড়ি’র কথাও জানা যায়। এই খিচড়িতে চাল, ডালের সঙ্গে মেশানো হত বিভিন্ন প্রকার মাছ ও ডিম।

রাজকীয় খাবার হিসেবে হায়দরাবাদের নিজামের রান্নাঘরেও খিচুড়ি জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই খিচুড়ির ভাঁজে ভাজে থাকতো সুস্বাদু মাংসের কিমা। ১৯ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে দেশে ফেরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দেই বর্তমানে ইংলিশদের প্রিয় ব্রেকফাস্ট ‘কেদেগিরি' কিন্তু খিচুড়িরই আধুনিক সংস্করণ। অর্থাৎ, খিচুড়ির প্রেমে মজেই ইংরেজরা খিচুড়ির আদলে তাদের এ নাস্তার রেসিপিটি বানায়।

বাংলা সাহিত্য তথ্য উপমহাদেশীয় সাহিত্যে খিচুড়ি’র স্থান
খিচুড়ি যে শুধু বৃষ্টি-বাদল, রাজাবাদশার মহল আর বিলেত-মিশরেই বিখ্যাত হয়েছে তা নয়। এই খিচুড়ি ঠাই করে নিতে পেরেছে বাংলা সাহিত্য তথা এই উপমহাদেশীয় সাহিত্যের পাতায়। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলে দেখা যায় শিব পার্বতীকে ডাবের পানি দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ দিচ্ছেন। হয়তো শিব ঠাকুরও খিচুড়ি পর্যন্ত করতেন! অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’। 

তবে খিচুড়ি এই ভারতীয় সমাজে কবে থেকে চালু হয়েছে তা নিয়ে কিছু ঐতিহাসিক মতানৈক্য আছে। অনেক ঐতিহাসিক পর্যটকদের আদি লেখায় ভারত-বাংলায় খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া গেলেও এ অঞ্চলের ইতিহাসবিদরা বলছেন ভারতীয়দের খাদ্য তালিকায় ডাল এসেছে খুব বেশিদিন হয়নি।

‘জগাখিচুড়ি’ কী?
‘জগাখিচুড়ি’ নিয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে জগাখিচুড়ী মানুষ যতো না খায় তারচেয়ে বেশি কথায় ব্যবহার করে। তাতে কি বাস্তবেও জগাখিচুড়ি বলে এক রকমের খিচুড়ি আছে। শোনা যায়, ভারতের পুরীতে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের নিত্যদিন খিচুড়ি বিতরণ করা হয়।

ওই মন্দিরের ‘জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি’ লোকমুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি’। আর বাঙালীর কথ্যরীতিতে তা তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

খিচুড়ির নামকরণ কীভাবে, কারা করেছে?
ইতিহাসবিদদের ধারণা বাংলা খিচুড়ি শব্দটি সংস্কৃত খিচ্চা থেকে এসেছে। অঞ্চলভেদে শব্দটির তৃতীয় ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ ও ব্যবহারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি পরিমন্ডলে খিচুড়ি উচ্চারণ করা হলেও কোথাও কোথাও খিচুরি বলতে শোনা যায়।

হিন্দীভাষীরা ড় এবং উর্দুভাষীরা র ব্যবহার করে থাকেন খিচুড়ি উচ্চারণে।

খিচুড়ির উপকরণ
চাল, মুগডাল আধা কাপ, ডালিয়া (আধভাঙা গম) ১ কাপ, আদাকুচি ১ চা-চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ টেবিল চামচ, জিরা আধা চা-চামচ, কাছুরি মেথি আধা চা-চামচ, ঘি ২ টেবিল চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা- চামচ, কাঁচা মরিচ ২-৩টি, আলু-ফুলকপি-গাজর-মটরশুঁটি-টমেটো ছোট করে কাটা ১ কাপ (মৌসুম অনুযায়ী সবজি দেওয়া যায়) ও লবণ পরিমাণমতো।

ব্যবহার করতে পারেন খিচুড়ি মাসালা
সহজ উপায় সুস্বাদু খিচুড়ি রান্না করতে, রাধুনি খিচুড়ি মিশ্রণ একটি সহজ উপায়। এই মিশ্রনটিতে খিচুড়ির সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান  রয়েছে এমনকি কাটারিভোগ চাল, ডাল এবং লবণ সহ। সুতরাং, এটি আপনাকে খিচুড়ির স্বাদ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিবে।

চাল ধুয়ে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। পানি ঝরিয়ে সবগুলো উপকরণ ভালো করে হাত দিয়ে মাখিয়ে ৪ কাজ পানিসহ চুলায় দিন। কিছুক্ষণ পরপর নেড়ে দিতে হবে। পানি শুকিয়ে, চাল ফুটে আসলে নামিয়ে পরিবেশন করুন মজাদার খিচুড়ি। সঙ্গে রাখতে পারেন পটল বা বেগুন ভাজি আর ভর্তা। মাংস রাখলে তো আর কথাই নেই।

খিচুড়িতে ক্যালরি প্রায় ১৭৭!
এক থালা খিচুড়িতে প্রায় ১৭৭ ক্যালরি শক্তি, ৩২.৩ গ্রাম শর্করা, ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৫ গ্রাম চর্বি থাকে।

এছাড়াও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন এবং ফাইবার বা আঁশ রয়েছে।যেহেতু একেক ধরনের খিচুড়ি তৈরিতে একেক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয় তাই ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের উপকারী ভূমিকা পালন করে। ওটস খিচুড়িতে উপস্থিত ফাইবার, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট দেহে উপস্থিত টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়।

সবজি খিচুড়িতে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং বেশ কিছু খনিজ থাজে যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। মুগ ডালের খিচুড়ি দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখায় ওজন কমাতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। কাওনের খিচুড়ি প্লোটিন, ফাইবার, ফসফরাস এবং অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিপূর্ণ। সাবুদানা খিচুড়িতে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়ামসহ একাধিক খনিজ রয়েছে।

তাছাড়া বেশ সহজপাচ্য এবং শক্তিদায়ক বলে অসুস্থ এবং দুর্বল মানুষকে খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়। বাচ্চাদের পেটে সহজে শক্ত খাবার হজম হয় না বলে তাদেরকে খুব নরম খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়।

আইনিউজ/এইচএ

আইনিউজে আরও পড়ুন-

বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি

দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS

হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS

আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়