সাগর জাহান
আপডেট: ১২:৫১, ১২ ডিসেম্বর ২০২২
মরক্কো : কীভাবে ইসলামের পতাকা তলে এলো দেশটি?
মরক্কোতে ইসলাম ধর্ম যেভাবে এলো
মরক্কো, কাতার বিশ্বকাপে প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে পর্তুগালকে হারিয়ে বর্তমানে ফ্রান্সের সাথে সেমিফাইনাল খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দলটি। মরক্কোকে নিয়ে নতুন করে ইতিহাস লিখতে শুরু করেছেন লেখকরা। নতুন করে আবারও যেন সবার মাঝে নতুন এক আকর্ষণ নিয়ে হাজির হয়েছে আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্র মরক্কো। কিন্তু কীভাবে মরক্কোতে পৌঁছালো ইসলামের বাণী? কার হাত ধরে ইসলামের ছায়াতলে এসে দলে দলে ভিড়েছিলেন আদি মরক্কোর বারবার জাতির মানুষজন?
সূর্যাস্তের দেশ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ মরক্কো। একদিকে সুবিশাল আটলান্টিক সাগর আর অন্যদিকে এটলাস পর্বতমালা নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই ঠাই করে নিয়েছে এই মরক্কো। তবে মরক্কোতে শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন না বা ইসলামের কোনো প্রভাব ছিলো না। তাতে কী? আদিকাল থেকেই মরক্কো পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। যা পাঠ করা যেকোন ইতিহাসের ছাত্রের অবশ্য করনীয়।
গবেষকরা বলেন, পৃথিবীর প্রথম হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষরা এই মরক্কো অঞ্চল থেকেই যাত্রা শুরু করেন। এর প্রমাণস্বরূপ মরক্কোতে বেশ কিছু প্রাগৈতিহাসিক কিছু ফসিল পাওয়া গেছে দেশটিতে। সে যাইহোক ফিরে আসি মরক্কোর ধর্মের ইতিহাসে। কীভাবে দেশটি মুসলিম অধ্যুষিত হলো তা জানতে পুরো লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়ুন।
মরক্কোতে গ্রীক ধর্মের প্রভাব
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ মিনারের মসজিদটি মরক্কোতে অবস্থান করলেও দেশটির আদি ইতিহাসে দেখা যায় এখানে একসময় গ্রীক ধর্মের বেশ প্রভাব ছিলো। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মরক্কোর আটলান্টিক সাগর এবং এটলাস পর্বতমালার নামাকরণের ক্ষেত্রে।
এটলাস ছিলেন গ্রীক পুরাণে বর্ণিত এক টাইটানের সন্তান। কিন্তু এটলাসকে নিয়ে টাইটানদের বেশ ভোগান্টি পোহাতে হচ্ছিলো বলে এটলাসের বাবা তাকে একটি শাস্তি দেন। শাস্তিস্বরূপ এটলাস মরক্কো ভূমিকে নিজের কাঁধে বহন রাখবেন। এই এটলাসের নামানুসারে পরে মরক্কোর সুবিশাল নীল জলরাশির নাম দেয়া হয় আটলান্টিক মহাসাগর।
মরক্কো ভূমিতে শুরুর দিকে গ্রীক ধর্মের প্রভাব বেশ প্রকট ছিল
এবং পর্বতমালার নাম রাখা হয় এটলাস। এসব থেকে প্রমাণিত হয় মরক্কো ভূমিতে শুরুর দিকে গ্রীক ধর্মের প্রভাব বেশ প্রকট ছিল। এমনকি এখনো মরক্কোতে এটলাস যে গুহা দিয়ে স্বর্গের আপেল সংগ্রহ করেছিলেন সেই গুহাটিকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। পর্যটকের আকর্ষণের জায়গা এটি।
মরোক্কো, দেশটি আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী একটি দেশ যার উত্তরে ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর সংযোগকারী জিব্রাল্টার প্রণালী অবস্থিত। এর উত্তরে স্পেনের জলসীমা, পূর্বে আলজেরিয়া এবং দক্ষিণে পশ্চিম সাহারা অবস্থিত। পশ্চিম সাহারা মরোক্কো ও মৌরিতানিয়ার একটি অমিমাংসিত সিমান্ত অঞ্চল যার পুরোটাই মরোক্কোর দখলে।
মরক্কোর বারবার জাতির ইসলাম গ্রহণ
কিছু জায়গায় পাওয়া তথ্য বলছে মরক্কোতে ইসলাম ধর্মের শুরু হয় মুসা বিন নুসায়েরের হাত ধরে। মাওলানা তারিক জামিলের লেখা স্পেনের কান্না বইটিতে বার্বার জাতি'র পরিচয়-গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের দাওয়াত পৌছার পর বার্বাররা ইসলাম গ্রহণ করে। তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে তারা স্পেন বিজয়ে অংশ নেয়। তাদের অনেকেই উকবা বিন নাফে ও মুসা বিন নুসায়রের হাতে ইসলাম গ্রহণ করে।
বার্বারদের পরবর্তী ইতিহাস আগলাবি, ফাতেমি, ইদরিসি, মুরাবিতুন, মুওয়াহহিদূন প্রভৃতি গােত্রের ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। বার্বারগণ মূলত উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী। এরা উপজাতি আদিবাসী।’
মাগরেব বিজয় ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি উমাইয়া খিলাফতের সময় সংঘটিত হয়েছিল। এই বিজয় মাগরেবে ইসলাম ও আরবি ভাষা উভয়ই নিয়ে আসে। তবে বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে মরক্কো প্রাথমিকভাবে ইফ্রিকিয়া প্রদেশ হিসাবে সংগঠিত হয় এবং সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে নির্ধারিত গভর্নর কর্তৃক শাসিত হয়। ইসলাম আগমনের ফলে আদিবাসী বার্বার উপজাতিরা ইসলাম গ্রহণ করে।
আধুনিক মরক্কো অঞ্চলে প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল নেকোর রাজ্য
মরোক্কান উপজাতিরা মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার পর, মুসলিম প্রশাসনকে ইসলামি আর্থিক কর বা যাকাত ও শ্রদ্ধা প্রদান করত। আধুনিক মরক্কো অঞ্চলে প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল নেকোর রাজ্য। রাজ্যটি রিফ পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত একটি আমিরাত। ৭৩৯ সালে বার্বার বিদ্রোহের প্রাদুর্ভাবের পর বার্বাররা আরো কয়েকটি স্বাধীন রাজ্য গঠন করে। ৯ম শতাব্দীতে ফেস নগরে প্রতিষ্ঠিত আল-কারাউইয়ীন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি তৎকালীন একটি প্রধান আধ্যাত্মিক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র ছিল।
মরোক্কোতে ইদ্রিসি রাজবংশ
মধ্যযুগীয় ইতিহাস মতে, আব্বাসীয় বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ইরাকে নিজ গোত্রের ওপর গণগত্যা থেকে পালিয়ে ইদ্রিস ইবনে আবদুল্লাহ মরক্কোতে পালিয়ে যান। তিনি আওরাবা বার্বার উপজাতিদের দূরবর্তী বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের প্রতি আনুগত্য ভঙ্গ করতে রাজি করান এবং ৭৮৮ সালে ইদ্রিসি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। ইদ্রিসিরা ফেসকে তাদের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং মরক্কোকে মুসলিম শিক্ষার কেন্দ্র ও একটি প্রধান আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়।
এরপর ৯২৭ সালে ফাতেমীয় খিলাফত তাদের মিকনাসা মিত্রদের মাধ্যমে ইদ্রিসিদের ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু মিকনাসারূ ৯৩২ সালে ফাতেমিদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ৯৮০ সালে তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়।
বার্বার রাজবংশগুলোর উদ্ভব
১১ শতকের পর থেকে স্থানীয় বার্বার রাজবংশগুলোর উদ্ভব শুরু হয়। তখন মুরাবিতুন রাজবংশ ও মুওয়াহহিদিন রাজবংশ মরক্কো, মাগরিব, ইবেরীয় উপদ্বীপের আল-আন্দালুস ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে। ১৩ শতকের পর থেকে দেশটিতে বনু হিলাল আরব উপজাতিরা ব্যাপক অভিবাসন গ্রহণ করে। মুরাবিতুন রাজবংশ ১০৪০ থেকে ১১৪৭ সাল পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। এরপর মুওয়াহহিদিনরা ১১২১ থেকে ১২৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন পরিচালনা করে।
মুওয়াহহিদিনদের পতনের পর মারিনি, হাফসিসহ বিভিন্ন রাজবংশ মরক্কো তথা মাগরেবের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ১৫৪৯ সাল থেকে ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত সাদী রাজবংশ দেশটি শাসন করে। ১৬৬৭ সাল থেকে সামনের বছরগুলোতে আলবীয়রা মরক্কোর শাসক রাজবংশের অধিপতি ছিল।
বার্বার রাজবংশের কিছু লোক
১৫ শতকে আটলান্টিক সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজরা মরোক্কোর কিছু উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে নিলেও তা দেশের অভ্যন্তরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেনি।
১৫৪৯ সাল এই অঞ্চলটি পুনরায় আরব রাজবংশের হাতে চলে যায়। তারা নিজেদের নবিজি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলে দাবি করে। প্রথম সাদি রাজবংশ ১৫৪৯ থেকে ১৬৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন করে এবং তাদের আলবীয় রাজবংশ ১৭ শতক থেকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তখন মরক্কো স্পেনীয় আগ্রাসনের মুখোমুখি হয় এবং উসমানীয় সাম্রাজের মিত্ররা তাদের পশ্চিম দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মরোক্কো : ১৫৭৮ সালে কুইবিরের যুদ্ধ
সাদি রাজবংশের অধীনে ১৫৭৮ সালে দেশটি আল কাসার ১৫৭৮ সালে কুইবিরের যুদ্ধে পর্তুগিজ আভিজ রাজবংশের অবসান ঘটায়। বিখ্যাত সাদি সুলতান আহমাদ আল-মনসুরের রাজত্বে সালতানাত প্রচুর নতুন সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে এবং ১৫৯১ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় একটি বড় অভিযান চালিয়ে সোংঘে রাজ্যে একটি বিপর্যয় ঘটায়। আহমদ মনসুরের ওফাতের পর দেশটি তার পুত্রদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
সাদি রাজবংশের পতনের সময় বহু রাজনৈতিক বিভক্তি ছিল। নানা রকম সংঘাতের পর শেষ পর্যন্ত ১৬৬০ এর দশকের শেষের দিকে আলবীয় সুলতান আল-রশিদ গোটা মরক্কোকে পুনরায় একত্র করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ফেজ এবং ১৬৬৮ সালে মারাকেশ অধিগ্রহণ করেন। এরপর আলবীয়রা তাদের অবস্থান স্থিতিশীল করতে সফল হয়। রাজ্যটি এই অঞ্চলে পূর্ববর্তীদের তুলনায় ছোট হলেও তা বেশ ধনী ছিল।
আলবীয় শাসক ইসমাইল ইবনে শরীফ
স্থানীয় উপজাতিদের বিরোধিতার দমন করে আলবীয় শাসক ইসমাইল ইবনে শরীফ একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র তৈরি করতে শুরু করেন। তার রিফিয়ান আর্মি ইংরেজদের থেকে ১৬৮৪ সালে টাঙ্গিয়া পুনরায় দখল করে নেয়। ১৬৮৯ সালে ইংরেজরা স্প্যানিশদের তাড়িয়ে দিয়ে এটি দখল করেছিল। ১৭৬৯ সালে পর্তুগিজরা মরক্কোতে তাদের শেষ অঞ্চলটি পরিত্যাগ করে চলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় মরক্কো
মরক্কো ছিল প্রথম দেশ, যারা ১৭৭৭ সালে স্বাধীন হওয়া নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমেরিকান বিপ্লবের শুরুতে আটলান্টিক মহাসাগরে মার্কিন ব্যবসায়িক জাহাজগুলি বার্বার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়।
১৭৭৭ সালের ২০ ডিসেম্বর মরক্কোর সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ ঘোষণা করেন যে, মার্কিন বণিক জাহাজগুলি সালতানাতের সুরক্ষার অধীনে থাকবে এবং এইভাবে তারা নিরাপদ পথ উপভোগ করতে পারবে। মরোক্কা-মার্কিন বন্ধুত্বের চুক্তি ১৭৮৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম নির্বিচ্ছিন্ন বন্ধুত্ব চুক্তি হিসাবে দাঁড়ায়।
আইনিউজ/এইচএ
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
৭১ বছরের এক তরুণ, যার কাছে দৌড়ে যুবকেরাও হার মানে
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ