হেলাল আহমেদ
আপডেট: ১৩:১৩, ৫ জানুয়ারি ২০২৩
বিশ্বের শীতলতম স্থান অয়মিয়াকন | Eye News
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এখন শীতকাল। পৌষ মাসের শেষ ভাগ থাকায় বর্তমানে তীব্র শীতে বিপর্যস্ত দেশের অনেক জায়গার জনজীবন। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে যতোই শীত বা ঠাণ্ডা থাকুক না কেন রাশিয়ার অয়মিয়াকনের ঠাণ্ডার সাথে তার তুলনা করা যাবে না। রাশিয়ার এই অঞ্চলটিতে এতো পরিমাণ ঠাণ্ডা পড়ে যে এখানে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসও বাইরে এসে বরফে পরিণত হয়! শুনতে অবাক লাগলেও এটি সত্যি। অবাক করা শীতের এই অঞ্চলকে নিয়ে জানতে আই নিউজের প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
অয়মিয়াকন রাশিয়ার ইয়াকুতিয়া অঞ্চলের একটি শীতপ্রধান জেলা। যেখানে পৃথিবীর সবথেকে কম তাপমাত্রা বিরাজ করে প্রায় সময়ই। যেকারণে, এই জেলাটিকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান বা ঠাণ্ডা এলাকা। এখানকার ঠাণ্ডার সাথে বহির্বিশ্বের অন্য কোনো জনপদের ঠাণ্ডার তুলনা করাই বৃথা। কেন একটু পড়েই সেটা বুঝতে পারবেন। তার আগে বলা দরকার এই জেলার নাম কীভাবে অয়মিয়াকন হলো।
অয়মিয়াকনের নামকরণ
মূলত অয়মিয়াকন নদীর নামানুসারে শীত প্রধান এ জেলার নাম হয়েছে অয়মিয়াকন। বলা হয়ে থাকে, এই নদীটির নাম এসেছে এভেন শব্দ খেইউম থেকে। যার অর্থ অহিমায়িত পানির চাক; যে জায়গায় মাছেরা শীতকালীন সময় কাটায়। নামের সাথে এখানকার আবহাওয়া পরিস্থিতির বেশ যোগসাজেশ রয়েছে বিধায় এই নাম রাখা হয়ে থাকতে পারে।
ম্যাপের লাল অংশটি অয়মিয়াকন। ছবি- সংগৃহীত
তবে এ নদীর নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। কেউ কেউ এর নামকরণের গল্প হিসেবে বলেন ইভেন শব্দ হিউয়াম (hэjум) (খিয়াম ভুল বানান হতে পারে) থেকে এসে থাকতে পারে। এর অর্থ "হিমশীতল হ্রদ"। তবে যে নামটিই সঠিক হোক না কেন এখানকার শীতকে ঘিরেই যে এ জেলার নামকরণ হয়েছে তা এর নাম থেকেই বুঝা যায়।
অয়মিয়াকনের ভূগৌলিক গঠন
অয়মিয়াকন রাশিয়ার সাইবেরিয়ান একটি অঞ্চল। সাইবেরিয়ার নাম যারা শুনেছেন তারা সবাই জানেন সাইবেরিয়াও একটি শীতপ্রধান এলাকা। সেখানেও অনেক শীত পড়ে। কিন্তু অয়মিয়াকনের ঠাণ্ডার মতো নয়।
অয়মিয়াকন অঞ্চলটি কেন এতো ঠাণ্ডা থাকে এর উত্তর কিছুটা পাওয়া যাবে এর ভূগৌলিক গঠন পাঠ করলে। কেননা, এই অঞ্চলটির ভূগৌলিক গঠনই এমন যা এই এলাকাকে শীতল থাকতে বাধ্য করে।
ম্যাপে অয়মিয়াকনের মানচিত্রে দেখা যায় এর পাশে দুটি প্রধান উপত্যকা রয়েছে। এই উপত্যকাগুলো শহরের ভিতরে বাতাসকে আটকে রাখে এবং শীতল জলবায়ু তৈরি করে। ফলে এখানকার তাপমাত্রা সারা বছরই অত্যন্ত শীতল থাকে এবং ঘন ঘন তুষারপাত হয়।
অয়মিয়াকনে প্রথম মানব বসতি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সাইবেরিয়ান এই অঞ্চলটিতে যতোই তুষারপাত কিংবা শীত পড়ুক না কেন জীবনের প্রয়োজনে এই বিরূপ আবহাওয়ায়ও মানুষ বেচে থাকার অভ্যাস করে নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই অয়মিয়াকনে মানুষের বসবাস চলে আসছে। তীব্র শীতের সাথে মোকাবিলা করে তারাও যাপিত জীবন কাটাচ্ছে।
অয়মিয়াকনের প্রথম সন্ধানকারীদের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর সেমিয়ন দেজনেভ ও মিখাইল স্ট্রাডহিন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্যাভ্রিল সারিচেভ অন্যতম। তাদের মাধ্যমেই এই বিরূপ অঞ্চলটিতে প্রথম মানববসতি গড়ে ওঠে বলে জানা যায়।
বছরের প্রায় ৮ মাসই তীব্র শীতে ঢেকে থাকে অয়মিয়াকন
তাছাড়া, এস্তোনীয় পরিব্রাজক মাত্তে মাতভেভিচ গেডেনস্ট্রোম (১৭৮০–১৮৪৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে তাঁর নভোসিবিরস্ক দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণপথে অয়মিয়াকনে বসতির কথা উল্লেখ করেন।
১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে অয়মিয়াকন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। যেখানে রাখাল ও ইরভিস শিকারিরা আশ্রয়গ্রহণ করতো। যাযাবরদের সাধারণ জীবনযাপন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিবেশ দেয়ার জন্য সোভিয়েত সরকার একটি স্থায়ী বন্দোবস্ত তৈরি করে দেয় এখানে।
অয়মিয়াকনে মানুষের হাড়ের রাস্তা!
মানুষের হাড়ের রাস্তা শুনে অবাক হয়ে থাকলেও এই রাস্তা নির্মাণের পেছনে মূলত রয়েছে রাশিয়ানদের এক নির্মম ইতিহাসের গল্প। ১৯৪০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে জোসেফ স্টালিনের শাসনের সময় লক্ষ লক্ষ লোককে বন্দী করে পাঠানো হয়েছিল শ্রম শিবিরে।
মানুষের হাড়ের রাস্তা বা road of bones। ছবি- সংগৃহীত
সেখানে তাদেরকে মানবেতর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। এগুলোকে বলা হতো গুলাগ। এখানে মৃত্যু হয়েছিল দশ লাখেরও বেশি বন্দীর - যার কারণ ছিল অনাহার, রোগ এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি। অয়মিয়াকনে জনশ্রুত আছে এসব মৃত শ্রমিকদের এই রাস্তায়ই সমাহিত করা হয়েছিলো। আর একারণে এই রাস্তার নামটিও জনমুখে হয়ে গেছে হাড়ের রাস্তা বা road of bones।
অয়মিয়াকন আসলে কতোটা শীতল?
অয়মিয়াকন আসলে কতোটা শীতল তা এখন ইউটিউবে হরহামেশাই ডকুমেন্টারি ফিল্মগুলোতে দেখা যায়। এমনও অনেক ভিডিও আছে অয়মিয়াকমের যেখানে ঠাণ্ডার তীব্রতা এতোটা যে, কেটলি থেকে ছুড়ে ফেলা গরম পানি শূন্যে থেকে মাটিতে পড়তে পড়তেই বরফে পরিণত হয়ে যায়!
এ অঞ্চলটিতে কোনো বছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাপমাত্রা ০ °সে (৩২ °ফা) এর নিচে নেমে যায় এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিমাঙ্কের নিচে থাকে। অমিয়াকনে কখনও কখনও জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারি এবং ডিসেম্বরের গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা −৫০ °সে (−৫৮ °ফা) এর নিচে থাকে।
কখনও কখনও গ্রীষ্মের মাসগুলোও বেশ ঠান্ডা হতে পারে তবে জুন এবং জুলাই এমন একমাত্র মাস যেখানে তাপমাত্রা কখনও −১০ °সে (১৪ °ফা) নিচে যায় নি। −৬০.০ °সে (−৭৬ °ফা) অয়মিয়াকন এবং ভার পৃথিবীর একমাত্র স্থায়ীভাবে −৬০.০ °সে (−৭৬ °ফা) দুটি স্থান যা জানুয়ারীর প্রতিদিনের তাপমাত্রা −৬০.০ °সে (−৭৬ °ফা) এর নিচে থাকে।
তাছাড়া, অয়মিয়াকনে ২৫ অক্টোবর থেকে ১৭ ই মার্চ এর মধ্যে কখনই হিমাংকের উপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা যায়নি।
অয়মিয়াকনের খাদ্যাভ্যাস
প্রাকৃতিক বিরূপতার প্রভাব আছে অয়মিয়াকনের বসবাসকারীদের খাদ্যাভাসেও। সাধারণত ৮ মাসই এখানে তীব্র শীত থাকায় গাছ-গাছালি রোপণ বা কোনোকিছু চাষ করা এখানে সম্ভব হয়না। তাই এখানকার মানুষদেরকে মূলত মাংস খেয়েই জীবন ধারণ করতে হয়।
কিছু স্থানীয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে স্ট্রোগেনিনা, যা কাঁচা দীর্ঘ-কাটা হিমায়িত মাছ, বল্গা হরিণের মাংস, ঘোড়ার হিমায়িত কাঁচা কলিজা এবং ম্যাকারণির সঙ্গে ঘোড়ার রক্তের হিমায়িত টুকরা তারা খেয়ে থাকেন।
এভাবেই বরফের নিচ থেকে মাছ শিকার করে খেতে হয় অয়মিয়াকনে বসবাসকারীদের। ছবি- সংগৃহীত
মাছ হিসেবে তারা স্যামন, হোয়াইট ফিশ খায়। মাছ-মাংস সংরক্ষণের জন্য তারা কোনো রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করে না, বরং পানি থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ হিমায়িত হয়ে যায়।
মজার বিষয় হলো আমাদের যেমন জাতীয় এবং ঐতিহ্যবাহী পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার তেমনি অয়মিয়াকনের ঐতিহ্যবাহী পশু হলো ঘোড়া। এটি ইয়াকুতি ঘোড়া হিসেবে পরিচিত। ইয়াকুতি ঘোড়ার চাহিদাও ব্যাপক। এই অঞ্চলের ঘোড়া সাধারণত প্রতিকূল অবস্থায়ও টিকে থাকার জন্য বেশ জনপ্রিয়।
কীভাবে পড়াশোনা করে অয়মিয়াকনের বাচ্চারা?
এখন স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন আসতেই পারে এতো শীতল যে এলাকা, যেখানে গরম পানি ছুড়ে মারলে মাটিতে পড়ার আগে বরফ হয়ে সেখানকার ছেলেমেয়েরা পড়শোনা করে কীভাবে? বা আদৌ তারা পড়াশোনা করে কিনা?
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়লেও অয়মিয়াকনের ছেলে-মেয়েরাও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ন্যায় স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে। তবে তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। সাধারণত এ অঞ্চলের তাপমাত্রা যখন −৫৫.০°সেলসিয়াস থেকে −৬৭.০°ফারেনহাইট থেকে −৫৫.০°সেলসিয়াস −৬৭.০° ফারেনহাইট হয় তবেই কেবল বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তানাহলে বাচ্চাদেরকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না।
তবে প্রাকৃতিকভাবে বিরূপ এই ভূমিতে গত কয়েক দশক ধরে কমে আসছে মানুষের বসবাসের সংক্যা। অয়মিয়াকন অঞ্চলটি যখন একটি কেন্দ্রীয় শহর ছিল তখন এর সর্বোচ্চ জনসংখ্যা প্রায় ২,৫০০ জন ছিল। তবে এই সংখ্যাটি ২০১৮ সালে ৯০-এর চেয়ে নিচে চলে গেছে।
আইনিউজ/এইচএ
নীলাদ্রি লেক আমাদের এক টুকরো কাশ্মীর | পাখির চোখে নীলাদ্রি
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ