শ্যামলাল গোঁসাই
আপডেট: ১৭:৪১, ২২ জানুয়ারি ২০২৩
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন?
আলবার্ট আইনস্টাইনের বহুল দামে বিক্রি হওয়া এক ঐতিহাসিক চিঠি থেকে জানা যায়, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও আইনস্টাইন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কোন বিশ্বাসের কথা কখনোই লিখে যাননি। বরং আইনস্টাইন নিজের ‘ঈশ্বর বিশ্বাস’ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এক ধরনের বিভ্রান্তিতে ভোগছিলেন বলা যায়। আইনস্টাইনের বিভিন্ন সময়ে লেখা বিচ্ছিন্ন সেসব ধর্ম এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত লেখা পড়ে ঈশ্বরে ‘বিশ্বাসী’রা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠতেন। কিন্তু মৃত্যুর এক বছর আগে বন্ধুকে হাতে লেখা চিঠি পরে তাদের অনেকেই হতাশ হয়েছেন।
আলবার্ট আইনস্টাইন বিজ্ঞানের জগতে নিঃসন্দেহে মহা বিজ্ঞানী। নিজের মেধা দিয়ে গোটা বিজ্ঞান জগতকে আলোড়িত করেছেন এই বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের আরেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ধর্ম। বলা হয় অনেক বিজ্ঞানীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। মহা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে ঘিরেও এই প্রশ্ন করেন অনেকেই। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন কি ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন?
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের ঈশ্বরে ভক্তির বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোললে আরেকটি বিষয় সামনে আসে। সেটি হলো কেউ কেউ দাবি করে আলবার্ট আইনস্টাইন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কোনো ব্যক্তি ঈশ্বরে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এক্ষেত্রে আইনস্টাইনকে কেউ কেউ সর্বেশ্বরবাদীর দলভুক্ত বলেও দাবি করেন।
অবশ্য মানুষের বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে ঘিরে এমন দাবিদাওয়ার পেছনে কিছুটা দায় আছে এই মহা বিজ্ঞানীর নিজেরও। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, অবস্থার পরিবর্তনজনিত কারণে মানুষের চিন্তা ভাবনায়ও পরিবর্তন আসে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও হয়েছে তেমনি। তিনি কখনো এমন কিছু জিনিস খাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন জা দেখে মনে হয়েছে আইনস্টাইন সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এবং তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন।
তার তেমনি একটি লেখার ব্যাপারে বলছি। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, তিনি বারুচ স্পিনোজার সর্বৈশ্বরবাদী ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। তিনি কখনোই এমন একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না যিনি নিজেকে মানুষের ভাগ্য ও কর্ম নিয়ে চিন্তা করেন, এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি যাকে তিনি নির্বোধ বলে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি একজন নাস্তিকও নন। বরং আইনস্টাইন নিজেকে একজন অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে ভাবতেই বোধয় বেশি পছন্দ করতেন।
আবার অন্য একটি লেখায় আলবার্ট আইনস্টাইন লিখেছেন তিনি আখিরাতের জীবন বা পরকালে বিশ্বাস করেন না।
বরং আইনস্টাইন লিখেছিলেন- আমার জন্য একটি জীবনই যথেষ্ট।
এবারে একটা ঘটনার ব্যাপারে বলা যাক। ১৯৫৪ সালে মৃত্যুর বছরখানেক আগে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের লেখা একটি চিঠি নিলামে! নিউইয়র্কে সেই চিঠিটি ২৯ লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। চিঠি কতো দামে বিক্রি হয়েছিল তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। বরং চিঠির লেখার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। কারণ, নিজের এক কাছের বন্ধুকে লেখা এই চিঠিতে আইনস্টাইন নিজের ধর্ম এবং ঈশ্বর ভাবনা নিয়ে অনেককিছু লিখেছিলেন। আর একারণেই নিলামে বিক্রি হওয়া এই চিঠিটি পরবর্তীতে বেশ আলোচনায়ও আসে।
সেই চিঠি থেকে জানা যায়, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেও আইনস্টাইন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কোন বিশ্বাসের কথা কখনোই লিখে যাননি। বরং আইনস্টাইন নিজের ‘ঈশ্বর বিশ্বাস’ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে এক ধরনের বিভ্রান্তিতে ভোগছিলেন বলা যায়। কিন্তু আইনস্টাইনের বিভিন্ন সময়ে লেখা বিচ্ছিন্ন সেসব ধর্ম এবং ঈশ্বর সংক্রান্ত লেখা পড়ে ঈশ্বরে ‘বিশ্বাসী’রা খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠতেন। কিন্তু মৃত্যুর এক বছর আগে বন্ধুকে হাতে লেখা চিঠি পরে তাদের অনেকেই হতাশ হয়েছে।
চিঠিতে আইনস্টাইন নিজের হাতেই অস্বীকার করেছিলেন ‘ঈশ্বরের হাত’। লিখেছিলেন, ‘‘ওই সব হাত-টাত বলে কিছু নেই। সবটাই মানুষের দুর্বলতা।’’
জার্মান দার্শনিক এরিখ গুটকাইন্ডকে লেখা দেড় পাতার ওই চিঠিতে আইনস্টাইনের বক্তব্য ছিল, ‘‘তা সে যে ধর্মই হোক, আদতে তা আমাদের আদিম কুসংস্কারই। আমি মনে করি, ঈশ্বর শব্দটা মানুষের দুর্বলতার প্রকাশ আর সেই দুর্বলতা থেকেই তার জন্ম। আর কিছুই নয়।’’
সেই চিঠিতে বাইবেল-কেও তোপ দেগেছিলেন আইনস্টাইন। পরোয়া করেননি নিজের ইহুদি ধর্মকেও। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘বাইবেলে তো আসলে আদিম কিংবদন্তীদের মহান বানানো হয়েছিল। তাঁদেরই স্তুতি রয়েছে সেখানে। কোনও ব্যাখ্যা, কোনও কিছুই আমার এই ধারণা বদলাতে পারবে না। একই কথা খাটে ইহুদি ধর্মের ক্ষেত্রেও।’
আসলে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন নিজের ধর্ম বিশ্বাস এবং ঈশ্বর ভাবনা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। তিনি কখনো কখনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছেন, কিন্তু ব্যক্তি ঈশ্বরে নয়। তিনি স্পষ্ট বলেছেন- মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক কোনো ব্যক্তি ঈশ্বরের বিশ্বাস তিনি ঘুণাক্ষরেও করেন নি। আবার তিনি একইসাথে নাস্তিকও মনে করেন নি।
বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর “আমার দৃষ্টিতে জগত্” শীর্ষক প্রবন্ধের শেষ দিকে স্রষ্টা ও ধর্ম সম্পর্কে কিছু মতামত দিয়েছেন। তাঁর এই প্রবন্ধটির ইংরেজি নাম ‘The world I see it’, ‘Ideas and Opinions’ নামক গ্রন্থে এই প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সঞ্জা বার্গম্যানের অনূদিত গ্রন্থ থেকে এ ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।। ওই প্রবন্ধের এক জায়গায় আইনস্টাইন লিখেছিলেন-
- “মধুরতম অনুভূতি আমরা লাভ করতে পারি রহস্য সন্ধানের কৌতূহল-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে। প্রকৃত শিল্পকলা এবং প্রকৃত বিজ্ঞানের সূচনাবিন্দুতে থাকে রহস্য উদঘাটনের তীব্র আগ্রহ। এ আগ্রহ যার শেষ হয়ে যায়, যে আর বিস্মিত হয় না, কৌতূহলের আনন্দে কর্মচঞ্চল হয় না, সে মৃত-তার দৃষ্টিশক্তি নির্বাপিত। ধর্মের জন্ম দিয়েছে রহস্য সন্ধানের এ অভিজ্ঞতাই-সেক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভয়ও যুক্ত থাকতে পারে। রহস্যময় অজানা কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর গভীরতম যুক্তিবোধ ও দীপ্তিময় সৌন্দর্যবোধভিত্তিক আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ তীব্র অনুভূতির আমরা আমাদের সত্তায় অনুভব করতে পারি তাদের আদি ও অবিকৃত রূপের মধ্যে। এ আগ্রহ ও অনুভূতি দ্বারাই গঠিত হয় প্রকৃত ধর্মবোধ। এ অর্থে এবং কেবল এ অর্থেই আমি গভীর ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষ। আমি এমন কোনো ঈশ্বর কল্পনা করতে পারি না, যিনি তার সৃষ্ট জীবকে পুরস্কৃত করেন কিংবা শাস্তি দেন অথবা যিনি আমাদের ইচ্ছাশক্তির মতো কোনো প্রকার ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আমি কল্পনা করতে পারি না এবং কখনো কল্পনা করতে চাইও না যে, দৈহিক মৃত্যুর পরেও কোনো ব্যক্তির সত্তা বেঁচে থাকে। দুর্বল প্রকৃতির লোকেরা ভয় ও স্বার্থবোধ বশে এ ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারে।”
একটি বিষয় এখান থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও অন্য দশজন সাধারণ মানুষের ন্যায় বয়সের শেষ ভাগে এসে কিছুটা হলেও হতাশাগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিলেন হয়তো। তার সেই হতাশার জায়গা থেকে হয়তো আইনস্টাইন নিজেকে কখনো অজ্ঞেয়বাদী বলে দাবি করেছেন আবার কখনো সাফ না বলে দিয়েছেন এসব ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে।
যে আলবার্ট আইনস্টাইন নিজের বন্ধুকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন- আসলে ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। সকলকিছুই মানুষের মনের দুর্বলতা। সেই আলবার্ট আইনস্টাইনই লিখেছিলেন- আমি স্পিনোজার ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। যিনি নিজেকে উন্মোচন করেন অস্তিত্ব আছে এমন সকল কিছুর মধ্যে বিদ্যমান সুশৃঙ্খল সংহতিতে।
উইকপিডিয়া
আনন্দবাজার (০৫ ডসিম্বের ২০১৮)
বজিয় শাশ্বত (স্মরণকিা), শক্ষিা মন্ত্রণালয়, ডসিম্বের ২০১৪
এই বিভাগের আরও লেখা-
- বিশ্বের শীতলতম স্থান অয়মিয়াকন | Eye News
- ঝগড়া করে প্রেমিকাকে কে টে ৩৫ টুকরা করে ফেলে দিয়েছিলেন এই যুবক!
- কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার এবং অজানা নৃশংস কাহিনী
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নীলাদ্রি লেক আমাদের এক টুকরো কাশ্মীর | পাখির চোখে নীলাদ্রি
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ