লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন
আপডেট: ১৪:৫১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
সভ্যতার বিকাশে মুসলিমদের দারুণ সব আবিষ্কার
ল্যাবরেটরিতে জাবির ইবনে হাইয়ান (চিত্রকর্ম)। ছবি- সংগৃহীত
প্রাচীনকালে মুসলিম বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকরা আবিষ্কার করেছিলেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস। বিভিন্ন সময়ে মুসলিমদের এসব আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আবিষ্কারের সেসব কাহিনিতে পাওয়া যাবে এমন অনেক তথ্য যা আপনাকে চমকে দেবে। আই নিউজের পাঠকদের জন্য আজ এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন সাইফুর রহমান তুহিন।
কফি : আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ ইথিওপিয়ার কাফা অঞ্চলের খালিদ নামের এক আরব বাসিন্দা ছাগল চরানোর সময় খেয়াল করেন যে, জামের মতো এক ধরনের ফল খাওয়ার পর প্রাণীগুলোকে অনেক তরতাজা দেখাচ্ছে। খালিদ ওই ফলগুলোকে সেদ্ধ করে সর্বপ্রথম কফি তৈরি করেন। এরপরই পানীয়টি ইথিওপিয়া থেকে ইয়েমেনে রফতানি করা হয়। সেখানে সুফি-সাধকরা বিশেষ উপলক্ষে রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য এটি পান করেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে কফি পৌঁছে যায় মক্কা ও তুরস্কে। সেখান থেকে ১৬৪৫ সালে এটি যায় ইতালির ভেনিস নগরীতে। ১৬৫০ সালে পাস্ক রোসি নামের এক তুর্কীর হাত ধরে এটি ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। তিনি লন্ডন নগরীর লোম্বার্ড স্ট্রিটে সর্বপ্রথম কফির দোকান চালু করেন। এরপরই বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার লাভ করে পানীয়টি।
ক্যামেরা : প্রাচীন গ্রিকরা মনে করতো যে, আমাদের চোখে লেজার রশ্মির মতো আলোকরেখা রয়েছে যা আমাদের দেখতে সাহায্য করে। দশম শতাব্দীতে মুসলিম গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইতাম সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন যে, চোখ থেকে যতোটা আলো বেরোয় তার চেয়ে বেশি আলো চোখে প্রবেশ করে। আলো উইন্ডো শাটারের মাধ্যমে একটি বিন্দুতে প্রবেশ করতে পারে। এটি বুঝতে পারার পর তিনি প্রথম পিনহোল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। আল-হাইতাম বুঝতে পারেন যে, বিন্দু যতো ছোট হবে ছবি ততো ভালো হবে।
এ উপলব্ধি থেকে তিনি প্রথম অবসকিউরা (ডার্করুম) স্থাপন করেন। একটি পরীক্ষণের মাধ্যমে পদার্থবিদ্যার দার্শনিক রূপ তুলে ধরার জন্য তিনি বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী।
প্যারাস্যুট : আমরা জানি যে, অরভিল রাইট ও উইলভার রাইট উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছিলেন। তবে এর এক হাজার বছর আগেই স্পেনের মুসলিম কবি, জ্যোতির্বিদ, সুরকার ও প্রকৌশলী আব্বাস ইবনে ফিরনাস আকাশে ওড়ার একটি বাহন তৈরির প্রচেষ্টা চালান।
৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি পুরনো আলখাল্লায় কাঠের পাত সংযোজন করে কর্ডোবার গ্র্যান্ড মসজিদের মিনার থেকে লাফিয়ে পড়েন। তিনি আশা করেছিলেন যে, এভাবে তিনি পাখির মতো মসৃণ গতিতে উড়বেন কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তবে মাটিতে পড়ার আগে আলখাল্লার গতি কমে যাওয়ায় আব্বাস মারাত্মক কোন আঘাত পাননি। তার ওই বাহনটিকেই ইতিহাসের প্রথম প্যারাস্যুট বলে গণ্য করা হয়।
৮৭৫ সালে মুসলিম মনিষী আব্বাস ইবনে ফিরসান প্রথম হাতে বানানো প্যারাসুট নিয়ে ওড়েন। প্রায় ১০ মিনিট তিনি ভেসে থাকতে সক্ষম হন।
৮৭৫ সালে ৭০ বছর বয়সে আব্বাস সিল্কের কাপড়ের সাথে ঈগল পাখির পালক যুক্ত করে পর্বতের ওপর থেকে ঝাঁপ দেন। এভাবে তিনি উল্লেখযোগ্য উচ্চতায় ওড়েন। দশ মিনিট ভেসে বেড়াতে সক্ষম হলেও নিরাপদে মাটিতে নামতে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আব্বাস। পরে তার নামে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চাঁদের একটি গর্তের নামকরণ করা হয়।
রসায়ন শাস্ত্র : ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইসলামের সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ডিস্টিলেশন অর্থাৎ সিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল পদার্থের একটিকে আরেকটি থেকে পৃথক করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। জাবিরই অনেক মৌলিক প্রক্রিয়া ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে আলকেমিকে কেমিস্ট্রি বা রসায়ন শাস্ত্রে রূপ দেন।
তার আবিষ্কৃত তরলীকরণ, স্ফটিকীকরণ, সিদ্ধকরণ, শুদ্ধকরণ, অক্সিজেনের সাথে যুক্তকরণ, বাষ্পীভবন ও ফিল্টারেশন প্রক্রিয়া এখনো বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করা হয়। সালফিউরিক ও নাইট্রিক এসিড আবিষ্কারের পাশাপাশি তিনি চোলাইযন্ত্র আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র তৈরি হচ্ছে গাঢ় গোলাপ জল, বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্যাদি ও অ্যালকোহল (যদিও ইসলাম ধর্মে এটি হারাম)।
জাবির ইবনে হাইয়ান সঠিক প্রক্রিয়া অনুসারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতেন। রসায়ন শাস্ত্রের জনক হিসেবে তার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
শল্যচিকিৎসার সরঞ্জাম : আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপারেশন করার জন্য যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয় তার অনেকগুলোই দশম শতাব্দীতে মুসলিম শল্যবিদ আল-জাওয়াহিরির উদ্ভাবিত দ্রব্যাদির মতো। তার উদ্ভাবিত হালকা ছুরি, অস্থি কাটার ছুরি, ছোট সাঁড়াশি, চোখের অপারেশনে ব্যবহৃত সূত্কাঁ চিসহ ২০০ প্রকার শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি আধুনিক যুগের যে কোন শল্যবিদের অতি পরিচিত জিনিস।
তিনিই প্রাকৃতিকভাবে অদৃশ্য হয় এমন সূতা আবিষ্কার করেন যা অপারেশনের পর সেলাইয়ের জন্য সার্জনরা ব্যবহার করে থাকেন। ক্যাপসুল তৈরির জন্যও এর ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া উইলিয়াম হার্ভে রক্ত পরিসঞ্চালন পদ্ধতি আবিষ্কারের ৩০০ বছর আগেই ইবনে নাফিস নামে এক মুসলিম মেডিকেল ছাত্র এ প্রক্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছিলেন।
শুধু তা-ই নয়, আফিম ও অ্যালকোহলের মিশ্রণের মাধ্যমে যে চেতনানাশক ব্যবহার করা হয় তাও আবিষ্কার করেন মুসলিম চিকিৎসকরা। তারা হলো নীডলেরও উন্নতি সাধন করেন, যা ছোখের ছানি অপসারণে আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
উইন্ডমিল বা বায়ুকল : ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের এক খলিফার জন্য শস্য গুঁড়া করা এবং সেচকার্যে পানি উত্তোলনের উদ্দেশ্যে উইন্ডমিল আবিষ্কৃত হয়। মরুময় আরব অঞ্চলে যখন মৌসুমী পানির প্রবাহগুলো শুকিয়ে যেতো তখন শক্তির একমাত্র উৎস ছিল বাতাস যা প্রায় মাসখানেক ধরে একদিক থেকে প্রবাহিত হতো। তখনকার দিনে ৬ থেকে ১২টি পাখাবিশিষ্ট উইন্ডমিল অট্টালিকা বা তালপাতার ওপর দেখা যেতো। এর ৫০০ বছর পর ইউরোপে উইন্ডমিলের প্রচলন হয়।
রকেট : বারুদ তৈরিতে ব্যবহৃত নোনতা গানপাউডার চীনারা আবিষ্কার করে আগুন জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করেছিলো। কিন্তু আরবরা সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য গানপাউডার বিশুদ্ধকরণের বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলো। ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমদের আবিষ্কৃত আগ্নেয়াস্ত্র প্রতিপক্ষ শিবিরে ভীতির সঞ্চার করে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলিমরা রকেট (যাকে তারা বলতো স্বয়ংক্রিয় দাহ্য ডিম) এবং টর্পেডো (নাশপাতি সদৃশ সম্মুখে অগ্রসরমান বোমা যার অগ্রভাগ ছিলো বর্শার মতো) আবিষ্কার করে। টর্পেডো শত্রুজাহাজকে ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যেতো।
ফাউন্টেন পেন : ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের সুলতানের প্রয়োজনে ফাউন্টেন পেন আবিষ্কৃত হয়। তিনি এমন কলম চাইছিলেন, যা তার হাত কিংবা পরনের পোশাককে নষ্ট করবে না। এই কলমের মধ্যে কালি জমিয়ে রাখার জায়গা থাকতো। বর্তমান যুগের কলমের নিবের মধ্যে ফেড ইঙ্ক থাকে, যা তখনকার দিনের কালির আধুনিক সংস্করণ।
সূত্র : দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউকে
লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক
আই নিউজ ভিডিও গ্যালারী
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ