সাইফুর রহমান তুহিন
মসলিন কাপড় সম্পর্কে যতো চমকপ্রদ তথ্য
সুদূর অতীত কাল থেকেই আমাদের এই উপমহাদেশে মসলিন কাপড়ের পরিচিতি ছিলো ব্যাপক। অত্যন্ত মিহি বুননে তৈরি এক ধরনের সূতা থেকে তৈরি হতো বহুল প্রচলিত মসলিন কাপড়। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভাবিত ব্যতিক্রমী ও সূতায় হাতে বোনা এ কাপড়টি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ইউরোপে রপ্তানি শুরু হয়।
সুপ্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতের মসলিন কাপড়ের উদ্ভব ঘটেছে। নিম্নে এগুলোর মধ্যে একেবারে প্রধান প্রধান কয়েকটির বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো :
মল-মল খাস : মল-মল খাস শব্দটি এসেছে ‘মল-বুশ খাস’ থেকে যার দ্বারা বুঝায় বিশেষ ধরনের কাপড়। এগুলো ছিলো রাজা-বাদশাহদের খুব পছন্দের পোশাক। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্যই মূলত: এগুলো তৈরি হতো।
মসলিন কাপড়ের মধ্যেও রয়েছে নানান জাত।
ঝুনা : ঝুনা ছিলো রেশম জাতীয় আরেক প্রকারের মিহি মসলিন কাপড় যা বিশেষ করে নর্তকীদের খুবই পছন্দনীয় ছিলো। ঝুনা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে হিন্দি শব্দ ‘ঝিনা’ থেকে যার অর্থ হলো হালকা। মাত্র ১,০০০ সূতায় (এখানে সূতার সংখ্যা বলতে বুঝায় প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সূতার সংখ্যা) গড়া ঝুনা ছিলো একেবারে স্বচ্ছ যার কারণে এটি রপ্তানি দ্রব্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়। তারপরও গৃহবধূ ও হারেমের (অন্দরমহল) বাসিন্দাদের কাছে এটির জনপ্রিয়তা ছিলো।
রঙ্গো : অনেকটা ঝুনার মতোই তবে এটিকে বর্ণনা করা হয়েছে রেশম জাতীয় মসলিনের চেয়ে একটু ভিন্ন হিসেবে। সীমিতসংখ্যক সূতায় তৈরি হলেও রঙ্গোর ওজন ছিলো মল-মল খাসের তুলনায় অল্প একটু বেশি।
সূতার প্রকারভেদে আলাদা হয় মসলিনের মান আর সৌন্দর্যও।
আবরাওয়ান : আবরাওয়ান শব্দের অর্থটি এসেছে দুটি ফারসি শব্দ থেকে যার দ্বারা বুঝায় পানি ও প্রবাহ। এই প্রকারের মসলিন ছিলো অত্যন্ত কোমল ও হালকা আর এ কারণেই প্রবাহমান পানির সাথে এর তুলনা করা হতো।
খাসা : খাসা বলতে অত্যন্ত চমৎকার ও হালকা মসলিনকে বুঝানো হয়। এই কাপড়টি ছিলো সমান আকৃতির এবং মজবুত বুননের জন্য এটি বিখ্যাত। এটি তৈরিতে ১,৪০০ থেকে ২,৮০০ সূতা (প্রতি বর্গইঞ্চিতে সমতল ও লম্বালম্বি সূতার সংখ্যা) ব্যবহৃত হতো।
আবুল ফজল ইবনে মুবারক লিখিত ‘আইন-ই-আকবরী’ বইয়ে খাসা মসলিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই আবুল
ফজল ইবনে মুবারক মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে শাসনকার্যের বিবরণী পেশ করতেন।
সুবনম : সুবনম কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো সকালের শিশির বিন্দু। এটি এতো চমৎকার এক মসলিন ছিলো যে,ঘাসের ওপর একে বিছিয়ে শুকানো হলে শিশির বিন্দুর সাথে এটির পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিলো। এতে ব্যবহৃত সূতার সংখ্যা ছিলো ৭০০ থেকে ১,৪০০টি।
সুরবান্দ নামক মসলিনটি মূলত: মাথার আবরণ যেমন – পাগড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।
আলাবাল্লী : বুননকারীদের বর্ণনা অনুসারে আলাবাল্লী বলতে বুঝাতো খুবই চমৎকার। এটি ছিলো সূক্ষ্ণভাবে বুননকৃত মসলিন। ‘সিক্যুয়েল টু দ্য পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথিয়ান সী’ গ্রন্থে আলাবাল্লীকে ‘আবোল্লাই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আলাবাল্লীতে ব্যবহৃত সূতার সংখ্যা ছিল ১,১০০ থেকে ১,৯০০ এবং এটির ওজন অন্যান্য মসলিনের তুলনায় বেশি ছিল।
তানজেব : তানজেব হচ্ছে আরেকটি ফারসি শব্দ যেটিকে ভাঙলে এর অর্থ দাঁড়ায় শরীর ও অলংকার। ৮০০ থেকে ১,৯০০ সূতার বুননের এই মসলিন ছিলো হালকা ও সমান।
তারান্দাম : তারান্দাম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি শব্দ ‘তুরুহ’ এবং ফারসি শব্দ ‘আন্দাম’ থেকে। দুটিকে মিলিয়ে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘শরীরের জন্য একপ্রকার কাপড়’। এই নামে ইংরেজরা এটি নিজ দেশে আমদানি করেছিলো এবং এটি পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলোূ। এই মসলিনটি ছিলো সমান আকৃতির এবং এতে ব্যবহৃত সূতার সংখ্যা ছিলো ১,০০০ থেকে ২,৭০০।
নিয়ানসুখ : এটি প্রায়ই বলা হতো যে, এই বিশেষ ধরনের মসলিনের আগমন ঘটেছিলো দু’চোখের তৃপ্তির জন্য। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে নিয়ানসুখ ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খুবই হালকা কাপড়ের তৈরি এই মসলিন গলাবন্ধনী হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এতে ব্যবহৃত সূতার সংখ্যা হতো ২,২০০ থেকে ২,৭০০ এর মধ্যে।
বুদ্দুন-খাস : ‘বুদ্দুন’ অর্থ শরীর আর ‘খাস’ অর্থ বিশেষ। এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার্য পোশাক তৈরির জন্য ব্যবহৃত হতো। বুননটা খুব সুক্ষ্ম না হলেও এর মান ছিলো বেশ উন্নত। এতে ব্যবহৃত সূতার সংখ্যা ছিলো প্রায় ২,২০০।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর গায়ে আঁকা কারুকাজগুলো।
সুরবান্দ : সুরবান্দ শব্দটি গঠিত হয়েছে দুটি ফারসি শব্দের সমন্বয়ে। ‘সুর’ অর্থ মাথা এবং ‘বান্দ’ অর্থ বন্ধনী। সুরবান্দ নামক মসলিনটি মূলত: মাথার আবরণ যেমন – পাগড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। প্রায় ২,১০০ সূতা প্রয়োজন হতো এটি তৈরির জন্য। ব্রিটিশ ভারতের শাসক ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এই সুরবান্দ তাদের নিজ দেশ যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করতো। ইংরেজরা মূলত: স্কার্ফ হিসেবেই এটি ব্যবহার করতো।
কামিস : আরবি কামিস শব্দের অর্থ হলো পোশাক । কুর্তা তৈরির জন্য এ জাতীয় মসলিন ব্যবহার করা হতো। একসময় কুর্তা এতো দীর্ঘ ছিলো যে, তা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে দিতো। এর জন্য প্রয়োজন হতো লম্বা ও সমান কাপড়ের যাতে সূতার সংখ্যা ছিল ১,৪০০।
জামদানি : বাহারি ডিজাইনে বুননকৃত মসলিন জামদানি নামেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। ‘জাম’ শব্দটি দ্বারা বুঝাতো ফুলের গুচ্ছ এবং ‘দানি’ দ্বারা বুঝাতো পাত্র যার মিলিত অর্থ দাঁড়ায় বিভিন্ন নকশা রাখার জন্য একটি ফুলের পাত্র। জামদনিতে ছিলো বাহারি ডিজাইনের সমাহার । বাজারে বিপুল চাহিদার কারণেই এটি ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
ঢাকা অঞ্চলের তাঁতী বা বুননশিল্পীদের অনেকেই এখনো মসলিন শিল্পটিকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেননি।
দুরিয়া : ‘ডোরাকাটা’ শব্দ থেকে উদ্ভব হয়েছে দুরিয়া নামটির যা একটি দাগকাটা মসলিন। এটি তৈরি হতো দুই অংশ সূতা এবং তিন অংশ সিল্ক ব্যবহার করে দুই কিংবা ততোধিক বাঁকানো সূতাকে মিশিয়ে। সাধারণত দুরিয়া তৈরি করা হতো ‘ভগা’ অথবা ‘সিরঞ্জ’ নামক সূতা থেকে।
পুরুষ ও মহিলা উভয়ের পোশাক তৈরির জন্যই এটি ব্যবহার করা হতো যাতে সূতার সংখ্যা প্রয়োজন সাপেক্ষে ১,৫০০ থেকে ২,১০০ পর্যন্ত হতো।
চারকোণা : নামের সাথে মিল রেখেই চারকোণা ছিলো বর্গাকার ও চতুর্ভুজ আকৃতির নকশা করা মসলিন। মাপ, ওজন ও সতার সংখ্যার দিক থেকে চারকোণা ও দুরিয়া একরকমই ছিলো। তবে দুরিয়া ছিলো দাগকাটা আর চারকোণা ছিল প্রত্যেক কোণায় নকশা করা এবং বর্গাকৃতির।
কালের বিবর্তনে অতীতের ঐতিহ্যবাহী মসলিন অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ঢাকা অঞ্চলের তাঁতী বা বুননশিল্পীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ পুরনো এই শিল্পটিকে একেবারে হারিয়ে যেতে দেননি। যদিও এখন মসলিন সূতা আর আগের মতো মসৃণ নেই এবং আগের সেই বাহারি ডিজাইনও নেই। তারপরও বাঙালি তাঁতীদের উৎপাদিত সীমিত ডিজাইনের চাহিদা একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। এগুলোর আকর্ষণ এখনো বজায় রয়েছে এবং ভদ্র সমাজ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে বর্তমান যুগের মসলিনের যথেষ্ট কদর রয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিকে তাঁতের নকশা করা এক ধরনের মসলিনের পুনর্জাগরণ ঘটে যা ব্যাপকভাবে জামদানি শিল্প নামে পরিচিত। জামদানির ছিলো ফুলেল ও জ্যামিতিক সব ডিজাইন এবং বিশ্বাস করা হতো যে এটি পার্সিয়ানদের (পারস্য বা ইরানের অধিবাসী) দ্বারা প্রভাবিত।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন?
কাপড়ের বুননে দারুণ ডিজাইনের পাশাপাশি এতে চারাগাছ ও ফুলের নকশা দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হতো এবং সেরা ডিজাইনগুলোতে থাকতো ধারালো প্রান্তের পরিবর্তে মসৃণ সব দাগ। বাহারি ডিজাইনের এই নজরকাড়া বৈচিত্র্য জামদানিকে অন্য সব মসলিন থেকে আলাদা করে তুলে।
শুরুটা ঢাকায় হলেও ক্রমান্বয়ে জামদানির প্রসার ঘটে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এবং সময়ের ক্রমবিবর্তনে এটিতে আরও বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের যোগ হয়। এই বৈচিত্র্য ও নতুনত্ব অনেকটা প্রভাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর দ্বারা।
বর্তমান যুগে এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণাভিত্তিক, অর্থায়নভিত্তিক ও বিপণনভিত্তিক সংগঠন যা একটি ইতিবাচক দিক। এখন বাংলাদেশের প্রয়োজন বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার সহায়তায় লুপ্তপ্রায় মসলিন শিল্পের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেওয়া।
লেখক : সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক।
আই নিউজের ভিডিও গ্যালারীতে দেখুন
নীলাদ্রি লেক আমাদের এক টুকরো কাশ্মীর | পাখির চোখে নীলাদ্রি
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ