শাহরিয়ার অভি
আপডেট: ১৩:৪৬, ৯ এপ্রিল ২০২৩
সন্তান জন্ম হবে এবার মাতৃগর্ভের বাইরে, কিন্তু কিভাবে?
সাম্প্রতিক সময়ে একটি ভিডিওতে, বায়োটেকনোলজিস্ট এবং ফিল্ম প্রযোজক হাশেম আল-গাইলি (Hashem Al-Ghaili) আমাদের EctoLife- বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম গর্ভের আকর্ষণীয় সফরে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে হাশেম আল-গাইলি পরিকল্পনার নাম কী? কীভাবে তিনি তাঁর গবেষণালন্ধ জ্ঞান থেকে এই বৃহৎ পরিকল্পনাটি নিলেন? আই নিউজের পাঠকদের জন্য বিজ্ঞানের মজার এই টপিক নিয়ে লিখেছেন শাহরিয়ার ওভি। আর্টিকেলটির শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
হাশেম আল-গাইলির এ পরিকল্পনার Ectolife নাম দেওয়া হয়েছে এই পরিকল্পনার। বলা হয়েছে এটা পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম গর্ভ তৈরির একটি বড় উদ্যোগ। এখানে বাবা মায়েরা তাঁদের পছন্দ মতো শিশু 'তৈরি' করে নিতে পারবেন। বিজ্ঞানী জানিয়েছেন গোটা ৫ বছরের গবেষণার উপর এই ভাবনা দাঁড়িয়ে আছে মানে অন্তত ৫ দশক ধরে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের পরিশ্রমের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে Ectolife.
৩০০ টিরও বেশি ধরনের জিনের বিকল্প দেওয়া হবে বাবা মায়েদের। এক্টোলাইফের বিজ্ঞানী হাশেম আল-গাইলি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি অ্যানিমেশন ভিডিও প্রকাশ করেছেন ভিডিওটিতে বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম ভ্রুণ কেন্দ্রটিকে দেখানো হয়েছে এছাড়াও কিভাবে কৃত্রিম ভাবে একটি নবজাতক শিশুর জন্ম হয় সেটাও দেখানো হয়েছে।
EctoLife হল এমন একটি ধারণা যা পিতামাতাকে কৃত্রিম গর্ভের সাহায্যে কাস্টমাইজ শিশুদের 'উৎপাদন' করার প্রস্তাব দেয়। যেসব পিতামাতারা তাদের শিশু পালন করতে আগ্রহী তারা ইচ্ছে করলেই তাদের শিশুদের বুদ্ধিমত্তা, উচ্চতা, চুল, চোখের রঙ, শারীরিক শক্তি এবং এমনকি ত্বকের টোন বেছে নিতে দেয় যা সব কিছুই হবে পিতা-মাতার ইচ্ছেমতো এবং জেনেটিক রোগ এড়াতে পারেন (CRISPR Cas 9) জিন সম্পাদনা টুলের সাহায্যে, আপনি ৩০০ টিরও বেশি জিনের বিস্তৃত পরিসরের মাধ্যমে আপনার শিশুর যে কোনও বৈশিষ্ট্য সম্পাদনা করতে পারেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৩ লাখ নারী গর্ভাবস্থার জটিলতায় মারা যায় যেটা কিনা বাস্তব সত্য। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় কোনও না কোনও স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য প্রাণ হারান। বর্তমানে এমন অনেক নারী ও পুরুষ রয়েছেন যাঁরা চেয়েও সন্তানের জন্ম দিতে পারেন না। এর নেপথ্যে থাকতে পারে কোনও শারীরিক সমস্যা বা অন্য কোনও কারণ। এবং যেসব নারীদের ক্যান্সারের মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে তাদের জরায়ু অপসারণ করা হয়েছে।
EctoLife কৃত্রিম গর্ভ নারীদের কষ্ট লাঘব করতে এবং সি-সেকশনের সম্ভাবনা কমানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, একজন মা তার শরীরের প্রসবের বেদনাদায়ক ভাবে ধাক্কা দেওয়ার বা মৃত্যুবরণ করার পরিবর্তে।
তাছাড়া EctoLife এমন দেশগুলিতে যেতে পারে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তীব্র কম/হ্রাস রয়েছে সেই দেশগুলো হলো দক্ষিণ কোরিয়া, বুলগেরিয়া এবং জাপানের মতো দেশগুলি, যেখানে গুরুতরভাবে কম জন্মহার রয়েছে।
মূলত তাঁদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে এক্টোলাইফ বলে একটি সংস্থা। সন্তানহীন মানুষকে সন্তান দিতে বিশ্বের প্রথম 'সন্তানের কারখানা' তৈরি করতে চলেছে তারা। এই কারখানায় থাকবে একাধিক কৃত্রিম গর্ভ। সেখান থেকে প্রতি বছরে ৩০ হাজার সন্তানের জন্ম দেওয়া যাবে।
কীভাবে কাজ করবে এই EctoLife পরিকল্পনা?
ইংল্যান্ডের একটি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে এই গোটা পরিকাঠামো চলবে পুনর্নবীকরণ শক্তির মাধ্যমে। জানা গিয়েছে এই পরিকল্পনার জন্য ৭৫টি গবেষণাগার তৈরি করা হবে। আর এই সমস্ত গবেষণাগারে থাকবে ৪০০ টা করে কৃত্রিম গর্ভ। আর সেখানে মায়ের গর্ভের মতো বেড়ে উঠবে এক একটি শিশু। আর সেই শিশুর শরীরে থাকবে তাঁর বাবা মায়ের ইচ্ছে মতো সমস্ত বৈশিষ্ট্য।
এক্টোলাইফের ৭৫টি ল্যাবোরেটরিতে অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম রয়েছে। এক একটি ল্যাবে ৪০০টি কৃত্রিম গর্ভ বা 'গ্রোথ পড' রয়েছে। সেখানে আসল গর্ভের মতোই সন্তানের জন্ম হবে। জানা গিয়েছে, কৃত্রিম গর্ভের সঙ্গে আসল গর্ভের কোনও পার্থক্যই নেই। এমন প্রযুক্তি এলে স্বাভাবিক ভাবেই সন্তানের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই সংস্থা জানিয়েছে, এটি আসল মায়ের গর্ভের মতোই নিরাপদ। যা একটি সংক্রমণমুক্ত পরিবেশে বছরে ল্যাবে ৩০,০০০ শিশুর জন্ম দিতে পারে৷ প্রতিটি গ্রোথ পড সেন্সর দিয়ে সজ্জিত যা হার্টবিট, অক্সিজেনেশন স্যাচুরেশন, তাপমাত্রা, শ্বাস প্রশ্বাস এবং রক্তচাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলি নিরীক্ষণ করে একটি Al সিস্টেমের মাধ্যমে, শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলি নিরীক্ষণ করে এবং যেকোন সম্ভাব্য জেনেটিক অস্বাভাবিকতা কে বেছে নেয়।
অধিকন্তু, স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি নিশ্চিত ও সমর্থন করার জন্য, দুটি কেন্দ্রীয় বায়োরিয়াক্টর দ্বারা শিশুদের স্থিরভাবে এবং টেকসইভাবে 'রক্ষণাবেক্ষণ' করা হয়। প্রথম বায়োরিয়াক্টর একটি কৃত্রিম নাভির মাধ্যমে পুষ্টি, গুরুত্বপূর্ণ হরমোন, অ্যান্টিবডি, বৃদ্ধির কারণ, অক্সিজেন এবং অ্যামনিওটিক-সদৃশ তরল দ্রবণ পাম্প করে। একটি AI-নিয়ন্ত্রিত সিস্টেমের জন্য প্রতিটি শিশু ' তাদের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টম পুষ্টি গ্রহণ করে।' ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বায়োরিয়্যাক্টরটি কৃত্রিম নাভির মাধ্যমে নির্গত শিশুর বর্জ্য পণ্যগুলি গ্রহণ করে এবং পুনর্ব্যবহার করে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে প্রযুক্তিটি এত দূরের নয় এবং ভবিষ্যতে এটি বাস্তবে পরিণত হতে পারে।
এন্ড্রয়েড ফোন অ্যাপের মাধ্যমে করা যাবে শিশুকে পর্যবেক্ষণ
EctoLife এর কার্যক্রমের কেন্দ্রে রয়েছে উন্নত মানের প্রযুক্তি যার জন্য প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রোথ পডের সাথে সংযুক্ত একটি স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়। যা তাদের শিশুর স্বাস্থ্য দূর থেকে ট্র্যাক করার জন্য পিতামাতার ফোনে পাঠানো রিয়েল-টাইম ডেটা চিত্রিত করে। অ্যাপের মাধ্যমে, পিতামাতারা বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে উচ্চ-রেজোলিউশনের লাইভ ভিউ উপভোগ করতে পারেন এর মধ্যে একটি গ্রোথ টাইম ল্যাপস রয়েছে যা বন্ধু এবং পরিবারের সাথে শেয়ার করা যেতে পারে। প্রতিটি কৃত্রিম গর্ভে অভ্যন্তরীণ স্পিকারও লাগানো থাকে যা সঙ্গীত বাজায় এবং সন্তানের কণ্ঠস্বর পিতামাতার কাছে প্রেরণ করে।
অন্যদিকে, গ্রোথ পডের অভ্যন্তরে একটি 360-ডিগ্রি ক্যামেরায় একজন পিতামাতার VR হেডসেটের সাথে সংযোগ স্থাপন করে, যা তাদের শিশুর বিকাশের উপলব্ধি সবকিছু দেখতে এবং শুনতে দেয় আপনি গর্ভে তাদের লাথি অনুভব করতে সক্ষম হবেন এবং এই অভিজ্ঞতাটি আপনার বন্ধুদের এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করতে পারবেন। অবশেষে, সম্পূৰ্ণ অপারেটিং সিস্টেম নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর এবং বায়ু শক্তির উপর চলে।
IVF এবং কাস্টমাইজেশনের স্বাধীনতা
প্রাকৃতিক প্রসব যেহেতু জরায়ুর বাইরে, প্রতিটি শিশুর গর্ভধারণ করা হয় ইন ভিট্রো (in vitro) ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) এর মাধ্যমে, যা পিতামাতাকে স্বাধীনভাবে ' সবচেয়ে কার্যকর এবং জেনেটিক্যালি উচ্চতর ভ্রূণ তৈরি করতে এবং নির্বাচন করতে দেয়, তাদের শিশুকে কোনো জৈবিক বাধা ছাড়াই বিকাশের সুযোগ দেয়। দম্পতিদের একটি অভিজাত এলিট প্যাকেজ হিসাবে দেওয়া হয় যা কৃত্রিম গর্ভে ভ্রূণ রোপন করার আগে পিতামাতাদের ৩০০ টিরও বেশি জিন কাস্টমাইজেশন পরিবর্তন করার স্বাধীনতা দেয়। চুল এবং চোখের রঙ নির্বাচন থেকে শুরু করে উচ্চতা, বুদ্ধিমত্তার স্তর এবং ত্বকের টোন পর্যন্ত, এই সব বাছাই বৈশিষ্ট্যটি CRISPR-Cas 9 জিন এডিটিং টুলের সাহায্য করা হবে।
এর আগে কখনো জরায়ুর বাইরে কৃত্রিম ভাবে ভ্রুণের বিকাশ হয়েছিল?
অবশ্যই হয়েছিল! প্রাণীর শরীরের বাইরে ভ্রুণের বেড়ে ওঠার পদ্ধতির নাম এক্টোজেনেসিস (ectogenesis) বলে। মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, এমনকি ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য এই পদ্ধতি। এবং ১৯৯০ সালে জাপানি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম অ্যামনিয়টিক তরলে একটি ছাগলের ভ্রূণকে অনেকদিন জীবিত রাখতে সক্ষম হন।
২০০১ সালে আবিষ্কৃত হয় এক্টোজেনেসিস। ইঁদুরের গর্ভের সঙ্গে প্লাসেন্টা মেশিন যুক্ত করে এক্টোজেনেসিস করা হয়। গবেষকরা মনে করছেন এর ফলে যেহেতু সন্তানের মনিটরিং করা অনেক সহজ হবে, মৃত শিশু প্রসবের প্রবণতাও অনেক কমবে।
যেভাবে কাজ করে এই যন্ত্র
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা একটি কৃত্রিম গর্ভ তৈরি করেন। ভবিষ্যতে প্রিম্যাচিউর বা অকালে জন্ম নেয়া শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে এটা ব্যবহার করা যাবে বলে সে সময় ধারণা করা হয়। এছাড়াও জরায়ু সহায়তা' যন্ত্রটি ভেড়ার উপর পরীক্ষা করে সাফল্যও পাওয়া গিয়েছিল।
গবেষকরা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য হলো প্রিম্যাচিউর শিশুদের ফুসফুস এবং অন্যান্য প্রত্যঙ্গ যাতে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। এই যন্ত্রটি মূলত একটি প্লাস্টিক ব্যাগ, যার ভেতরে রয়েছে কৃত্রিম অ্যামনিওটিক ফ্লুইড। এটার ভেতরের পরিবেশ অনেকটা জরায়ুর ভেতরের পরিবেশের মতো। এই প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধিত হলে, মাতৃগর্ভ ছাড়াই জন্মাবে শিশু। কৃত্রিম জরায়ুর মাধ্যমে বিকশিত হবে ভ্রূণ। প্রযুক্তির হাত ধরেই এই শতাব্দী শেষের আগেই হয়ত এমন সম্ভব হবে। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম 'এক্টোজেনেসিস' (Ectogenesis)।
বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী (J. B. S Haldane) জে. বি. এস হ্যালডেন এই শব্দের রচয়িতা। হ্যালডেন অনুমান করেছিলেন, ২০৭৪ সালের মধ্যে প্রায় ৭০% মানবশিশুর জন্ম এভাবেই হবে।
গবেষকরা বলছেন, যন্ত্রটি তৈরির কাজ প্রায় শেষ। কিছু আইন ও নৈতিক জটিলতার জন্য আপাতত চালু করা যাচ্ছে না এর ব্যবহার। ২০৩৪ সালের মধ্যেই ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যাবে বলেই তারা আশাবাদী। এই যন্ত্র চালু হলে সন্তান প্রসবের সময় মা বা সন্তানের মৃত্যুর হার কমবে।
আই নিউজ/এইচএ
আই নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও দেখুন
জলময়ূর পাখির সাথে একদিনের দারুণ গল্প | A story with Water Peacock
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ