হেলাল আহমেদ
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম : বাংলাদেশের ওভাল
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ছবি- সংগৃহীত
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম; এই সময়ে গুগলে বেশি সার্চ দেয়া বাক্যগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এর কারণ, সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম নিয়ে বাংলাদেশের খেলাপ্রেমীদের আকর্ষণ। বিশেষ করে ক্রিকেটটাকে যারা নিজেদের ধ্যান-জ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ক্রিকেট স্টেডিয়াম মানেই সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম বা আরেকটু স্পষ্ট করে বললে সিলেটের লাক্কাতুরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম।
বিগত কয়েকবছর আগেও সিলেটের স্টেডিয়ামগুলো নিয়ে এতোটা নাড়াচাড়া বা চিন্তাভাবনা হয়নি যা এখন হচ্ছে। এর কারণ এটি নয় সিলেট স্টেডিয়ামকে বিসিবি কতৃপক্ষ নতুন মোড়কে সাজিয়েছে। প্রধান কারণ আগে আন্তর্জাতিক খেলা মানেই ছিলো ঢাকার মীরপুর স্টেডিয়াম নয়তো চট্টগ্রামের সাগরপাড়ের স্টেডিয়াম। অর্থাৎ, বেশিরভাগ খেলাই আয়োজিত হতো এই স্টেডিয়ামগুলোতে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় প্রেক্ষাপট বদলের পাশাপাশি বিসিবির দল নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনার বদৌলতে আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো সিলেটে আয়োজন করা হচ্ছে।
লাক্কাতুরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম বাইরের জেলার মানুষের কাছে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম নামেই পরিচিত। যদিও সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম বললে রিকাবীবাজারের স্টেডিয়ামের নামও চলে আসে। সিলেটের এই স্টেডিয়ামটিও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্য একটি ভেন্যু। কিন্তু সমর্থক, খেলোয়াড়সহ আয়োজকদের আকর্ষণ সবুজ টিলা ঘেরা লাক্কাতুরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে ঘিরে। প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের মাঝে টিলা কেটে বানানো এই স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য বিমোহিত হন এখানে খেলা দেখতে আসা প্রায় সব ক্রিকেটপ্রেমী। শুধু ভক্ত বা সমর্থকরাই যে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের (লাক্কাতুরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম) রূপেগুনে মুগ্ধ তা নয়। বিভিন্ন দলের খেলোয়াড় যারা এরিমধ্যে এই মাঠে খেলে গেছেন তারাও মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন স্টেডিয়ামকে ঘিরে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান কোচ চণ্ডিকা হাতুরে সিং প্রথমবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে এমন একটি স্টেডিয়াম থাকা বা নির্মাণ করা সম্ভব!
লাক্কাতুরা স্টেডিয়াম যেন 'ওভালে'র মতো
সিলেটে ২০০৭ সালে নির্মিত লাক্কাতুরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামকে অনেকেই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘দি ওভাল’ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সঙ্গে তুলনা করেন। দি ওভাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পিচ এবং নান্দনিক গ্যালারীর কারণে বিশ্বে খ্যাতি পেয়েছে। ক্রিকেট জীবনে অনেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে ওভালে খেলার। সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এসে যেন ওভালেরই কিছু আভা দেখে যান খেলাপ্রেমীরা। এর কারণ সিলেটের গ্রীণ গ্যালারী।
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্রীণ গ্যালারী।
সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের গ্রীণ গ্যালারী অনেকের নজর কেড়েছে। গ্রীণ গ্যালারীটি মূলত স্টেডিয়ামের সীমানার ভেতরের টিলাগুলোকে কেটে কেটে সুন্দর করে গ্যালারী আকারে বানানো হয়েছে। যাতে বসে অনায়াসেই খেলা উপভোগ করা যায় প্রাকৃতিক মেজাজের সহিত। আর এই 'ফিল' নিতেই যেন অনেকে ছুটে আসেন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আকার-আয়তন ও যাত্রা
৬১৫ ফুঠ দৈর্ঘ্য ৪৮৫ ফুট প্রস্থ নিয়ে এই ক্রিকেট মাঠটি দেশের অন্যতম বড় একটি মাঠ। স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণ ক্ষমতা ২০০৭ সালের দিকে ১০ হাজার থাকলে ২০১৩ সালে তা বাড়িয়ে ২২ হাজারে উন্নীত করা হয়।
২০১৪ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের মাঠ হিসেবে এই স্টেডিয়ামকেও নির্বাচন করে বিসিবি। পরে ২০১৮ সালের নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। একইবছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ান ডে ম্যাচও এই স্টেডিয়ামে খেলে টাইগাররা। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ান ডে ম্যাচ খেলেছেন লিটন-সাকিব-তামিমরা।
স্টেডিয়ামটির বিশেষত্ব
সিলেট স্টেডিয়ামের বিশেষত্ব হচ্ছে মাঠের আউটফিল্ড, উইকেট ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বিশ্বমানের। স্টেডিয়ামের আউটফিল্ড দেশের অন্যান্য মাঠের তুলনায় ফাস্ট। ৭ টি উইকেটের প্রতিটিতেই নিয়মিত খেলা হয় বলে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। খেলোয়াড়দের দাবি দেশের অন্যান্য মাঠের উইকেটের তুলনায় এ মাঠের উইকেট বেশ স্পোর্টিং।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিলেট বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। হয়তো ভাবছেন বৃষ্টির কারণে পণ্ড হয়ে যেতে পারে ম্যাচ! প্রকৃতির উপর কারো হাত নেই এটা সত্য। তবে বৃষ্টি থামলে এখানে খেলা শুরু হতে বেশি সময় নিবে না। সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের মাঠ ও ড্রেনেজ সিস্টেমকে এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যে ভারী বর্ষণ হলেও ৩০ মিনিটেই মাঠ শুকিয়ে খেলা শুরু করা সম্ভব!
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার স্টেডিয়ামগুলোর একপাশে দর্শকরা উন্মুক্ত মাঠে খেলা দেখেন। সেখানে শুয়ে-বসে খেলা উপভোগ করেন ক্রিকেটপ্রেমিরা। সিলেটেও সেই সুযোগটি পাবেন ক্রিকেটপ্রেমিরা। মাঠের পশ্চিমপাশের একটি টিলাকে কৃত্রিম উপায়ে গ্যালারির মতো করে তৈরি করা হয়েছে। ঘাস লাগিয়ে সেটাকে সবুজের গালিচায় রূপ দেওয়া হয়েছে। উপরে উঠার জন্য দেওয়া হয়েছে সিঁড়ি। এছাড়া ধস ঠেকাতে প্রতিটি ধাপে ইট-কংক্রিটের ভিত্তিও দেওয়া হয়েছে।
যা আছে স্টেডিয়ামের ভেতরে
স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকে চারতলা বিশিষ্ট গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড। দুই তলায় ক্রিকেটারদের ড্রেসিং রুম। ড্রেসিং রুমের সুযোগ-সুবিধা বেশ উন্নত। আইসবাথ করার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জায়গা। ভেতরেই লকার রুম। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের চারতলায় ভিভিআইপি বক্সসহ রয়েছে একাধিক হসপিটালিটি বক্স। এর বামপাশে বসানো হয়েছে ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ড। এর ঠিক বিপরীত দিকে গ্রিন গ্যালারি ঘেঁষে রয়েছে জায়ান্ট স্ক্রিন।
স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড-২
দেশের অন্যান্য স্টেডিয়ামগুলোর মত এখানেও চারটি ফ্লাডলাইট বসানো হয়েছে। হসপিটালিটি বক্সের বিপরীত দিকে রয়েছে পাঁচতলা বিশিষ্ট মিডিয়া সেন্টার। তৃতীয় তলায় প্রেসবক্স। এর উপরে ধারাভাষ্যকার ও রেডিওর জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা। দ্বিতীয় তলায় ডাইনিং ও নিচ তলায় টিভির প্রডাকশন রুম। অনেকটাই মিরপুর শের-ই-বাংলার মত।
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২
সিলেটের এই স্টেডিয়ামটি আউটার স্টেডিয়াম নামে পরিচিতি পেলেও পুরো খেলা চালানোর মতো ব্যবস্থা নিয়ে শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম গ্রাউন্ড-২। এরিমধ্যে গ্রাউন্ড-২ এর উদ্বোধন হয়েছে। আবেদন পাঠানো হয়েছে গ্রাউন্ডটিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার উপযুক্ত স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। আবেদন মিলে গেলে অতিশীঘ্র এই গ্রাউন্ডেও আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো আয়োজন করা হবে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন বলেন, ১ হাজার ১ টাকায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে প্রতীকী মূল্যে গ্রাউন্ড-২ এর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তারপর ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সেই জমিতে পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করে এবং স্টেডিয়ামটি তৈরি হয়।
স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় গ্রাউন্ডে অনুশীলন মাঠ, ডরমেটরি, ক্রিকেট একাডেমি, স্কুল, মসজিদ, গ্রিন গ্যালারিসহ সব আয়োজন রয়েছে। জাতীয় ক্রিকেটার এবং ক্রিকেট কোচ ও সংগঠকরা মনে করেন, এটা ক্রিকেটারদের জন্য একটা বড় যুগান্তকারী সুযোগ।
আদর্শ স্টেডিয়ামের দৃষ্টান্ত হতে পারে আমাদের ভেন্যু
বাংলাদেশে সিলেটের বাইরেও আরো অনেক জেলায় স্টেডিয়াম রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি। কিন্তু আলোচনায় বসলে বারবার সামনে আসে এসব স্টেডিয়ামের অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং অপরিপূর্ণতার বিষয়টি। যেদিক থেকে সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম একটি আদর্শ স্টেডিয়ামের মডেল হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
অর্থাৎ, এই স্টেডিয়ামটির স্ট্রাকচারাল অনেক বিষয়, আশয় নিয়ে কাজ করে অন্যান্য ভেন্যুর উন্নয়নে কাজে আসতে পারে। যদিও এ ব্যাপারে যথাযথ কতৃপক্ষের আগ্রহ এবং পরিকল্পনা সবার আগে প্রয়োজন। দেশের ক্রিকেট ধীরে ধীরে যেভাবে সামনের দিকে সফলতার ছবি আঁকতে আঁকতে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট এসব ক্রিকেটীয় পরিকল্পনা আমদের দেশের ক্রিকেটের পরিবেশকে আরও মনোরম করতে পারে।
সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যস্ততা বাড়ছে। এখন প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো ফরম্যাটের আন্তর্জাতিক খেলা প্রকৃতিঘেরা এই ভেন্যুতে আয়োজন করা হচ্ছে। খেলা যারা নিয়মিত দেখেন তারাও আন্তর্জাতিক ম্যাচের ভেন্যু হিসেবে মাঝে মাঝে সিলেট স্টেডিয়ামকে চেয়ে আওয়াজ তুলছেন। এসবকিছু সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সম্ভাবনা এবং সক্ষমতাকেই ফুটিয়ে তুলছে। সামনের বছরগুলোতে এমনও হতে পারে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম মিরপুর বা চট্টগ্রামের স্টেডিয়ামগুলোর মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। এবং এটি হওয়া উচিৎ। সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়ামের খেলা আয়োজন হলে স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ পাওয়া যায় এমন কথা আজকাল অহরহই শোনা যাচ্ছে। এই কথাটি শুনে সিলেটীরা নিশ্চই মনে মনে আমার মতোন পুলক বোধ করেন। করারই কথা- সিলেটের কৃতিত্ব মানেই তো সিলেটবাসীর কৃতিত্ব।
- হেলাল আহমেদ, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ