মো. রওশান উজ্জামান রনি
আপডেট: ২১:৩০, ৬ আগস্ট ২০২৩
ব্রুনেইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ সম্পর্কে অজানা তথ্য
ব্রুনাইয়ের সুলতানের বাড়ি,স্বর্ণের গাড়ি ও প্লেন। ছবি লিখক
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিদের দখলে থাকা ব্রুনাই ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের সর্ব কনিষ্ঠ ৫,৭৬৫ বর্গকিলোমিটা্রের দেশটির রপ্তানি আয়ের ৯৫ ভাগের বেশি অংশই আসে জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মাধ্যমে। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ব্রুনাই ৬ষ্ঠ ও বিশ্বে ৩০তম। বহু দশক ধরে ধনী দেশগুলির মধ্যে ব্রুনাই একটি।
ব্রুনাইয়ের সুলতানের পুরো নাম হাসানাল বলকিয়াহ। ১৯৬৮ সাল থেকে একাধারে তিনি ব্রুনাইয়ের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধান। ২০২৩ সালের হিসাবে হাসানাল বলকিয়াহের মোট সম্পদ ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তাই তিনি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। আপনি কি জানেন ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ শুধুমাত্র এক দুইশ গাড়ির মালিক নন বরং তিনি ৭০০০ গাড়ির মালিক। যার মধ্যে ৫০০ টাই রোলস রয়েস। এগুলো তো কিছুই না সুলতান সাহেবের এইসব দামি গাড়ির সাথে সাথে খেলাধুলার উপর বেশ জোঁক আছে। কিন্তু তার এই শখ এতটাই অদ্ভত যে তার কখনো পোলো খেলতে ইচ্ছে হলে শুধুমাত্র একটা গেম খেলার জন্য পুরো ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরের আর্জেন্টিনা থেকে খেলোয়াড় নিয়ে আসেন। তাও আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু এই যে এত টাকা মহারাজা পানির মত খরচ করছেন তা আসে কোথা থেকে। এর মধ্যে একটা হতে পারে পুরো পৃথিবীতে তার তৈরি করা ৯ টা লাগজারিয়াস হোটেল থেকে। আর বাকি টাকা কোথা থেকে আসে সেটা আমরা আজকের এই প্রতিবেদনে জানবো।
তো এখন প্রশ্ন হল, সব টাকা পয়সা কি তিনি আরাম আয়েশেই শেষ করে দেন, নাকি কোনো ভালো কাজের উদ্দেশ্যেও ব্যয় করেন। তো চলুন আই নিউজের আজকের প্রতিবেদনে সুলতানের সে সকল অজানা তথ্যই উদঘাটন করা যাক।
গাড়ি এবং বিমান
আপনি কি এটা জানেন ব্রুনাইয়ের এই রাজার নামে গ্রিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও রয়েছে। তাও আবার রোলস রোয়েজ গাড়ির সবচাইতে বেশি কালেকশনের জন্য। ৫০০ রোলস রয়েসের সাথে তার প্রায় ৭০০০ গাড়ি রয়েছে। যার দাম প্রায় ৪৭ কোটি টাকারও বেশি। এইসব গাড়ির কালেকশনের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় গাড়ি হল সুলতানের গোল্ড প্লেটেড লিমো। যার দাম প্রায় ১০৩ কোটি টাকা। আর এই গাড়ি শুধুমাত্র স্পেশাল অকেশনেই বের করা হয়। সুলতানের গাড়ির কালেকশনে এমন কিছু গাড়িও রয়েছে যেগুলো এখনকার সময় খুবই দুর্লভ কিংবা সেই মডেলের গাড়ি একটাই তৈরি করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটা হলো রাইট হ্যান্ডএড মার্সিডিজ, CLK GTR যার দাম ২০ কোটি টাকারও বেশি। এত গাড়ির কালেকশনে ভর্তি তার গ্যারেজকে একটা শোরুম বলাই ভালো। কিন্তু যদি সুলতান এখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমনে যেতে চান তাহলে কি তিনি গাড়ি বের করতে বলবেন। না এজন্যই ২.৩৬৯ কোটি টাকার বোয়িং 747-এর মালিকও এই ব্রুনাই এর সুলতান। তার এই প্লেন এতটাই আলিসান যে তার ভেতরের কোন কারুকার্য সাধারণ না। এই প্লেনের বেসিন থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ এবং ক্রিস্টাল দিয়ে বানানো। যেখানে সুলতান আলাদা করে ৮৯০০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এত দামি প্লেনের তো একটা আলিশান নাম থাকা দরকার। তাই সেখানকার জনগণ একে ফ্লাইং প্যালেস বলে ডাকে। কিন্তু তার কালেকশন এখানেই শেষ না। সুলতান ৭৬৮ কোটি টাকার এয়ার বাস উড়িয়েছেন। কিন্তু সেটাতে অসাধারণ কিছু না পেয়ে উপরন্ত ৯২০ কোটি টাকা খরচ করে ইয়ার বাসকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। সত্যি বলতে রাজামহারাজারা কতটা সৌখিন ছিল তা বর্তমানের এই ব্রুনাই সুলতান কে দেখে কিছুটা অনুমান করা সম্ভব।
চুল কাটা
১৫ লাখ টাকায় হয়তো আমরা একটা ওয়ার্ড টুর দেওয়ার স্বপ্ন দেখে ফেলতে পারি। কিন্তু ব্রুনাইয়ের মহারাজা ১৫ লাখ টাকা প্রতি মাসে তার হেয়ারকাটের পেছনে খরচ করেন। না আপনাদের কান ঠিকই আছে। আপনি ঠিকই শুনছেন। এখনো আরো অনেক কিছু বাকি আছে। এটা তো তার হাত খরচের একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। তিনি প্রতি মাসে হেয়ারকাটের জন্য লন্ডন থেকে বিখ্যাত বারবার হেইন মডেলকে ভাড়া করে আনেন। আর উনি যেহেতু সুলতানের পার্সোনাল বারবার তাই তার জন্য সব সময় ফার্স্ট ক্লাস টিকিটই বুক করা হয়। শুধু তাই না তার দুইদিন লাগজারি হোটেলে থাকার খরচ সুলতানের সিন্দুর থেকে যায়। আবার চুল কাটা শেষে আবারও সেই ফার্স্ট ক্লাস টিকেটেই বাড়ি ফিরে যান। শুধুমাত্র সুলতানের চুল কাটার জন্যই হ্যান্ড মডেলের ১৫ লাখ টাকা আয় করার সঙ্গে সঙ্গে একটি ছোট টুরও হয়ে যায়।
সম্পত্তি
না এটা কোন তাজমহলের রেপ্লিকা নয় বরং এটা সুলতানের বাড়ি। যা প্রায় ২১ লাখ বর্গফুট জায়গার উপর বিচরণ করছে। যেখানে দু-চারটা নয় বরং সতেরোটা ফ্লোর রয়েছে। এই ইমারত দাঁড় করানো হয় ব্রুনাই এর স্বাধীনতার পরপরই। আর এতে ২.৯৬৯ কোটির একটা বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়। এই ইমারতটি স্থানা নুরুল ঈমান নামে আখ্যায়িত। সেই সাথে পৃথিবীর সবচাইতে বড় বেলেসের পেয়েছে গ্রিনেস বুক অফ এওয়ার্ল্ড রেকর্ডও । আপনি হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না যে এই মহলে ১৭৮৮ টি কামরা, ২৫০ টিরও বেশি বাথরুম, ৫টি সুইমিং পুল, ১৫০০ লোকের জন্য একটা মসজিদ, ৮০০ এর বেশি গাড়ি রাখার জন্য একটা গ্যারেজ আর বাকি সব হয়তো আপনি এক রাতে গুনে শেষ করতে পারবেন না। বাইরে থেকে দেখে এই মহল যতটা আলিশান মনে হয় ভেতর থেকেও ঠিক ততটাই। যেখানে ডায়মন্ডের ঝাড়বাতি, রয়েল ইটালিয়ান মার্বেল, গোল্ডেন কার্পেট আরো লাগজারিয়াস কারুকার্য দিয়ে ভর্তি। শুধু তাই না মহলের মধ্যে হলরুম এতটাই বিশাল যে সেখানে অনায়াসেই ৫০০০ লোকের জায়গা হয়ে যায়। শুধু হলরুমেই এত মানুষের জায়গা হলে পুরো মহলে ঠিক কত জনের জায়গা হবে তা আপনি ধারণা করে নিন।
খেলাধুলা এবং সঙ্গীত
এতক্ষণে হয়তো আপনি বুঝে গিয়েছেন যে আমাদের সুলতান কতটা সৌখিন মানুষ। কিন্তু আপনারা কি এটা ভাবতে পারবেন, যে ব্রুনাই সুলতান শুধুমাত্র একটি পোলো গেম খেলার জন্য সুদুর আর্জেন্টিনা থেকে প্লেয়ারদের পুরো টিম ভাড়া করে নিয়ে আসেন। আমাদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও ব্রুনাইয়ের রাজার কাছে এটা তেমন কিছুই না। যখনই তার পোলো খেলতে ইচ্ছে হয় তখনই তিনি পৃথিবীর বেস্ট পোলো প্লেইং ১০ আর্জেন্টিনা খেলোয়াড়দেরকে এভাবেই ডেকে নিয়ে আসেন। শুধু তাই না এই খেলা নিয়ে তিনি এতটাই সিরিয়াস যে তার কাছে প্রায় ২০০ এর বেশি পরোকোণী রয়েছে। যাদের থাকার জন্য আলাদা করে লাগজারিয়াস এয়ারকন্ডিশনিং জায়গাও বানানো হয়েছে। শুধু এতটুকুই না। সুলতান গলফ খেলতেও বেশি পছন্দ করেন। এই জন্য পৃথিবীর সবচাইতে খ্যাতিমান গলফার জ্যাক নিকোলাসকে দিয়ে তার একটা হোটেলে গলফ খেলার মাঠের ডিজাইনও করিয়েছেন। কিন্তু বড় বড় লোকদের বড় বড় শখ তো আর এখানেই শেষ হয় না। বরং খেলাধুলার সাথে তার পপ মিউজিকের ও বেশ আগ্রহ রয়েছে। আর এটা আরো ভালোভাবে অনুধাবন করা যায় তার ৫০ তম পার্টিতে। যেখানে মাইকেল জ্যাকসন তিনটা পারফরম্যান্স করেন। আর এর জন্য তাকে ১২৬ কোটি টাকা পেমেন্ট করা হয়েছিল। আর এই বার্থডে পার্টিতে ২০০ কোটি খরচ করেছিলেন যেখানে প্রায় ৩০০০ মানুষের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এই ২০০ কোটির মধ্যে মাইকেল জ্যাকসনের প্রেমেন্ট যুক্ত আছে কিনা সেটা আমাদের জানা নেই। বরং সেটা সুলতানই ভালো বলতে পারবেন। তার শখের লিস্ট এখানেই শেষ না। তার বড় মেয়ের বিয়েতে জনপ্রিয় গায়িকা হোয়াইটনি হাস্টনকেও নিয়ে এসেছিলেন ৫১ কোটি টাকা সম্মানী দিয়ে।
অর্থের ভালো ব্যবহার
আপনি কি এটা জানেন যে যেখানে একটা সাধারন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সচল রাখার জন্য মেইনসোর্স হয় সেই দেশের জনগণের দেওয়া ট্যাক্স। সেখানে ব্রুনাই ১৯৮৪ সালের পর থেকেই একটি ট্যাক্স ফ্রি দেশ। ব্রুনাই এর বেশিরভাগ অর্থ তেল এবং হোটেল থেকে আসে। আর যেহেতু এই দেশ পৃথিবীর সবচাইতে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ৫ নম্বর অবস্থানে রয়েছে তাই এখানকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ পার্সেন্ট মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। কিন্তু আপনি এটা শুনে নিশ্চিত অবাক হয়ে যাবেন যে ব্রুনাইয়ের প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচ সম্পূর্ণ ফ্রি। সেই সাথে হোস্টেল খাবার আরো বাকি যাবতীয় খরচ সরকার নিজেই বহন করে। এমন কি কেউ যদি বাইরের দেশ থেকে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায় সেই খরচটা ব্রুনাই সরকার নিজে থেকেই বহন করে। আর এটাই একমাত্র কারণ ২০১২ সালে ব্রুনের শিক্ষিতদের হার ৯৭.২% হওয়ার। শুধু তাই নয় এই দেশের চিকিৎসা সেবাও যথেষ্ট কম খরচে পেয়ে থাকে দেশের জনগণ। একবার ডাক্তারের পরামর্শ একব্রুনাই ডলার। তো এখন আপনি বলুন সুলতান তার এত অর্থ সম্পদ খরচের সাথে ভালো কাজেও ব্যয় করে তার সঠিক ব্যবহার করছেন কিনা।
আরো পড়ুন
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ