হেলাল আহমেদ, আই নিউজ
বাংলাদেশে আর্থিক প্রতারণার যতো ঘটনা
সম্প্রতি বাংলাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এমটিএফই মারফত টাকা প্রতারণার বিষয়টি। দেশের একাধিক জেলা-উপজেলা খবর আসছে অনলাইন ভিত্তিক এমটিএফইতে লাভের আশায় অর্থ বিনিয়োগ করে সব হারিয়ে লোকসানের খবর। এমটিএফই'র প্রতারণার শিকার হয়ে ঠিক কতো টাকার আর্থিক লোকসান হয়েছে তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন পত্রিকার খবরে প্রাপ্ত তথ্য বলছে কয়েক'শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমটিএফই গ্রুপ।
বাংলাদেশে বর্তমানে এমটিএফই নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। তবে এটিই বাংলাদেশে একমাত্র আর্থিক ক্যালেংকারির ঘটনা নয়। এমটিএফই'র আগেও বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ডেসটিনি, ইউনিপেটুইড, যুবক, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এহসান গ্রুপের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সেসব টাকার একটু অংশও ফিরে পান নি এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীরা। যদিও বিপরীতে তবু কমছে না ই-কমার্স ও অ্যাপভিত্তিক এসব কথিত প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ। ক্ষতিগ্রস্থ হবার কথা জেনেও অল্প সময়ে বিস্তর লাভের আশায় প্রতারিত হচ্ছেন তাঁরা।
দুবাই-ভিত্তিক এই কোম্পানির পুরো নাম মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ বা সংক্ষেপে এমটিএফই। ২০২২ সাল থেকে এই কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে, যদিও তাদের ওয়েবসাইটে ২০১৫ সাল থেকে ব্যবসা শুরুর দাবি করা হয়েছে। এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশি মাসুদ আল ইসলাম। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের বিনিয়োগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে এমটিএফই। যার মধ্যে আছে বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, শেয়ার মার্কেটসহ শতাধিক পণ্য। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে অর্থ লগ্নি এবং সংগ্রহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা। কিন্তু ঘটনার পর এখন সরকারি এই সংস্থাগুলির কেউই এর দায় স্বীকার করছেন না।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কিছু আইন আছে। কিন্তু আইন থাকলেও সেসব আইনের বিপরীতে অনুমোদিত কোনো কোম্পানি নেই। ফলে বাংলাদেশে এমটিএফই কীভাবে কাজ করলো এবং এতোগুলো টাকা কীভাবে হাতিয়ে নেয়া হলো- তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। এমন অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো কিছু বলতে পারছে না। তাঁরা দায় চাপিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। যদিও এ ব্যাপারে বিটিআরসির কাছ থেকেও কোনো মন্তব্য পায় নি সংবাদ মাধ্যম।
২০০৬ সালে দেশে এরকমই আরেকটি প্রতারণার ঘটনা ঘটায় যুব কর্মসংস্থান কর্মসূচি (যুবক)। ডেসটিনিতেও যারা অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের কেউই অর্থ ফেরত পান নি। এই প্রতারণার পরেও এরপরে আসা ইউনিপেটুইড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের জালেও পা দেন দেশের হাজারো মানুষ। লাভের আশায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন তাঁরা। এসব ঘটনা ঘটার পর সরকারের তরফ থেকে বহুবার তদন্ত করে বা কমিশন গঠন করা হলেও কোনো সুফল আসে নি। বরং সময়ের সাথে সাথে বেড়ে চলেছে এমএলএম বা অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্সের নামে প্রতারণার ঘটনা।
২০১৮ সালে দেশে প্রথমবার এমএলএম বা ই-কমার্স ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়। সেই যাত্রায় নাম লেখায় ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, কিউকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের কোটি টাকা প্রতারণা করে নেয়ার অভিযোগে তদন্ত এখনো চলমান আছে। কিছু ই-কমার্সের গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরতও পেয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ সংখ্য গ্রাহকই জানিয়েছেন প্রতারণায় শিকারের কথা।
হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা!
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতারিত গ্রাহকের হিসাব অনুযায়ী, এমএলএম প্রতিষ্ঠান ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা আটকা পড়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।
১৯৯৬ সালে নিবন্ধন পায় যুবক নামের প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা অনলাইন ভিত্তিক বা ই-কমার্স ব্যবসায় না আসলেও ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে যুবকের অবৈধ ব্যাংকলেনদেন সহ নানা প্রতারণায় যুক্ত থাকার তথ্য। ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক যুগ্ম সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে প্রধান করে দুইটি কমিশন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের তদন্তে উঠে আসে, যুবক নামক প্রতিষ্ঠানে ৩ লাখ ৩ হাজার ৭৩৯ ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকের দাবির পরিমাণ ২ হাজার ৫৮৮ কোটি ১১ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা ডেসটিনি গ্রুপ হাতিয়ে নেয় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর জন্য গ্রুপটি সময় নেয় ২০১২ সাল পর্যন্ত। এই গ্রুপের ক্রেতা, পরিবেশক ও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ। পরে ডেসটিনির কার্যক্রমেও প্রতারণা খুঁজে পায় সরকার। এবং ২০১৩ সাল থেকেই আদালতের নির্দেশে ডেসটিনির স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ে পুলিশের ওপর। ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জেলে আছেন। কিন্তু গ্রাহকেরা এখনো তাঁদের টাকা ফিরে পান নি।
ইউনিপেটুইড নামের প্রতিষ্ঠানটি ই-ভ্যালির আগে ২০০৯ সালে তাঁদের কার্যক্রম শুরু করে দেশে। ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভ দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সেসময় মানুষের কাছ থেকে বিনিয়োগ আদায় করে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিয়োগকারীদের তথ্য বলছে, ইউনিপেটুইডে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন গ্রাহকরা। কেউ টাকা ফেরত পান নি। ই-ভ্যালির কাছেও গ্রাহকের পাওনা প্রায় ৮০৮ কোটি টাকা।
টাকা খোয়ানোর শঙ্কায় হাজার মানুষ
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এমটিএফই কাণ্ডে প্রতারণার শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে কুষ্টিয়া, বরিশাল, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে। কুষ্টিয়ায় একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পরিচালক এবং এক সাবেক পুলিশ সদস্য মিলে এমটিএফইর কার্যক্রম চালাতেন। কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন সিঙ্গার প্লাজার দোতলায় তাঁদের কার্যালয় ছিল।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, এই দুজনের কথা ও প্রলোভনে পড়ে জেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এমটিএফইতে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাঁরা দুজন বর্তমানে সৌদি আরবে আছেন।
এমটিএফইর কুমিল্লা জেলার একজন সিওও কাজী আরিফুল ইসলাম বলেন, কোম্পানি তাঁকে বলেছিল ৩০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে আরও বড় পদে বসাবে। তাই নিয়মিত টাকা বিনিয়োগ করে আসছিলেন। এখন সবই হারিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে ই-কমার্স বা অনলাইনভিত্তিক প্রতারণামূলক চক্রের ফাঁদ। বাংলাদেশে এমএলএম ব্যবসা নিয়ে আইন থাকলেও অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবু আড়ালে কাজ করে যাচ্ছে হাজারো অ্যাপভিত্তিক চক্র। যারা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের পক্ষে এসব প্রতিরোধে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ হচ্ছে না বরং হালকা ভাবে নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষে এসব বিনিয়োগ রোধে প্রচার-প্রচারণা করা ছাড়া উপায় দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য সহায়তা:
- প্রথম আলো, ২২-২৩ আগস্ট, ২০২৩
- উইকিপিডিয়া
- সমকাল, ২২-২৩ আগস্ট, ২০২৩
আই নিউজ/এইচএ
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ