Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৭ ১৪৩২

মো. রওশান উজ্জামান রনি

প্রকাশিত: ১২:৫২, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩

প্রাচীন মিশরীয়দের মমি তৈরীর রহস্য উদঘাটন

মমি। ছবি অনলাইন

মমি। ছবি অনলাইন

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মৃতদেহ প্রাকৃতিক ভাবে ধ্বংস এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে মমি তৈরি করা হতো। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগের বহু মৃতদেহ এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তারা কিভাবে এত সুদীর্ঘকাল মৃতদেহ সংরক্ষণ করত তা সত্যিই বিস্ময়কর। 

তবে মমি তৈরির প্রক্রিয়া এখন আর কোনো রহস্য নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইজিপ্ট লজিস্টরা বহু গবেষণার পর মমি তৈরীর রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছেন। অই নিউজের আজকের প্রতিবেদনে প্রাচীন মিশরীদের মনি তৈরীর প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। 

মিশরীয়রা মৃতদেহকে মমি তৈরি করে রাখত কেন? প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস মতে মৃত ব্যক্তিরা বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করে। তাদের ধারণা ছিল তারা মৃত্যুর পর জগতে মহাপ্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করে। সেজন্য তাদের মৃতদেহ চমৎকারভাবে প্রস্তুত করা হয়। তারা মনে করত মৃত্যুর পর একজন মৃত ব্যক্তিকে ৪২ জন দেবতার সামনে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে মৃত ব্যক্তির হৃদপিণ্ড পরিমাপ করা হয়। কারো হৃদপিণ্ড ভারী হলে সেই ব্যক্তিকে অত্যাচারী ও খারাপ লোক বলে মনে করা হতো। তাকে সাথে সাথে দেবতারা ধ্বংস করে দেয়। আর যার হৃদপিণ্ড হালকা হবে সে চিরস্থায়ী সুখ শান্তি লাভ করবে। এরকম ধারণার কারণেই মিশরীয়রা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতিকে বেশ গুরুত্ব দিত। তারা আরো মনে করত মৃত্যুর পর তাদের দেহ যতদিন সংরক্ষিত থাকবে ততদিন তারা স্বর্গে বাস করবে। সেজন্যই নশ্বর দেহকে স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য তারা মমি তৈরি করা শুরু করে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মৃতদেহ সৎকারের একটি ধারা হলো মমিকরণ। কোন লাশকে মমি করার উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির আত্মা ও শরীর পরজনমে প্রবেশ করতে সহায়তা করা। তাদের ধারণা অনুযায়ী এর মাধ্যমে তারা পবিত্রতা অর্জন করে। প্রথমদিকে শুধু রাজাদেরকে মমি করা হতো। কারণ মিশরীয়রা মনে করত রাজারা মারা যাবার পর মৃতদের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তবে পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরের অভিযাত ব্যক্তিবর্গ এবং বিত্তশালী লোকদেরকেও মমি করা হয়েছে।

মমি কিভাবে তৈরি হয়? মমি তৈরির প্রক্রিয়া মমি তৈরি করার জন্য দীর্ঘ এক আচর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই কাজগুলো করা হয় অত্যন্ত গোপনে। এই প্রক্রিয়ার ৭০ দিন যাবত চলমান থাকে। মমি তৈরির কাজ শুরু হয় কোন ব্যক্তি মারা যাবার চতুর্থ দিন থেকে। মমি তৈরির প্রথম দিকের ধাপগুলো খুবই ভয়ঙ্কর এবং অস্বাস্থ্যকর। প্রথমে ব্যক্তির নাকের মধ্যে একটি হুক দিয়ে মস্তিষ্ক বের করে আনা হতো। এরপর শরীরের বাম দিকে কেটে ভেতরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ফেলা হতো। এরপর পুরো শরীর বিশেষ ধরনের মদ দিয়ে ধৌত করা হতো। তারপর বিভিন্ন ধরনের ভেষজএবং সুগন্ধি দ্রব্যের থলে শরীরের ভেতরে ভরে দেওয়া হতো। শরীরের ভেতরে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ফেলা হলেও হৃদপিণ্ডটাকে জায়গামতো রেখে দেওয়া হতো। কারণ তারা মনে করত হৃদপিণ্ড হচ্ছে ব্যক্তির সকল জ্ঞানের কেন্দ্র। কোন ব্যক্তি তার হৃদপিণ্ড ছাড়া কবরে যেতে পারবে না। এছাড়া হৃদপিণ্ড পরিমাপ করেই ব্যক্তির সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ধারণ করা হয়। হৃদপিণ্ড শরীরের ভেতরে রেখে সেলাই করে দেওয়ার পর পুরো শরীরে ভেজিটেবল অয়েল মাখানো হতো। মৃতদেহ পরিষ্কার করার পর এই প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগতো।  

মমি তৈরির ভেষজ প্রক্রিয়া ; মৃতদেহ পরিষ্কার করার প্রাথমিক অবস্থা সম্পন্ন হবার পর দেহটিকে একটি চৌবাচ্চায় স্থাপন করা হতো। এই চৌবাচ্চাকে নেত্রন নামের এক ধরনের লবণ দিয়ে পূর্ণ করা হতো। এরপর লবণ সহ দেহটিকে রোদে শুকাতে দেওয়া হতো। লবণের মিশ্রণ এবং লাশের শরীরের পানি শুকাতে প্রায় 40 দিন সময় লাগতো। শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোও আলাদাভাবে একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে শুকানো হতো। এরপর সেগুলোকে চারটি পাত্রে ভরে মমির সাথে রেখে দেয়া হতো। এসব পাত্র কে বলা হতো কেনপিক যার। শরীর শুকিয়ে যাবার পর আবারও সারা শরীরে এক ধরনের মলম লাগানো হতো।

মৃতদেহ প্রস্তুতকরনে ভেষজ প্রক্রিয়া শেষ হবার পর শুরু হতো মমি বাধাইয়ের কাজ। মমিতে প্যাঁচানোর জন্য বিশেষ ধরনের লিলেন কাপড় ব্যবহার করা হতো। ব্যক্তিবেদে এই কাপড়ের মান আলাদা হতো। ধনী ব্যক্তিদের কে সর্বোচ্চ সেরা মানের লিলেন দেওয়া হত। আর অপেক্ষাকৃত গরীবদের বাজে কাপড়ে মোরা হতো। একটি মৃতদেহকে বিশ ধরনের কাপড় দিয়ে পেঁচানো হতো। সে কারণে শত শত গজ লিলেনের দরকার পড়তো। মামীর শরীর বাধাই করতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগতো। দেহ প্যাচানোর প্রতিটি পরতে তাবিজ কবজ বেধে দেওয়া হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল কবরে যাওয়ার পর দেহ যেন জেগে উঠতে পারে। এই সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে মমি করন সম্পূর্ণ হতে প্রায় ৭০ দিন সময় লাগতো। এরপর এসব মমিকে তাদের সুরক্ষিত কবরে স্থাপন করা হতো। তাদের বিশ্বাস মতে সেখান থেকেই মৃত ব্যক্তিরা তাদের পরজনমে পদার্পণ করে। 

মমি তৈরির মাধ্যমে মৃতদেরকে শারীরিকভাবে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি আবহাওয়াজনিত ক্ষয় রোধ করতে বিশেষ ধরনের কফিনের মধ্যে মৃতদেহ স্থাপন করা হতো। মাটির অনেক গভীরে সুরক্ষিত কবর নির্মাণ করে তার ভেতরে কফিন গুলোকে রাখা হতো। এখনো পর্যন্ত বেশ কয়েক ধরনের কফিন পাওয়া গেছে। তৎকালীন সময়ের অতি উচ্চ শ্রেণীর মানুষের জন্য একাধিক কফিনেও ব্যবহার করা হতো। একটি কফিনের মধ্যে আরেকটি কফিন দিয়ে সমাধি করাকে বলা হয় নেস্টেট কফিন। তবে তার চেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বেশ কিছু পাথরের কফি ও পাওয়া গেছে। এসব পাথরের কফিনকে বলা হয় সারকোফেগাস। প্রাচীন মিশরের মন্ত্রী বা রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে এসব সারকোফেগাসের মধ্যে সমাধিত করা হতো। পাথরের কফিন মাটির প্রায় দেড়শ ফুট গভীর স্থাপন করা হতো। মিশরীয়রা মনে করত মারা যাবার পরও মানুষের ধন-সম্পদ সহ বিভিন্ন জিনিসের দরকার হয়। সে কারণে এসব ধরনাণ্য ব্যক্তিদের সমাধিতে প্রচুর পরিমাণে সোনা রুপাসহ মূল্যবান সম্পদ রেখে দেয়া হতো। সে জন্য এসব কবর ছিল চোর ডাকাতদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্র। গবেষকরা অনেক কবরের ভেতরে পর্যালোচনা করে দেখেছেন, যারা এসব সুরক্ষিত খবর তৈরি করেছে তারাও পরবর্তীতে গোপনে সেখান থেকে ধন-সম্পদ চুরি করে নিয়ে গেছে। প্রাচীন মিশরের মমিকে আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা ছিল পিরামিড নির্মাণ। সাধারণত মিশরের রাজাদের মমি সংরক্ষণের জন্য পিরামিড তৈরি করা হতো। হাজার হাজার বছর ধরে মিশরের পিরামিডি ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর স্থাপনা। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন এই সব পিরামিড।

তবে এত ছিল মানুষের তৈরি মমি। কুরআনে এক ফেরাউনের কথা বলা আছে। যিনি সাগরে ডুবে মারা গেছেন। ফেরাউনের এই মমি পাওয়া গেছে ১৮৮১ সালে আর কোরআন নাজিল হয়েছে হাজার বছর আগে। সাগরের পানিতে অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সেখানে এত বছর পরেও অক্ষত থাকা রীতিমতো অসম্ভব। প্রাচীন মিশরীয়রা মমির পদ্ধতির তেমন কিছু জানতেন না। যা জানতেন তাতে লাশ এতটা সংরক্ষিত থাকারও কথা না। এটি সেই মমি যার কথা কুরআন বলা আছে।

“অতএব আজকের দিনে বাচিয়ে দিচ্ছি আমি তোমার দেহকে যাতে তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে আর নিঃসন্দেহে আমার মহাশক্তির প্রতি লক্ষ্য করে না।”

ফেরাউন সেই ব্যক্তি যে নিজেকে স্বয়ং আল্লাহ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন নাউজুবিল্লাহ। যার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তার লাশ চির অবিকৃত রাখার ঘোষণা দেন। সীমা লংঘনকারীদের কারীদের জন্য এটা সতর্কবার্তা। এত বছরে পচন ধরেনি ফেরাউনের লাশে।
আই নিউজ/আর

আরও পড়ুন

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়