মো. রওশান উজ্জামান রনি
আপডেট: ২০:১৫, ৯ অক্টোবর ২০২৩
মাদার তেরেসা সম্পর্কে বিশেষ ডকুমেন্টারি মানবসেবার আড়ালে ব্যবসা
মাদার তেরেসা সম্পর্কে বিশেষ ডকুমেন্টারি। ছবি অনলাইন
‘মাদার তেরেসা’ ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করেন, কিন্তু মাদার তেরেসার সম্পর্কে জানেন না। এমন লোক খুজে পাওয়া দায়। তাই নয় কি? কিন্তু কতটুকু জানে তাঁর সম্পর্কে? নভেল বিজয়ী মাদার তেরেসা মানবসেবার আড়ালে জঘন্যতম ব্যাবসা সম্পর্কে ঠিক কতটুকু জানেন আপনি?
৮ নভেম্বর ১৯৯৪ ইংল্যান্ডের চ্যানেল ৪ প্রচারিত হয় এক বিশেষ ডকুমেন্টারি। নাম (Hell’s Angel)। ইস্টফার হিচেনসের উপস্থাপনায় চব্বিশ মিনিটের সেই ডকুমেন্টারি প্রচারের পরই বিশ্বের নানা প্রান্তে বিতর্কের ঝড় ওঠে। চোখ কপালে তুলে ফেলেন অনেকে। আর ফেলবে নাই বা কেন অঙ্ক যে মেলে না। মাদার তেরেসা সম্পর্কে এতকাল মিডিয়া যা দেখিয়ে এসেছে বই পুস্তকে যা পড়ানো হয়েছে তার অনেক কিছুই ওলট পালট করে দিল ওই এক ডকুমেন্টারি। কি ছিল সে ডকুমেন্টারিতে? আর কেনই বা এত গোলমাল!
‘মাদার তেরেসা’ এই নামটি শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া খুব একটা সোজা কাজ হবে না নিশ্চয়ই। মাদার তেরেসা নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে নীল পার সাদা শাড়ী পরিহিত এক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী বৃদ্ধার মুখো ছবি। যার সারাটা জীবন কেটেছে আর্ত মানবতার সেবায়। অসুস্থ জরাগ্রস্থ লোকদের জন্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, অভুক্তদের জন্য ভোজনশালা স্থাপন, অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম বানানো, স্কুল প্রতিষ্ঠা। কি করেননি তিনি? তার এত শত কাজের জন্য তিনি বাহবা কুড়িয়েছেন তামাম দুনিয়ায়। পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। হ্যাঁ সারাটা জীবন মাদার তেরেসার সম্পর্কে মোটামুটি এগুলোই শুনে এসেছেন নিশ্চয়ই। এসবই শোনানো হয়েছে আমাদের আর তার সঙ্গে শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি আমরা। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু গোলমালটা পাকালো ওই ডকুমেন্টারিটাই। আসুন ডকুমেন্টারির গল্পে যাবার আগে মাদার তেরেসার জীবনীর উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে আসি। উনিশশো দশে আলবেনিয়ায় জন্ম। আঠারো বছর বয়সে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতে আসেন তিনি। উনিশশো সাতানব্বই সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই ছিলেন। উনিশশো পঞ্চাশ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার দাতব্য সংস্থা মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। তার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসালয়, আশ্রম, ইস্কুল এই সংস্থার অধীনেই পরিচালিত হয়। এই মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল একজন ভলেন্টিয়ার ডাক্তারের। নাম ডক্টর আরূপ চ্যাটার্জী। কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় এক বামপন্থী রাজনৈতিক দলের দারিদ্র নির্মূল অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। পরবর্তীতে একটি হাসপাতালে গরীব ও দুঃস্থদের সেবা দিতে শুরু করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক অসুস্থ বা আহত শরণার্থীর চিকিৎসাও এই হাসপাতালেই করেছেন তিনি। এসব সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনার সময় অনেক নিপীড়িত হতদরিদ্র মানুষের দ্বারে ঘুরতে হয়েছে তাকে। এক সময় তিনি লক্ষ্য করেন মাদার তেরেসার প্রতিষ্ঠিত মিশনারি কোনো স্বেচ্ছাসেবীকেই এসব অবহেলিত মানুষের দ্বারে দেখা যায় না। এ থেকে তার মনে কৌতূহল জেগে ওঠে। নিজ উদ্যোগেই শুরু করেন অনুসন্ধান। আর অনুসন্ধানে তিনি যা দেখতে পান তা না কোন নিউজ মিডিয়ায় আসতো না কোন বই পুস্তকে লেখা থাকতো।
তবে তখন কাউকেই তেমন কিছু জানাননি তিনি। ১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান আমাদের ডাক্তার সাহেব। গিয়ে তিনি দেখতে পান সেখানে চারদিকে মাদার তেরেসা আর তার মিশনারির জয়জয়কার। এসব দেখে তিনি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ হন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন যা যা সরোজমিনে দেখে এসেছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবেন। মিশনারি আফ চ্যারিটির মুখোশের আড়ালে রূপটা সবার সামনে উন্মোচন করবেন। সেই অনুযায়ী উনিশশো তিরানব্বই সালে তিনি বান্দুং প্রোডাকশনসের এর সহকারী প্রডিউসার ভানিয়া ডেল বার্গের কাছে একটা short ডকুমেন্টারি বানানোর প্রস্তাব পাঠান। ডেলবার্গ প্রস্তাবি নিয়ে চ্যানেল ফোরের কাছে গেলে তারা এ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং লেখক সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেনসকে ডকুমেন্টারিটি স্ক্রিপ্ট লেখা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব দেয়। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত হওয়া এই ডকুমেন্টারিতে উঠে আসে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির নানা অনিয়ম অব্যবস্থাপনার চিত্র। কেমন অব্যবস্থাপনা? আসুন দেখা যাক। প্রথম পয়েন্ট হলো মাদার তেলেসার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসালয়গুলোতে যারা সেবা দেয় তাদের কোনো স্বীকৃত প্রশিক্ষণ নেই। কোন প্রকার মেডিকেল জ্ঞান ছাড়া শুধুমাত্র পূর্ব অভিজ্ঞতা আর স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেই এখানে চলতো চিকিৎসা। এমনকি কোন ডাক্তার সেখানে স্বেচ্ছায় সেবা দিতে এলে সে আসলে ডাক্তার কিনা তার কোয়ালিফিকেশন কি? এগুলো পর্যন্ত যাচাই করা হতো না। অবস্থা এমন ছিল যে কেউ ডাক্তার সেজে সেখানে গিয়ে চিকিৎসা দিয়ে আসতে পারত। এ কথার সত্যতা যাচাই করতে জার্নালিস্ট ডোনাল্ড ম্যাকিন্টায়ার ডাক্তার সেজে সেখানে যান আর তাকে ডাক্তারি করতেও দেওয়া হয়।অবস্থাটা বুঝতে পারছেন।
ম্যাকিন্টায়ার সাহেব আরও দেখতে পান চিকিৎসালয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ বাচ্চাদের সারাদিন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। যাতে তারা জ্বালাতন করতে না পারে। এমনকি সেখানে যথাযথ স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থাও ছিল না। ছিল না রোগীর জন্য কোন গরম পানির ব্যবস্থা। অসুস্থ রোগীদের গোসল করানো হতো ঠান্ডা পানি দিয়ে। রোগীরা হাসপাতালে হিটার বসানোর দাবী করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ এতে নাকি যীশু অখুশি হবে। এখানেই শেষ নয়। একসুই দিয়ে ইনজেকশন পুশ করা হতো একাধিক ব্যক্তির শরীরে। সেই সুই গরম পানিতে ফোঁটানো তো দূরের কথা শুধুমাত্র ট্যাপের পানিতে ধুয়েই আরেকজনের শরীরে ঢোকানো হতো। আর হ্যাঁ এসব চিকিৎসালয়ে এইডস আক্রান্ত রোগীও ছিল। ব্যাপারটা কতটা মারাত্মক বুঝতে পারছেন।রোগীদের মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ প্রদান আর ভুল চিকিৎসা ছিল এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। চিকিৎসার নামে এমন তামাশা, দায়িত্বহীনতা আর অবহেলার জন্য যে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে সে হিসাবও নেই কারো কাছে। অথচ মাদার তেরেসা যেনো এসব দেখেও দেখতেন না। সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন এই ব্যাপারে। সম্ভবত ভাবছেন অর্থের অভাবে হয়তো প্রশিক্ষিত ডাক্তার রাখা হয়নি বা চিকিৎসা সরঞ্জামের এই হাল। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিবছর গড়ে মাদার তেরেসা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কত অনুদান পেত জানেন? মোটামুটি ৩০ মিলিয়ন ডলারের মতো। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ভ্যাটিকান ব্যাঙ্ক একাউন্টে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৭৫২ লাখ কোটি রুপি।
সংখ্যাটা আবার খেয়াল করুন। ৭৫২ লাখ কোটি। পরিমাণটা এত বেশি ছিল যে এই টাকা একবারে তুলতে গেলে ভাটিকান ব্যাঙ্কই দেউলিয়া হয়ে যেত। কাজেই টাকা পয়সার অভাব নিশ্চয়ই ছিল না। তাহলে সেবার মান এমন কেন ছিল? আর এত এত অনুদানের টাকা যেতই বা কোথায়? তিনি যদি সত্যিই মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করতে চাইতেন, তাহলে এত এত অনুদানের টাকা দিয়ে গরিবদের স্বাবলম্বী করেননি কেন? বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী মাদার তেরেসার মুখ্য উদ্দেশ্য মানব সেবা ছিল না। তার উদ্দেশ্য ছিল মানব সেবার নামে মানুষকে খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করা। আর তাদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচার করা। যদি তাই না হবে তাহলে মৃত পথযাত্রী রোগীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করানোর চেষ্টা চালাত কেন তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যে বিপুল পরিমান অনুদান তিনি পেতেন তার বেশিরভাগই খরচ হতো ক্যাথোলিক চার্চের উন্নয়ন আর প্রসারের কাজে মানব সেবায় নয়। মানব সেবা ছিল অনুদান পাওয়া আর বিশ্ববাসীর কাছে গুটি ম্যাচ তৈরির এক হাতিয়ার মাত্র। দারিদ্র দূর করা তার মিশনারির উদ্দেশ্য ছিল না। বরং দারিদ্র পুষে রাখতে পারলেই তো লাভ। দারিদ্র দূর হয়ে গেলে অনুদান আসবে কোন উসিলায়। মাদার তেলেসার নিজের কথায় এর ইঙ্গিত মেলে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন I think the world is being match help by the suffering of the pose people. প্রতিবছর কি পরিমান অর্থ ডোনেশন বাবদ আসতো তা তো মাত্রই শুনলেন।
এই টাকার উৎস কি? সব তো জানা মুশকিল। তবে কিছু উৎসের খোঁজ দেই। চার্জ কিডিং নামের এক লোক মিশনারিতে প্রায় দশ কোটি রূপি অনুদান দেয়। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে জেলে যেতে হয়। অন্যের টাকা মেরে দিয়ে সেই টাকায় দান-দক্ষিণা করে পূর্ণ কামানোর তাহলেই ছেলেন এই লোক। অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই ঘটনা জানার পরও মাদার তেরেসা সেই অর্থ তার আসল মালিককে ফেরত দেননি। তাছাড়া বিভিন্ন মাফিয়া, বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা বা আমলার সাথে ওঠাবসা ছিল তার। তাদের অনুদান সব সময় সাদরে গ্রহণ করেছেন তিনি। টু শব্দটি করেননি কখনো। আর এত এত টাকা কোথায় যে কিভাবে খরচ হতো সে হিসেব নেই কারো কাছে। এটা অবশ্য শুধু মাদার তেরেসার মিশনারির ব্যাপার না। গোটা বিশ্বের খ্রিস্টান মিশনারি গুলো এভাবেই ছাড় পেয়ে আসছে। তাদের আয়-ব্যায়ের হিসাব দেখতে চায় না কোন দেশের সরকারই। বলা হয়ে থাকে Never meet your heroes দুঃখজনক হলেও অনেক বেশি সত্যি কথাটা।
১৯৯২ সালে মাদার তেরেসা নিজেই স্বীকার করেন প্রায় ২৯ হাজার লোককে মৃত্যুকালে না জানিয়ে তাদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। তার হিসাব অনুযায়ী সাংখ্যাটা ২৯ হাজার হইতে পারে। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে অনেকে মনে করেন। তার বিরুদ্ধে অন্যতম একটা অভিযোগ হইতেছে মাদার তেরেসার কাছে যখন কোন দুস্থ মানুষ সেবা চাইতে আসতো তখন তাদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার জন্য চাপ দেয়া হইত। মাদার তেরেসার সব কিছুই ছিল খ্রিস্টান হওয়ার শর্তে সেটা খাবার হোক কিংবা সোবার জায়গা হোক। মাদার তেরেসা সম্পর্কে সিমিলার অভিযোগ তুলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তাদের দাবি মাদার তেরেসা হিন্দু ধর্মকে শয়তানের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করছিলেন। এমনকি বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ জার্মান গ্রিয়ার মাদার তেরেসাকে ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন। আমরা সাধারণ মানুষরা যাদের আইডল মানি, ভক্তি শ্রদ্ধা করি তাদেরকে দূর থেকে দেখলে আপাত দৃষ্টিতে নিখুত মনে হয়। সঠিক মানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই নিখুঁত মানুষ বলে কিছুই নেই। আমরা কেউই ত্রুটির উর্ধে নায়। তাই যখন তাদেরকে কাছ থেকে দেখা হয় তাদের সম্পর্কে শামুক ধারণা পাওয়া যায় তখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি আমরা। মাদার তেরেসার মানবসেবার আড়ালের কেচ্ছা শুনে আপনারও তেমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক কিছু নয় বৈকি। হ্যাঁ তার উদ্দেশ্য যাই হোক তাতে মানবজাতির উপকার যে একেবারে হয়নি তা কিন্তু না। তবে বাল্যকাল থেকে যেভাবে চিনে এসেছি আমরা তার বাস্তবমূর্তি ততটা সৌম্য সুন্দর নয়।
আরও পড়ুন
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ