সাইফুর রহমান তুহিন
কলম্বিয়ায় মুসলিমদের উত্থান এবং বর্তমান বাস্তবতা
যখন খুব সকালের আলো দক্ষিণ আমেরিকান দেশ কলম্বিয়ার সীমান্ত শহর মাইকাও- এর রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে তখন হাসান ডানা হেঁটে হেঁটে যান তার ছোট গৃহসামগ্রীর দোকানে এবং শাটারটি তুলেন আর এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে ওঠে শহরটি। ভেনেজুয়েলান কর্মচারীকে নিয়ে হাসান তার ‘হাসুনা’ নামক দোকানটিকে দৈনন্দিন বেচাকেনার জন্য রেডি করেন। দোকানের সামনে তিনি বের করেন বেশ কয়েকটি ফ্যান, বিভিন্ন প্রকার টোস্টার এবং অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রী।
৩৩ বছর ধরে নিজ দোকানের মাধ্যমে মাইকাওয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন হাসান। নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য আরও বেশি আর্থিক সচ্ছলতার আশায় নব্বইয়ের দশকে জন্মভূমি লেবানন ত্যাগ করেছিলেন হাসান। সংবাদমাধ্যমকে হাসান বলেন, ‘‘লেবাননের তুলনায় এখানে আমি শান্তিতে আছি।’’ ফ্যান এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় হাসান বলেন, ‘‘মাইক বিস্ময়কর কোনো জায়গা নয় তবে এখানে যে কেউ কাজ করে ভালো থাকতে পারবেন এবং দেশে (লেবানন) ফিরে যাওয়ার চেয়ে এটি ভালো।”
অভিবাসীদের মধুচন্দ্রিমার সময় চিরস্থায়ী হয়নি। একসময় প্রতিবেশী ভেনেজুয়েলা অর্থনীতিতে ধ্বস নামে এবং ২০০০ সালের প্রথমদিকে দেশটি ধাবিত হয় একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের দিকে। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ধাক্কা এসে লাগে মাইকাওয়ের ওপর। একসময় যে অঞ্চলে অফুরন্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিরাজ করছিলো তা পড়ে যায় স্থবিরতার কবলে। আর এর ফলে উদীয়মান আরব অভিবাসীরা অন্যত্র নিজেদের ভাগ্য অনুসন্ধান শুরু করে।
মাইকাও হলো কলম্বিয়া-ভেনেজুয়েলা সীমান্তের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের একটি নিম্নবিত্ত অধ্যুষিত ছোট শহর। ধূলোবালিতে ভরপুর শহরটির বিভিন্ন প্রান্ত কলম্বিয়ার লা গুয়াজিয়া প্রদেশ সংলগ্ন এবং যা একসময় ছিলো কলম্বিয়ার আরব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাণকেন্দ্র।
মাইকাও সাম্প্রতিক মুসলিম প্রভাব
এখনকার দিনে মাইকাও ঠিক তা নয় যা এর হওয়ার কথা ছিলো যদিও এখানে আরব সম্প্রদায়ের প্রভাব অনেকদিন ধরেই বিদ্যমান। শহরটিতে আছে মসজিদ. আরব স্কুল এবং রাস্তার ওপর একটি ছোটখাটো আরব-পরিচালিত ব্যবসায়িক সাজসজ্জা। একথা উল্লেখ না করলেও চলে যে, এই শহরটির শাসনভার পরিচালনার দায়িত্বে আছেন লেবানিজ-কলম্বিয়ান মোহাম্মদ জাফর দাসুকি। কলম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র তিনিই।
শহরটির আকাশে ‘দ্য ওমর ইবনে আল-খাত্তাব মসজিদ’ হলো স্থানীয় সম্প্রদায়ের অনিবার্য শক্তির একটি বড় প্রমাণ। নজরকাড়া মার্বেল পাথরে নির্মিত মসজিদ বিল্ডিংটি দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। ১৯৯৭ সালে মাইকাওতে আরব সম্প্রদায়ের শক্ত অবস্থানের প্রতীক হিসেবে এটি নির্মিত হয়। মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন গবেষক পেদ্রো ডেলগাডো মসজিদটিকে মাইকাও শহরের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই মসজিদটিতে একসাথে ৭০০ মুসল্লির নামায পড়ার জায়গা রয়েছে। তবে এখন পবিত্র জুমার নামাযে সর্বোচ্চ দু’শর বেশি মুসল্লি না হওয়া বুঝিয়ে দেয় মুসলিম সম্প্রদায়ের হ্রাস পাওয়াকে।
মসজিদটির গা ঘেঁষে দার এল একরাম স্কুল হলো মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায়ের আরেকটি প্রতীকচিহ্ন। এক হাজারেরও বেশি ছাত্র নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি একসময় ছিলো মাইকাওয়ের আরব মুসলিম এবং মুসলিম অভিবাসীদের গর্বের বস্তু। এর বিস্তৃতি ছিলো আরও দুটি সেন্টার জুড়ে। তবে চলতি বছর স্কুলটির ছাত্রসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫২ জনে এবং সেন্টার কমে হয়েছে একটি আর এসব ছাত্রের অর্ধেকের শিকড়ই আরবে নয়।
১৯৮৭ সাল থেকে মাইকাওয়ে বসবাসকারী লেবানিজ নাগরিক ও দোকান মালিক নাসের গেবারা বলেন ‘‘আমাদের এখন সময় ভালো যাচ্ছে না এবং আমাদের সম্প্রদায় কঠিন সংকট মোকাবেলা করছে।’’ তিনি আরও বলেন’ ‘‘শহরটির প্রতি আমার ভালোবাসা আমার রক্তের সাথে মিশে গেলেও আমি অসংখ্যবার লেবাননে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছি। এর পাশাপাশি আমি এও ভেবেছি যে, মাইকাও শহরের প্রতি আমার ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়েছে আমার রক্তের প্রতিটি কণিকায়।”
মাইকাওয়ে অভিবাসনের ইতিহাস
মাইকাও শহরে এখনো যেসব মুসলিম ও আরব সম্প্রদায় টিকে আছেন তারা একটি বিশেষ আবেগকে ভাগাভাগি করেন। নির্দিষ্ট একটি জায়গার প্রতি আনুগত্য তাদেরকে যেমন অনেক কিছু দিয়েছে তেমনি নিয়েছেও অনেক কিছু। কলম্বিয়া এবং বিশেষ করে মাইকাওয়ের আরব সম্প্রদায়ের বেড়ে ওঠা বুঝতে হলে কাউকে ফিরে যেতে হবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। এই অঞ্চলে আরবদের অভিবাসন একেবারে ১৮৮০ সালের দিকের যখন মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেই অভিবাসন করেছেন অটোমান সাম্রাজ্য থেকে।
যখন অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলো তখন কিছুসংখ্যক আরব উত্তর কলম্বিয়াকে তাদের গন্তব্য বানালেন এবং বারানকুইল্লা ও মাইকাওয়ের মতো শহরের দিকে ধাবিত হলেন এবং তারা তা করলেন তাদের প্রাথমিক প্রবেশ পথ ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বন্দরগুলো থেকে। ১৯৭০ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে অনেক লেবানিজ নাগরিক অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সামান্য একটি অংশ চলে যান কলম্বিয়ায়।
কলম্বিয়ান ইতিহাসবিদ ও নৃ-বিজ্ঞানী দিয়েগো ক্যাস্তেলানোস মিডিয়াকে জানান যে, ‘‘মাইকাওতে আরব অভিবাসীরা প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব দেন ছোট ছোট সম্প্রদায় গড়ে তোলার দিকে যেখানে তারা এমন একটি পরিবেশে ইসলামী কায়দায় জীবনযাপন করবেন যে জায়গায় ইসলাম ধর্ম একবারেই অচেনা। ক্যাস্তেলানোস ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অব আনাতোলিয়ান স্টাডিজ-এ ‘কলম্বিয়ায় আরব ও মুসলিম কমিউনিটিসমূহ’ বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। আরব মুসলিম সম্প্রদায় ধীরগতিতে কিন্তু দৃঢ়তার সাথে মাইকাওয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে। তারা উজ্জীবিত হয় সীমান্তে চমৎকার ব্যবসায়িক সুযোগ দ্বারা এবং বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয় পুরো সত্তরের দশকে ভেনেজুয়েলার ক্রমবর্ধমান তেলনির্ভর অর্থনীতির মাধ্যমে।
অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি সীমান্ত শহর হিসেবে মাইকাওর পরিস্থিতি অবৈধ ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য বেশ অনুকূল আর এটি ছড়িয়ে পড়েছিলো গোটা শহর জুড়ে। এর ফলে জায়গাটিতে বিপুল আর্থিক লেনদেন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চলতে থাকে যদিও তা ছিলো অবৈধ। আশি ও নব্বইয়ের দশকে শহরটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে পেদ্রো ডেলগাডো বলেন যে, ‘‘অনেক জায়গাতেই মাইকাও থেকে জিনিসপত্রের সরবরাহ হতে থাকে যার মাধ্যমে একটি অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সূচনা হয় এবং চোরাচালানকৃত দ্রব্যের বেচাকেনা বেড়ে যায়। অবৈধ আমদানি ও রফতানি ব্যাপক আকার ধারণ করে। তদুপরি আরব সম্প্রদায় মাইকাওয়ের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির একটি হয়ে যায় কারণ, শহর এবং অভিবাসী দুই পক্ষই হাতে হাত ধরে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে থাকে। আর এ বিষয়টিই আরব অভিবাসীদেরকে এই ধূলোবালিপূর্ণ শহরে এসে স্থায়ী হতে উৎসাহিত করে। আর আরব বাণিজ্যই মাইকাওয়ের জনগোষ্ঠির মানোন্নয়নকে প্রভাবিত করে।’’
অভিবাসীদের সুসময়ের সমাপ্তি
অভিবাসীদের মধুচন্দ্রিমার সময় চিরস্থায়ী হয়নি। একসময় প্রতিবেশী ভেনেজুয়েলা অর্থনীতিতে ধ্বস নামে এবং ২০০০ সালের প্রথমদিকে দেশটি ধাবিত হয় একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের দিকে। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ধাক্কা এসে লাগে মাইকাওয়ের ওপর। একসময় যে অঞ্চলে অফুরন্ত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিরাজ করছিলো তা পড়ে যায় স্থবিরতার কবলে। আর এর ফলে উদীয়মান আরব অভিবাসীরা অন্যত্র নিজেদের ভাগ্য অনুসন্ধান শুরু করে।
দিয়েগো বলেন, ‘‘মাইকাও অনেকের জন্যই একটি ক্ষণস্থায়ী জায়গা। শহরের অধিকাংশ অধিবাসীই একে এমন একটি জায়গা হিসেবে দেখে যেখানে কয়েক বছর থেকে, টাকা-পয়সা রোজগার করে অন্যত্র চলে যাওয়া যায়।’’ তদুপরি
নব্বইয়ের দশকের পুরো সময়টিতে সন্ত্রাস, অপরাধ ও অপহরণের একটি কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় অধিবাসী ও অভিবাসীরা বাক্সপেটরা গুছিয়ে মাইকাও ছেড়ে চলে যেতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে কলম্বিয়া সরকার জায়গাটির ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং ভেনেজুয়েলা সীমান্তে যাবতীয় অবৈধ ব্যবসায়িক লেনদেন একবারে সীমিত করে ফেলেছে। আরব সম্প্রদায়, তাদের মসজিদ, স্কুল এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সবকিছুই সীমিত হয়ে এসেছে। যে সম্প্রদায় একসময় যেকোনো জায়গায় ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ ছিলো তাদের সংখ্যা এখন এক হাজারের নিচে যদিও পুরোপুরি সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা মুশকিল।
স্থানীয় দার এল আকরাম স্কুলের ডিরেক্টর জর্জ মেনডোজা বলেন, ‘‘মাইকাও একটি সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে যা এখানকার বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছে। ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ছিলো আরব যাদের অনেকেই সুযোগের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর এর প্রভাব পড়েছে স্কুলের ওপর।’’
যদিও মাইকাওয়ের আরব অভিবাসীরা বিভিন্ন অপরাধ করেছে এবং শাস্তি পেয়েছে তবুও তারা মূল জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো। অনেক কম শিশুকে এখন দার এল আকরাম স্কুলের করিডোরে দেখা যায়। যদিও একসময় পরিপূর্ণ থাকা মসজিদের প্রার্থনা কক্ষের সামান্য জায়গাই ভরে তারপরও মাইকাওয়ের মুসলিম সম্প্রদায় এখানকার মৌলিক জনগোষ্ঠির অংশ। ডিয়েগো ক্যাস্তেলানোস বলেন যে, ‘‘এমন একটি সময় ছিলো যখন আরব সম্প্রদায় মাইকাওয়ে সংঘটিত কর্মকান্ডের সাথে সংযুক্ত থাকতে গর্ববোধ করতো এবং এর পাশাপাশি তারা মাইকাওকে অন্য সবকিছুর একটি স্টার্টিং পয়েন্ট (শুরুর জায়গা) হিসেবে দেখার জন্য তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতো। মাইকাওয়ের জনগোষ্ঠির অবস্থা খুব খারাপ নয় কিন্তু তবে মাঝারি পর্যায়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে যে, তাদের (আরব) উপস্থিতি আমরা আর কতোদিন অনুভব করবো।’’
- সূত্র : দ্য নিউ আরব
লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক মোবাইল : ০১৭১৫৪১৭৩৩৮
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ