সাইফুর রহমান তুহিন
যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে জেনারের এমব্রয়ডারি ফ্যাশন বিপ্লব
ফিলিস্তিনে এমব্রয়ডারি শিল্পে নিজেদের ঐতিহ্যকেই তোলে ধরতে চান এই শিল্পের শিল্পীরা।
দক্ষিণ গাজা থেকে একটু বিচ্ছিন্ন খান ইউনিস এলাকার ভীষণ ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে আমাল আল-আবাদসা ও ইমান আল-আবাদসা প্রতিনিয়ত বুননের মাধ্যমে নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়ে যাচ্ছেন। দুই বোন শুরু করেছেন ফিলিস্তিনি এমব্রয়ডারিকে আধুনিকায়নের এবং এটিকে আধুনিক ফ্যাশনের পুরোভাগে নিয়ে আসার চমকপ্রদ এক যাত্রা। ফিলিস্তিনি সমাজে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী বুননশিল্পের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন দুর্দান্ত এক বুটিক হাউস যার নাম হলো জেনার।
মধ্য তিরিশের ইমান আল-আবাদসা এক বুক ভালোবাসা নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে বলেন যে, “আমাদের বাবা ফিলিস্তিনি সংস্কৃতি বিশেষ করে পোশাক- আশাকের বিষয়ে আমাদেরকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি আমাদের ঐতিহ্যকে শক্তভাবে ধরে রাখতে এবং সংরক্ষণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন।”
করোনাভাইরাস জনিত লকডাউনের সময় জেনারের বীজ বপন করা হয়েছিলো। তবে তারা দুই বোন উপলব্ধি করেছিলেন যে, এরকম অনিরাপদ এক সময়ে এমন একটি উদ্যোগের যাত্রা শুরু করা ঠিক হবে না।
আমাল ও ইমান তাদের অন্যান্য ভাইবোনদেরকে নিয়ে পাঁচ মাসব্যাপী মাঠ পর্যায়ের জরিপ শুরু করেন এবং নিজেদের চিন্তাভাবনা বাস্তবায়নের সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। ইমান বলেন, “আমরা চিন্তাভাবনা করি যে, বিশেষভাবে ফিলিস্তিনি থোবের (পোশাক) একটি দোকান খোলার বিষয়ে। আমরা বেশ তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলাম যে, আশপাশে এই ধারণার বাস্তবায়ন ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে কিন্তু যে উৎকর্ষতা এর মধ্যে আমরা চেয়েছিলাম তার অভাব রয়েছে।”
নিজেদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমাল ও ইমান তাদের চিন্তাভাবনাকে আরও প্রসারিত করলেন এবং সান্ধ্যকালীন পার্টি ড্রেস ও গাউনকে অন্তর্ভুক্ত করলেন। তারা তাদের বুনন উপাদানের সাথে আধুনিক নন্দনতত্ত্বের সমন্বয় ঘটালেন আর তাদের ডিজাইনের মধ্যে জুড়ে দিলেন ঐতিহ্যকে। সমসাময়িক ফ্যাশনের এই সমন্বয় চমৎকারভাবে দৃশ্যমান হলো এবং এটি বেশ সাড়া জাগালো। আর ক্রেতারাও খুঁজতে শুরু করলো নান্দনিক স্টাইলের সাথে ঐতিহ্যের এই সংযোগকে।
প্রবল উৎসাহের সাথে ইমান ব্যাখ্যা করলেন, “উপরোক্ত কারণেই জেনার এখানকার অন্যান্য দোকান কিংবা বুটিক শপ থেকে আলাদা। আমরা আবিষ্কার করলাম যে, এমব্রয়ডারি শিল্পকে বিয়ের গাউনের সাথে মিশ্রণ করার মাধ্যমে আমরা এখন উপহার দিতে পারি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কিছুর। এটি ছিলো আমাদের ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের সৌন্দর্যকে আধুনিক পোশাকে রূপ দেওয়ার বিষয়টি উদযাপন করার একটি উদ্ভাবনী উপায়। আর এর পাশাপাশি আমরা অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একটি সংযোগও স্থাপন করতে পেরেছি।”
মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশনে বিএ ডিগ্রিধারী ২৩ বছর বয়সী আমাল তার দক্ষতাকে ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন জেনারকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করার বিষয়টিতে প্রাণসঞ্চার করার মাধ্যম হিসেবে। প্রতিষ্ঠানের একটি মজবুত কাঠামো গড়ে তোলা এবং এটিকে নজরকাড়াভাবে উপস্থাপনের অংশ হিসেবে আমাল সমগ্র ব্র্যান্ডের ডিজাইনে সহযোগিতা করার জন্য তার এক প্রতিভাবান বান্ধবীর সহায়তা নিয়েছেন।
পুরো প্রক্রিয়ার চমককে তুলে ধরতে সংবাদমাধ্যমকে আমাল বলেন যে, “এটি ছিলো দারুণ এক জুটি। ধারণাটি
চমৎকারভাবে আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছিলো। আর এ কারণেই এটির সফল সমাপ্তিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আমরা ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি বুননশৈলীতে জ্যামিতিক নকশা করে এর থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলাম যা হলো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। আমরা পছন্দ করেছিলাম একটি সবুজ রংয়ের জীবন্ত প্যালেট (রংয়ের পাত্রবিশেষ) যা আমাদের এই ভূমির সাথে সম্পর্ককে খুব ভালোভাবে উপস্থাপন করে।’’
জেনারের দারুণ সব অফারের কথা খুব তাড়াতাড়িই ছড়িয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই বুটিক হাউসটি মেহেদী পার্টির আইটেম ভাড়া নেওয়ার জন্য একটি পছন্দের গন্তব্য হয়ে ওঠে। জেনারের সাশ্রয়ী দাম এবং এমব্রয়ডারি পোশাক ও গাউন ভাড়ার সুযোগ এটিকে ঐতিহ্যবাহী প্রাক-বিবাহ মেহেদী পার্টি আয়োজনের জন্য একটি চমৎকার পছন্দে পরিণত করেছে। তবে কেউ কেউ এটিকে ব্যয়বহুল মনে করেন। শুরুর দিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করলেও দুই মহিলা জেনারে তরুণীদের ব্যাপক ভিড়ের সাক্ষী হয়েছেন যারা ফিলিস্তিনের শিকড়ের সাথে সম্পৃক্ত এবং তাদের বিশেষ উপলক্ষের জন্য উপযুক্ত পোশাকের খোঁজ করে থাকেন। তাদেরই একজন সামার আলী নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে বলেন
যে, “আমি শুরুতে এখানে এসেছিলাম আমার মেহেদী পার্টির জন্য থোব ভাড়া নিতে। তবে যখন আমি গ্রহণযোগ্য দামে দুর্দান্ত সব এমব্রয়ডারি করা গাউন দেখলাম তখন সত্যিই খুব চমৎকৃত হলাম। আমি খুব তাড়াতাড়িই আমার মা-কে গাউন ভাড়া নিতে বলি।” তিনি আরও বলেন যে, ‘‘এখানে আমরা ফিলিস্তিনি সূচিকর্মসমৃদ্ধ আধুনিক পোশাক পরতে পারি।’’
বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে দুই বোনই এটিকে তাদের বুটিক এবং নজরকাড়া পণ্যগুলোর বিণপণনের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন খুব উৎসাহের সাথেই। তারা বলেন, “আমরা
বুটিকের অনলাইন উপস্থিতি সর্বাধিক করতে এবং আমাদের টার্গেট দর্শকদের সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলাম।”
নিজেদের অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে জেনার চেয়েছিলো ফিলিস্তিনি এমব্রয়ডারিকে শিক্ষিত ও শক্তিশালী করতে এবং একটি প্রজন্মকে ক্ষমতায়ন করতে। এই ইস্যুতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমাল গুরুত্বসহকারে বলেন যে, “জেনার কিন্তু শুধুই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত নয়। নয়। আমাদের উদ্যোগটি এর পুরোপুরি বাইরে। আমরা মানুষকে সৌন্দর্য ও ফিলিস্তিনি ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষিত করতে চাই।”
নিজেদের পরিচিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে জেনার ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিনি গানও শেয়ার করেছে। যেসব মহিলা স্বভাবসুলভ কায়দায় হেনা এবং ওয়েডিং পাটির্র সাথে জড়িত থাকেন তাদের জন্য জেনারের আছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং তারা সেই আচার-অনুষ্ঠানগুলো প্রদর্শন করে যা প্রজন্মান্তরে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একই সূতায় গেঁথে রেখেছে। দুই বোন এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাদের ঐতিহ্যকে সঠিক রূপদানকারী বেদনাদায়ক ইতিহাসকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
আমাল জেনারের জন্য তার আন্তরিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলেন যে, “আমরা বর্তমানে ফিলিস্তিনি পোশাক তৈরি করছি যা প্রতিটি গ্রামের প্রতীকী উপস্থাপনা হিসেবে কাজ করে বিশেষ করে যেসব জায়গা থেকে ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় আমাদের আমাদের বাবা-মা ও দাদা-দাদিদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করা হয়েছিলো।”
দুই বোনই এমব্রয়ডারি সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে আরও গভীর করতে আগ্রহী ছিলেন। সবকিছু বুঝার জন্য তাদের অনুসন্ধানে তারা সক্রিয়ভাবে বয়স্কদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেছেন এবং বিভিন্ন রকম সেলাই সম্পকে তাদের (বয়স্কদের) অন্তদৃষ্টিকে মূল্যায়ন করেছেন। তদুপরি তারা ‘প্যালেস্টাইন আর্ট অব এমব্রয়ডারি’-র মতো সীমিতসংখ্যক বই থেকে তথ্য যোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন।
জেনার এখন পর্যন্ত ১০ জন দক্ষ মহিলাকে নিয়োগ দিয়েছে যারা এমব্রয়ডারিতে বিশেষভাবে পারদর্শী। আমাল বলেন, “আমরা মহিলাদের ডিজাইনের প্যাটার্ন এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করি আর তাদের অগগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করি।” জেনার তাদের উৎপাদিত জিনিসের গণ্ডি স্থানীয় গ্রাহকদে বাইরেও বিস্তার করেছে। নিজেদের পোশাক ও গাউনের সৌন্দর্য ও কারুকার্যকে স্বীকৃতি দিয়ে জেনার পশ্চিম তীর এবং এর বাইরে রফতানি করা শুরু করে যাতে ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের একটি সুবাস বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। খান ইউনিসের ওপর সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে পাশাপাশি দাঁড়ানো ইমান ও আমালের চোখ ভরে ওঠে আশা আর গর্বে। আমাল আবেগময় কন্ঠে ঘোষণা করেন যে, “এমব্রয়ডারি আমাদের পরিচয়ের অংশ এবং আমাদের ফিলিস্তিনি ঐতিহ্যের অতুলনীয় সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির একটি বাস্তব প্রদর্শনী।”
- লেখক : সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক। ই-মেইল
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ