সাইফুর রহমান তুহিন
চীনে অস্তিত্ব সংকটে উইঘুর মুসলিমরা
চীনে জিনজিয়াং অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে উইঘুর মুসলিমদের আন্দোলন।
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় এবং অন্যান্য মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের জন্য চীনের ওপর মানবতার বিপক্ষে অপরাধ এবং এমনকি গণহত্যারও অভিযোগ আনা হয়েছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলো বিশ্বাস করে যে, চীন গত কয়েক বছরে জোরপূর্বক দশ লক্ষেরও বেশি উইঘুরকে ‘পুন:শিক্ষা শিবির’ বলে একটি বৃহৎ নেটওয়ার্কে আটক করেছে এবং কয়েক হাজারকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
সংবাদ সংস্থা বিবিসি’র যোগাড় করা ২০২২ সালের পুলিশ ফাইলের একটি সিরিজে উইঘুর মুসলিম সহ চীনের এই শিবিরগুলোর বিশদ বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া, সশস্ত্র অফিসারদের নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে বন্দী শিবির থেকে পালানোর চেষ্টাকারীদের গুলি থেকে হত্যার নীতির অস্তিত্বের কথা সেখানে উল্লেখ আছে।
জিনজিয়াং প্রদেশে গণহত্যার বিষয়ে চীনের বিপক্ষে অভিযোগকারী অনেকগুলো রাষ্ট্রের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার গ্রুপ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ চীনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। চীন অবশ্য জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লংঘনের সমন্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জিনজিয়াং পুলিশের ফাইল প্রকাশের পর চীন সরকার জানিয়েছে যে, সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতার ফলে জিনজিয়াংয়ে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে এসেছে এবং আর এগুলো হলো সবরকম মিথ্যার বিপক্ষে সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া।
উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি। যা তাদের স্বতন্ত্রতার পরিচয় বহন করে। ছবি- অনলাইন
উইঘুর মুসলিম কারা?
জিনজিয়াংয়ে আনুমানিক ১২ মিলিয়ন উইঘুরের বসবাস যে অঞ্চলটি অফিসিয়ালি জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। উইঘুররা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে যা অনেকটা তুর্কি ভাষার মতোই। তারা নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর কাছাকাছি মনে করে। জিনজিয়াংয়ের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কিছুটা কম হলো উইঘুররা।
সাম্প্রতিক সময়ে জিনজিয়াংয়ে হানদের (চীনের একটি বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠী) ব্যাপক অভিবাসন লক্ষ্য করা গেছে। অভিযোগ আছে যে, অঞ্চলটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠিকে দুর্বল করার জন্য এটি রাষ্ট্রের একটি পলিসি। চীনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে যে, তারা এই অঞ্চলের মুসলিম ধর্মীয় নেতাদেরকে টার্গেট করছে, অঞ্চলটিতে ইসলাম ধর্মীয় কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করছে এবং মসজিদ ও সমাধিস্থল ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। উইঘুর কর্মীরা বলছেন যে, তারা এই জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকার মধ্যে আছেন।
উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি পরিবার। যেখানে পরিবারের সকল সদস্যদের দেখা যাচ্ছে। ছবি- অনলাইন
জিনজিয়াং কোথায়?
চীনের মানচিত্রের উত্তর-পশ্চিমাংশের মধ্যে অবস্থিত জিনজিয়াং হচ্ছে দেশটির সর্ববৃহৎ অঞ্চল। তিব্বতের মতো এটিও স্বায়ত্তশাশিত যার অর্থ হলো এটির স্ব-শাসনের কিছু ক্ষমতা রয়েছে। বাস্তবে কিন্তু উভয় অঞ্চলই কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা বড় রকমের বিধিনিষেধের শিকার।
জিনজিয়াং মূলত: একটি মরুময় অঞ্চল এবং এখানে উৎপন্ন হয় বিশ্বের মোট উৎপাদিত তুলার এক-পঞ্চমাংশ। মানবাধিকার গ্রুপগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে, রফতানিযোগ্য এসব তুলার অধিকাংশই বাধ্যতামূলক শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। এদিকে ২০২১ সালে কিছু পশ্চিমা ব্র্যান্ড তাদের সাপ্লাই চেইন থেকে জিনজিয়াংকে বাদ দিয়েছে আর এর ফলে চীনা সেলিব্রিটি ও নেটিজেনদের কিছু ব্র্যান্ড নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিবিসি’র একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, জিনজিয়াংয়ে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ লোককে জোরপূর্বক তুলা তুলতে বাধ্য করা হয়েছে। পুন:শিক্ষা শিবিরের মাঠে নতুন নতুন তুলার কারখানা গড়ে তোলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলটি কিন্তু তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ এবং মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে বেইজিং একে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য লিংক হিসেবে দেখে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে উইঘুররা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এই অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ১৯৪৯ সালে চীনের নতুন কমিউনিস্ট সরকার এর নিয়ন্ত্রণ নেয়।
জিনজিয়াং অঞ্চলের স্থানীয় একটি বাজারের চিত্র। যেখানে নারী দোকানীর বাচ্চাকে ঘুমোতে দেখা যাচ্ছে। ছবি- অনলাইন
চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডসসহ অনেকগুলো দেশ চীনকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছে। এই গণহত্যাকে আন্তর্জাতিক কনভেনশন দ্বারা একটি জাতীয়, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ঘোষণাগুলো সেই রিপোর্টগুলো অনুসরণ করে যে, উইঘুরদেরকে বিভিন্ন ক্যাম্পে নেওয়ার পাশাপাশি চীন সরকার উইঘুরদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার জন্য উইঘুর মহিলাদেরকে জোরপূর্বক নির্বীজন করছে, শিশুদেরকে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং উইঘুর জাতিগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে।
মার্কিন যক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন যে, চীন গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যের সংসদ ঘোষণা করেছিলো যে, চীন জিনজিয়াংয়ে গণহত্যা করছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের একটি মানবাধিকার কমিটি অভিযোগ করেছিলো তাদের হাতে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে যে, চীন জিনজিয়াংয়ে তাদের “উগ্রবাদ বিরোধী কেন্দ্রে” এক মিলিয়ন লোককে আটকে রেখেছে।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে জিনজিয়াংয়ে ৩৮০টি ‘পুন:শিক্ষা শিবিরের” প্রমাণ পেয়েছিলো যা পূর্বের অনুমানের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। ‘জিনজিয়াং পুলিশ ফাইল’ নামে সর্বশেষ পুলিশ নথিতে থাকা তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে একটি ক্যাম্প বা কারাগারে প্রায় ২৩,০০০ বাসিন্দা ছিলো যা একটি কাউন্টির প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ১২ শতাংশ বেশি।
এই পরিসংখ্যান মানলে ধরে নিতে হবে যে, ১.২ মিলিয়নেরও বেশি উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু প্রাপ্তবয়স্কদের আটক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্টের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেছেন যে, ফাইলগুলোতে চীনের মানবাধিকার লংঘনের বিস্ময়কর বিবরণ রয়েছে। এর আগে ‘চায়না ক্যাবলস’ নামে পরিচিত ফাঁস হওয়া নথিগুলো স্পষ্ট করে দিয়েছিলো যে, কঠোর শৃংখলা ও শাস্তিসহ ক্যাম্পগুলোকে উচ্চ নিরাপত্তা কারাগার হিসেবে চালানোর উদ্দেশ্য ছিলো। শিবির থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম ব্যক্তিরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন।
ক্র্যাকডাউন বিল্ড-আপ কি ছিলো?
নব্বইয়ের দশক থেকেই জিনজিয়াংয়ে হান বিরোধী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বৃদ্ধি পায় এবং কখনো তা সহিংসতায় রূপ নেয়। ২০০৯ সালে জিনজিয়াংয়ে এক সংঘর্ষে প্রায় ২০০ জন মানুষ মারা যায়। চীনারা তখন সমস্ত দোষ উঘুরদের ওপর চাপিয়ে দেয় যারা যারা তাদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র চেয়েছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তা ক্র্যাকডাউন (কঠোর অভিযান) এ বিষয়ে ভিন্নমতকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জিনজিয়াং এখন নজরদারির একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক দ্বারা আচ্ছাদিত যার মধ্যে পুলিশ চেক পয়েন্ট এবং ক্যামেরা রয়েছে আর এগুলো নম্বর প্লেট থেকে পৃথক মুখ পর্যন্ত সবই স্ক্যান করে।
-
যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে জেনারের এমব্রয়ডারি ফ্যাশন বিপ্লব
-
কলম্বিয়ায় মুসলিমদের উত্থান এবং বর্তমান বাস্তবতা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায় যে, মানুষের আচরণ নিরীক্ষণের জন্য পুলিশ একটি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে যেমন, তারা কতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে এবং কতোটা ঘন ঘন সদর দরজা ব্যবহার করছে। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একটি আদেশ জারি করেন যে, চীনের সমস্ত ধর্মের চূড়ান্ত গন্তব্য চীনা হওয়া উচিত। আর তখন থেকেই ক্র্যাকডাউন বেড়ে যায়। প্রচারকারীরা বলে থাকেন যে, চীন সরকার উইঘুর সংস্কৃতিকে নির্মুল করার চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালের আগে থেকে জিনজিয়াং পুলিশের ফাইলগুলো উইঘুরদেরকে বছরখানেক আগে সংঘটিত কথিত অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে আরও আলোকপাত করে। ফোনে কথা বলা এবং এর মাধ্যমে বক্তব্য শোনার বিষয়ে ছিলো কড়া নজরদারি।
চীন সরকারের বক্তব্য
চীন জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লংঘনের সব অভিযোগ অস্বীকার করে থাকে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন যে, জিনজিয়াং স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি উপভোগ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, জিনজিয়াংয়ে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং ইসলামপন্থী চরমপন্থাকে মূলোৎপাটন করা জরুরি এবং ক্যাম্পগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বন্দীদেরকে পুনরায় শিক্ষিত করার জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার।
চীন জোর দিয়ে বলে যে, উইঘুর জঙ্গিরা বোমা হামলা, নাশকতা এবং নাগরিক জীবনে অস্থিরতার পরিকল্পনা করে একটি স্বাধীন রাষ্টের জন্য হিংসাত্মক প্রচারণা চালাচ্ছে। জীবাণু মুক্তকরণের মাধ্যমে উইঘুর জনসংখ্যা কমানোর দাবিকে ভিত্তিহীন আখ্যায়িত করে থাকে চীন সরকার। আর জোরপূর্বক শ্রম আদায়ের বিষয়টিকেও কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেয় তারা।
- সূত্র : বিবিসি অনলাইন।
লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক, ইমেইল- [email protected]
- কেএফসির মালিকের জীবন কাহিনী
- প্রজাপতি: আশ্চর্য এই প্রাণীর সবার ভাগ্যে মিলন জোটে না!
- মা-শাশুড়িকে হারিয়েও করোনার যুদ্ধে পিছিয়ে যাননি এই চিকিৎসক
- বিশ্বের অদ্ভুত কিছু গাছের ছবি
- সোনার দাম এত কেন : কোন দেশের সোনা ভালো?
- যেখানে এক কাপ চা পুরো একটি পত্রিকার সমান!
- তিন রঙের পদ্মফুলের দেখা মিলবে এই বিলে
- রহস্যময় গ্রামটি লাখো পাখির সুইসাইড স্পট
- ২০২৩ সালে পৃথিবীর শক্তিশালী ১০টি দেশ!
- বায়েজিদ বোস্তামি: মাতৃভক্তির এক অনন্য উদাহরণ